মহামারি তাদের আয়-রোজগার কেড়ে নিয়েছে, অভাব সুষম খাবারের
বাংলাদেশ
মহামারি তার চাকরি ও সঞ্চয় কেড়ে নিয়েছে, শেষ পর্যন্ত তার একমাত্র সন্তানের পুষ্টির চাহিদা মেটানোর সক্ষমতাও। আনাস আহমেদের অর্থনৈতিক বেহাল দশার মধ্যে তার চার বছর বয়সী কন্যা সন্তানের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ সবচেয়ে বেশি উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মহামারির আগে নামকরা বায়িং হাউজে প্রায় ৪০ হাজার টাকা মাসিক বেতনের চাকরি করতেন তিনি। মাছ ও মাংসের পাশাপাশি নিয়মিতই কিনতেন ফল-ফলাদি কেনার সামর্থ্যও ছিল তার। সন্তানের জন্য কিনতেন দুধ, ডিম, হরলিক্সসহ বিভিন্ন ফুড সাপ্লিমেন্ট।
করোনায় গত বছরের মার্চে কাজের যায়গা বন্ধ হলে সঞ্চয় ভেঙ্গে আগের মতোই চলার চেষ্টা করছিলেন আনাস। তবে পরিবারের জন পুষ্টিকর খাবার কেনায় কোনো আপোষ করেননি। কিন্তু দিন গড়িয়ে মাসে, মাস গড়িয়ে বছর অতিক্রান্ত হয়। বছরের ব্যবধানেও চাকরিতে যোগ দিতে না পারায় এখন তিনি মোটর সাইকেলে যাত্রী পরিবহন করেন। আয় অর্ধেকে নেমে আসায় খাবার বাবদ ব্যয় কমাতে হয়েছে।
এখন যা আয় করছেন তা মহামারির আগের আয়ের তুলনায় অর্ধেক। তার তিন সদস্যের পরিবার বেশিরভাগ সময় ভাত-ডাল খেয়েই দিন কাটাচ্ছেন।
পুষ্টিকর খাবারের যোগান নিয়ে আনাসের মতোই দুর্ভাবনায় করোনায় আয় হারিয়ে গরিবের খাতায় নাম লেখানো কয়েক কোটি মানুষ। দেশের অতিধনী এক-চতুর্থাংশ মানুষের বাইরে সবারই আয় কমেছে করোনায়। অন্যান্য ব্যয় ক্ষেত্র বিশেষ বেড়ে যাওয়ায় খাবার বাবদ ব্যয় কমাতে হচ্ছে সবাইকে।
আয় কমে যাওয়ায় অনেক পরিবারে খাবার গ্রহণের পরিমাণ কমেছে বলে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসছে। বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, খাদ্য তালিকা থেকে অনেক পরিকার আমিষ, ফল বা অন্যান্য উপকরণ বাদ দিচ্ছে। অনেক পরিবারে এক বেলা কম খাওয়া হচ্ছে। খালি পেটে ঘুমাতে যাওয়া মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে।
অপ্রত্যাশিতভাবে আর্থিক সঙ্কটে পড়ে ৩৯ শতাংশ মানুষ খাবার ব্যয় কমিয়ে তা সামাল দেয়ার চেষ্টা করেন বলে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) "আরবান সোশিও-ইকোনমিক সার্ভে" শীর্ষক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। করোনা মহামারি শুরু হওয়ার আগের তথ্য দিয়ে তৈরি করা প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, সঙ্কটে পড়লে ২২ শতাংশ পরিবার কম খাবার খায়, আবার ১৭ শতাংশ পরিবার নিম্ন মানের খাবার খায়।
এ প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, পর্যাপ্ত খাবার না থাকায় ২১.২৫ শতাংশ শতাংশ মানুষ চিন্তিত থাকেন। পছন্দের খাবার খেতে পায়না ২০.৬৪ শতাংশ মানুষ। প্রয়োজনের তুলনায় কম খাবার খায় ১৪.৪৮ শতাংশ মানুষ।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, নগর অঞ্চলে খাবার নেই, আবার খাবার কেনার টাকাও নেই এমন মানুষের হার ১১.৫১ শতাংশ। আবার এক বেলা খাবার খাবার না থাকায় ক্ষুধার্থ অবস্থায় ঘুমাতে যায় ৮.২২ শতাংশ মানুষ।
বিবিএস বলছে, দুর্যাগে ২০ শতাংশের বেশি পরিবার তেমন কিছুই করে না। তা ছাড়া সঞ্চয় ভেঙ্গে, ঋণ করে বা অন্যদের সহায়তা নিয়ে অনেকেই সঙ্কট সামাল দেয়ার চেষ্টা করে থাকে।
