মহামারিতে মহাসংকটে কুমিল্লার আবাসন ব্যবসা

বাংলাদেশ

25 August, 2021, 11:15 am
Last modified: 25 August, 2021, 01:13 pm
নগরীতে অলস পড়ে আছে পাঁচ হাজার কোটি টাকার অন্তত এক হাজার ভবন। করোনার কারণে অর্থনৈতিক মন্দাসহ নানামুখী প্রভাবের কারণে এমন অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।

কুমিল্লার প্রাণকেন্দ্র টাউনহল থেকে দক্ষিণ দিকে তাকালে চোখে পড়ে উঁচু উঁচু পাঁচটি ভবন। রাতে সারা শহরে যেখানে আলোকচ্ছটা থাকে, সেখানে ওই ভবনগুলোর দিকে তাকালে ভূতের বাড়ির মতো মনে হয়। এদের একটির কাজ সম্প্রতি শেষ হয়েছে। বাকি চারটি ভবন নির্মাণাধীন। কিন্তু করোনার কারণে নির্মাণ কাজ শেষ হওয়া ভবনটিরও উদ্বোধন করা যাচ্ছে না।

নগরীতে অলস পড়ে আছে পাঁচ হাজার কোটি টাকার অন্তত এমন এক হাজার ভবন। যার প্রায় ১০০টি মার্কেট, বাকিগুলো আবাসিক ভবনসহ অন্যান্য। এর মধ্যে কিছু ভবন নির্মাণাধীন। কিছু ভবনের নির্মাণ কাজ শেষ হলেও কোনো কাজে আসছে না। করোনার কারণে অর্থনৈতিক মন্দাসহ নানামুখী প্রভাবের কারণে এমন অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। কুমিল্লা সিটি করপোরেশন, দোকান মালিক সমিতি, ভবন মালিক ও আবাসন ব্যবসার সাথে সম্পৃক্তদের সাথে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

রিয়েল এস্টেট হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের সদস্য ও কুমিল্লার সাধারণ সম্পাদক ফারুক আহমেদ বলেন, "আমরা ডেভেলপররা অনেক সংকটের মধ্যে আছি। দেখা গেলো, কেউ বাড়ি করার জন্য ৯০ শতাংশ টাকা দিয়েছেন, কিন্তু হঠাৎ দুর্যোগের কারণে অর্থনৈতিক সমস্যা দেখা দেওয়ায় তারা টাকা ফেরত নিচ্ছেন। এ টাকাগুলো ফেরত দিতে খুব কষ্ট হচ্ছে আমাদের। তার ওপর কাস্টমার নেই। এছাড়া নির্মাণ কাজ শেষ হওয়া অনেক ভবন খালি আছে। কুমিল্লায় সবমিলিয়ে এমন পাঁচ হাজার কোটি টাকার ভবন অলস পড়ে আছে"। 

সূত্র জানায়, ২০১১ সালের ১০ জুলাই কুমিল্লা সিটি করপোরেশন প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর থেকে দ্রুত নগরায়ণ হতে থাকে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতালের সংখ্যা বাড়তে থাকে লাফিয়ে লাফিয়ে। গড়ে ওঠে অসংখ্য মার্কেট। বৃহত্তর কুমিল্লা ও বৃহত্তর নোয়াখালীর ছয় জেলা ছাড়াও দূরদূরান্তের মানুষ আবাসন গড়ে তোলে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন লাগোয়া এলাকায়। দ্রুত আবাসিক ভবনের সংখ্যাও বাড়তে থাকে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, কুমিল্লায় বাড়ি করা এবং বাসা ভাড়া নেওয়াদের মধ্যে বেশিরভাগই প্রবাসী পরিবার, শিক্ষক এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ী। প্রবাসী পরিবার, যারা কুমিল্লা নগরীতে বাড়ি করেছেন, ফ্ল্যাট কিনেছেন কিংবা বাসা ভাড়া নিয়েছেন, তাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল শহরের ভালো প্রতিষ্ঠানে সন্তানদের পড়াশোনা করানো। করোনার প্রভাব শুরু হওয়ার পর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বড় ধাক্কা লাগে। তাছাড়া গ্রামের তুলনায় শহরে করোনার সংক্রমণ বেড়ে যায়। এদিকে দীর্ঘসময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের আভাস মিলে। প্রবাসীরাও বেকায়দায় পড়েন। তাদের আয়-রোজগারেও ভাটা পড়ে। যার কারণে বাধ্য হয়ে অনেকে বাসা ছেড়ে গ্রামে চলে যান। অনেক পরিবার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও নিরাপত্তা ও অর্থ ব্যয় কমিয়ে নিতে পাড়ি জমান গ্রামে। এসময়ে অর্থ খাটিয়ে নতুন ভবন করা বা বাসাবাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকাকে অলাভজনক মনে করেন তারা।