খাবারের বৈচিত্র্য ও পরিমাণ কমে আসায় পুষ্টি পরিস্থিতিতে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা স্বাস্থ্য ও অর্থনীতি বিশেষজ্ঞদের। তারা বলছেন, দীর্ঘ দিন কম খেয়ে থাকার কারণে অপুষ্টির শিকার লোকজন আর আগের মতো কাজ করার শক্তি পাবেন না। এর ফলে করোনার প্রকোপ কমে আসলেও জাতীয় উৎপাদনশীলতা প্রাক-কোভিড অবস্থায় আর পৌঁছাবে না। পুষ্টির অভাবে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্থ হলে এর প্রভাব আগামী প্রজন্মেও পৌঁছাবে বলে আশঙ্কা তাদের।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক শারমিন রুমি আলিম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, মায়ের গর্ভ থেকে শুরু করে শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশ হয় দুই বছর বয়স পর্যন্ত। আর তাদের শারীরিক বিকাশের একটি ধাপ শেষ হয় পাঁচ বছর বয়সে।
গর্ভকালীন সময় থেকে প্রসবের দুই বছর পর্যন্ত মায়ের আর পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুর পুষ্টি নিশ্চিত না হলে বাচ্চার বুদ্ধিমত্তায় ঘাটতি থাকে।
পুষ্টির অভাব থাকলে শিশুর ওজন ও উচ্চতায় ঘাটতি থাকে। শ্রেনীকক্ষের শিক্ষায়ও তারা পিছিয়ে থাকায় কাঙ্খিত দক্ষতা অর্জন করতে পারে না বলে জানান তিনি।
করোনার কারণে ইতোমধ্যেই শ্রমের উৎপাদনশীলতা কমতে শুরু করেছে মন্তব্য করে বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মূখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, সংক্রমণের দ্বিতীয় ওয়েভের কারণে খাদ্য ও পুষ্টি পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হচ্ছে। এ পরিস্থিতির যত অবনতি হবে, মানব সম্পদ ও উৎপাদনশীলতায় এর প্রভাবও তত প্রলম্বিত হবে।
উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, এক মাস কম খেয়ে থাকলে পুষ্টিতে যতটা প্রভাব পড়বে, দুই মাস কম খেয়ে থাকলে প্রভাব বেশি হবে। তবে এক দুই মাসের ক্ষতি হয়ত কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। কিন্ত মাসের পর মাস ধরে এমনটা চলতে থাকলে পরবর্তী প্রজন্মও ক্ষতিগ্রস্থ হবে বলে সতর্ক করেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, ক্ষুধা নিয়ে শ্রেণীকক্ষ বা কর্মক্ষেত্রের কোথাও সঠিক ফলাফল আসবে না। সাধারণ অবস্থায় কেউ আট ঘন্টা কাজ করতে পারলে অভুক্ত বা কম খেয়ে থাকা কেউ আরও কম সময় কাজ করবে। দুই জনই সমান সময় জুড়ে কাজ করলে অভুক্ত মানুষের উৎপাদন হবে কম।
যেভাবে আর্থিক সঙ্কট মোকাবেলা করছে মানুষ
বছরের বেশি সময় ধরে চলমান সঙ্কটে অনেকেরই সঞ্চয় শেষ হয়ে গেছে। ঋণের পরিমাণও উন্নীত হয়েছে দ্বিগুণে। সরকারি বেসরকারি সহায়তাও কমে আসছে। অনেকের ঋণেদ্র পরিমাণও দ্বিগুণ হয়েছে এসময়। এর ফলে খাবারে কাটছাট করা মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে।
অঞ্চল ও পেশার বিবেচনায় পিছিয়ে থাকা ১০ শ্রেণির মানেুষের মধ্যে জরিপ চালিয়ে সিটিজেনস প্লাটফর্ম ফর এসডিজি জানিয়েছে, প্রায় ৮১ শতাংশ পরিবার করোনার কারণে খাদ্য ব্যয় কমিয়েছে।
৪৭ শতাংশের বেশি পরিবার খাবার তালিকা থেকে আমিষ বাদ দিয়েছে। খাবারে বৈচিত্র্য কমিয়েছে ৩৮ শতাংশ পরিবার। সাত শতাংশ পরিবার এক বেলা কম খেয়ে থাকছে। আর ১০ শতাংশ পরিবার শিশুখাদ্যের পরিমাণ কমিয়ে এনেছে।
ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এর একটি যৌথ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, করোনার কারণে আয় কমে যাওয়ায় বস্তিবাসীরা খাবার কেনায় এখন ১৬.৭ শতাংশ কম ব্যয় করেন। দুই শতাংশের বেশি মানুষ মাসে অন্তত একদিন এক বেলাও খাবার পান না।
এতে বলা হয়, ৫২ শতাংশ পরিবারের সপ্তাহের মেন্যুতে কোন মাংস থাকে না। ৭২ শতাংশ পরিবার দুধ ও ৪০ শতাংশ পরিবার ফল খেতে পায় না সপ্তাহে এক দিনও।
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ
পুষ্টি পরিস্থিতির অবনতি রোধে সরকারের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচীর আওতা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। দারিদ্র্য প্রবণ এলাকা বিশেষ করে শহরের বস্তি এলাকাকে কেন্দ্র করে খাদ্য বিতরণের পাশাপাশি শিশু খাদ্য বিতরণের পরামর্শ দেন তারা।
নিম্ন মধ্যবিত্তদের জন্য রেয়াতী মূল্যে চাল ডাল ও তেলের পাশাপাশি ডাল, ডিম, দুধ, শিশুখাদ্য বিক্রি আর মধ্যবিত্তদের জন্য বাজার মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার পরার্শ দিয়েছেন তারা।
অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, করোনার কারণে কারা খাদ্য সঙ্কটে রয়েছেন, তারা কোথায় থাকেন এ বিষয়ে সবার কাছেই তথ্য রয়েছে। সরকার চাইলেই তাদের কাছে খাবার বা নগদ অর্থ পৌঁছাতে পারেন।
তিনি বলেন, সবার কাছে মৌলিক খাবার পৌঁছাতে হবে। এ পরিমাণ খাদ্যের যোগান সরকারের রয়েছে। তবে এ লক্ষ্যে সরকারের পর্যাপ্ত কর্মসূচী নেই। থাকলেও এ সব কর্মসূচীর দক্ষতা নেই।
তিনি বলেন, গত বছর ৫০ লাখ পরিবারকে ২৫০০ টাকা করে দেয়ার ঘোষণা দিলেও সবার কাছে তা পৌছায়নি। শেষ পর্ন্ত ৩৬ লাখ লোকের কাছে এ অর্থ পৌঁছাতে অনেক সময় লেগেছে। আর এবার লক্ষ্যই ৩৬ লাখ।
গবেষণা সংস্থা সানেমের গবেষণা পরিচালক ড. সায়মা হক বিদিশা বলেন, স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও উৎপাদনশীলতায় করোনার প্রভাব দৃশ্যমান হতে অনেক সময় লাগবে। এ সব বিষয়ে দ্রুত নজর দেয়া না হলে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার বিভিন্ন সূচকে দেশ পিছিয়ে যেতে পারে।
অতিদরিদ্রদের জন্য বিনামূল্যে ও মধ্যবিত্তদে জন্য ন্যায্য মূল্যে পুষ্টকর খাবার সরবরাহের সুপারিশ করেন তিনি।
করোনার আগেও মিলত না সুষম খাবার
বাংলাদেশে একজন মানুষের এক দিনের সুষম খাবারের দাম ৫৮ টাকা, যা দক্ষিণ এশিয়ার আট দেশের মধ্যে সর্বনিম্ন। করোনার প্রকোপ শুরুর আগেও খাবারের পেছনে এ পরিমাণ অর্থ ব্যয় করার সামর্থ্য ছিল না দেশের অর্ধেকের বেশি মানুষের।
সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে, দেশের মানুষ দৈনিক গড়ে ১০৫২ গ্রাম খাবার গ্রহণ করেন, যা চাহিদার ৩৮৩ গ্রাম বা ২৭ শতাংশ কম।
প্রধান খাবার ভাত ও তেলজাতীয় দ্রব্য বেশি ব্যবহার হলেও বাংলাদেশে সবুজ শাক-সবজি ভোগের পরিমাণ চাহিদার মাত্র ৩৬ শতাংশ। অন্যান্য শাক সবজির ভোগের পরিমাণও ফুড বেজ্ড ডায়েটারি গাইডলাইনসের (এফবিডিজি) মাত্র ৫৪ শতাংশ।
বাংলাদেশে ফলফলাদি খাওয়ার প্রবণতা চাহিদার মাত্র ২৩ শতাংশ। আর দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য খাওয়ার প্রবণতা মাত্র ১৩ শতাংশ।
বাংলাদেশে এই দুই ধরনের খাবার গ্রহণের প্রবণতা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন।
Comments
While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.