শিক্ষক বা মাঝারি আয়ের লোকজন যারা দীর্ঘদিনের অল্প অল্প পুঁজিতে সামান্য জায়গা কিনে ভবন তুলছেন, তাদের অনেকের উদ্বৃত্ত আয় কমে যাওয়ায় ভবন নির্মাণে স্থবিরতা দেখা দেয়। আবার একাধিক ব্যক্তি মিলে যেসব ভবন গড়ে তুলছেন, তাদের আয়ের তারতম্যের কারণেও কাজ বন্ধ হয়ে যায়।

নির্মাণাধীন ভবনের একাধিক মালিকের সাথে কথা বলে জানা যায়, ভবন তোলা অবস্থায় তারা ফ্ল্যাট ভাড়া দিতে থাকেন, কিছু বিক্রি করে দেন। অগ্রিম ভাড়া ও ফ্ল্যাট বিক্রির টাকা দিয়ে ধীরে ধীরে অন্য ফ্ল্যাটগুলোর কাজ শেষ করেন। কিন্তু ভাড়াটিয়া ও ক্রেতা না থাকায় অনেক ভবন মালিকের অর্থ কুলিয়ে না ওঠায় তার কাজ বন্ধ রাখছেন। আবার আর্থিক সঙ্গতি থাকলেও ভাড়াটিয়া না পাওয়ার আশঙ্কায় কাজ বন্ধ বা মাঝামাঝি অবস্থায় রেখে ছেড়ে দিয়েছেন অনেকেই।

এদিকে কুমিল্লা নগরী এবং শহরতলীতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের পাঠদান করা হয়, ওইসব প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ এবং কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার পার্শ্ববর্তী যেসকল স্থান রয়েছে ওইসকল এলাকার ভবনগুলো অর্ধেকের বেশি ফাঁকা রয়েছে । নতুন করে নির্মাণাধীন বা গত দেড় বছরের মধ্যে নির্মাণ কাজ শেষ হওয়া ভবনগুলো অব্যবহৃতই থেকে যাচ্ছে।

কুমিল্লা দোকান মালিক সমিতি সূত্রে জানা যায়, করোনা সংক্রমণের কারণে সারাদেশের ন্যায় কুমিল্লাতেও ৯ মাসের বেশি দোকানপাট বন্ধ ছিল। করোনার প্রভাব শুরুর আগে থেকে অনেক মার্কেটের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। কিন্তু ওইসব মার্কেটের অধিকাংশেরই নির্মাণ কাজ পুরোপুরি শেষ করা সম্ভব হয়নি। মাঝে কিছু মার্কেট উদ্বোধন করা হলেও বাস্তবে কোনো কাজে আসছে না। এসব মার্কেটের মধ্যে আছে ফাইন্ড টাওয়ার, হিলটন টাওয়ার, এস আর প্লানেট ও সোনালী টাওয়ারসহ বেশ কিছু মার্কেট। ঠিক কবে নাগাদ ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন, তা নিয়ে খুব দুশ্চিন্তার মধ্যে আছেন তারা। 

কুমিল্লা নগরীর পশ্চিম বাগিচাগাঁও এলাকার বাসিন্দা মামুন আহমেদ বলেন, "বাগিচাগাঁও এলাকায় আমার তিনটি বাড়ি রয়েছে। দুটি বাড়ি কয়েক বছরের পুরোনো। ওই দুইটাতে কিছু ভাড়াটিয়া আছে। নতুন ভবনটির একটি ফ্ল্যাটও ভাড়া হয়নি"। 

তিনি জানান, "বাসার বেশিরভাগ ভাড়াটিয়া ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি করেন। বেতন কমে যাওয়ায় পরিবার গ্রামে পাঠিয়ে এখন তারা মেস করে থাকছেন"। 

আশ্রাফপুর এলাকার বাসিন্দা সালাউদ্দিন জানান, "কুমিল্লার হিলটন টাওয়ারে আমার একটি দোকান আছে। গত ৬ মাস চেষ্টা করেও ভাড়াটিয়া পাইনি"। 

রিয়েল এস্টেট হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন কুমিল্লার সভাপতি ও কুমিল্লা দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আতিক উল্লাহ খোকন বলেন, "কী পরিমাণ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছি, সেটা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। একদিকে পুঁজির সংকট অন্যদিকে জীবনযাত্রার ব্যয় হুহু করে বেড়ে গেছে। গত দুই বছরে আমাদের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেছে। তার ওপর পুরোনো মার্কেটগুলোকেও ঠিকভাবে চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় শক্ত পুঁজি না পেলে নতুন মার্কেটগুলোকে সহসা চালু করা যাবে না। আমরা সরকার কাছে সহজ শর্তে ঋণ দেওয়ার জোর দাবি জানাচ্ছি"। 

কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের কর আদায় কর্মকর্তা আবদুল করিম বলেন, "ভবনগুলোর নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার পর যখন ব্যবহার শুরু হতো, তখন হোল্ডিং ট্যাক্স নেওয়ার বিষয়টি আসতো। কাজ ঝুলে থাকার কারণে এসব ভবন থেকে রাজস্ব আদায় করা যাচ্ছে না"। 
 
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.