ভারতে লকডাউন: কেমন আছেন চিকিৎসা নিতে যাওয়া বাংলাদেশিরা

বাংলাদেশ

আজিজুল সঞ্চয়
31 March, 2020, 09:05 pm
Last modified: 31 March, 2020, 09:18 pm
ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে চিকিৎসা নিতে গিয়ে অনেক বাংলাদেশি নাগরিক সেখানে আটকা পড়ে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। চিকিৎসা শেষ হয়ে গেলেও তারা কেউই দেশে ফিরতে পারছেন না।

''এখানে আমরা না খেয়ে মারা যাবো, দোকানপাট সব বন্ধ। কোথাও কিছু পাচ্ছি না, টাকা-পয়সাও ফুরিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ থেকেও টাকা আনতে পারছি না। বাড়িতে সবাই চিন্তা করছে, যেভাবেই হোক দেশে ফিরতে চাই।''

জন্মভূমিতে ফেরার এমন আকুতি বগুড়ার গাবতলি উপজেলার ওয়ালি উল্লাহ'র।

নিজের বাইপাস সার্জারির জন্য গত ১২ মার্চ যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে যান তিনি। কিন্তু সেদেশের লকডাউনের কারণে হাসপাতাল বন্ধ করে দেওয়ায় বাইপাস সার্জারি হয়নি তার। বর্তমানে কর্ণাটক রাজ্যের ব্যাঙ্গালুরু শহরে আটকা পড়ে আছেন তিনি। সেখানেই স্বজনদের কথা মনে করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি দেশে ফেরার আর্তি জানান।

প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে সমগ্র ভারত লকডাউন করে দেওয়া হয়েছে। ফলে দেশেটির বিভিন্ন রাজ্যে চিকিৎসা নিতে গিয়ে ওয়ালি উল্লাহ'র মতো অনেক বাংলাদেশি নাগরিক সেখানে আটকা পড়ে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। চিকিৎসা শেষ হয়ে গেলেও তারা কেউই দেশে ফিরতে পারছেন না। ফলে দেশে থাকা স্বজনরা তাদের নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন।

ভারতে চিকিৎসা নিতে যাওয়া বাংলাদেশি নাগরিকদের একটি ফেসবুক প্ল্যাটফর্ম 'ইন্ডিয়া ট্রিটম্যান্ট কমিউনিটি বাংলাদেশ'। সোশ্যাল এই সাইটটির পরামর্শক হিসেবে কাজ করেন ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলা শহরের সরকারি একটি ব্যাংকের কর্মকর্তা মনোজ চৌধুরী। 

তিনি আটকে পড়া বাংলাদেশি রোগী ও তাদের স্বজনদের একটি তালিকা তৈরি করেছেন। তালিকা অনুযায়ী দিল্লি, কর্ণাটক রাজ্যের ব্যাঙ্গালুরু, তামিলনাড়ু রাজ্যের ভেলোর, মহারাষ্ট্রের মুম্বাই, তেলেঙ্গানা রাজ্যের হায়দরাবাদ ও পশ্চিমবঙ্গের কোলকাতা শহরে গত ২৮ মার্চ পর্যন্ত রোগী ও তাদের সঙ্গে থাকা স্বজনসহ মোট ৩২০ জন বাংলাদেশি নাগরিক আটকা পড়েছেন।

তাদের মধ্যে অধিকাংশ রোগীর চিকিৎসা শেষ হয়েছে। আবার অনেকের চিকিৎসা করোনা ভাইরাসের প্রভাবে বন্ধ রয়েছে।

বেঙ্গালুরু শহরের একটি হাসপাতালে তিন বছর বয়সী দেবনীল বণিকের ওপেন হার্ট সার্জারি হয়েছে গত ১৩ মার্চ। ১৬ মার্চ হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেওয়া হলেও লকডাউনের কারণে সে এবং তার পরিবারের সদস্যরা বাড়ি ফিরতে পারছে না।

আটকে পড়া বেশ কয়েকজন রোগী ও তাদের স্বজনদের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হয় দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের এই প্রতিবেদকের। তাদের একজন বন্দরনগরী চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লা এলাকার বাসিন্দা ধীমান কুমার বণিক। নিজের শিশুপুত্রের ওপেন হার্ট সার্জারির জন্য ব্যাঙ্গালুরু গিয়ে তিনি ও তার স্ত্রী এখন মানবেতর জীবন যাপন করছেন। সঙ্গে যে অংকের টাকা নিয়ে গিয়েছিলেন তাও ফুরিয়ে এসেছে। আর কদিন থাকলে না খেয়ে মরতে হবে বলে নিজের অসহায়ত্বের কথা জানিয়েছেন তিনি।

আপ্লুত কণ্ঠে ধীমান বলেন, আমার স্ত্রী ও তিন বছরের ছেলেকে নিয়ে ব্যাঙ্গালুরু এসেছি। গত ১৩ মার্চ নারায়ণা ইনস্টিটিউট অব কার্ডিয়াক সায়েন্সেস হাসপাতালে আমার তিন বছরের ছেলে দেবনীল বণিকের ওপেন হার্ট সার্জারি হয়েছে। ১৬ মার্চই আমাদের হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়। কিন্তু লকডাউনের কারণে দেশে ফিরতে পারছি না।

''টাকা-পয়সা যা নিয়ে এসেছিলাম তা সার্জারিতেই লেগে গেছে। আর কিছু টাকা আছে সেগুলো দিয়ে হোটেল ভাড়া ও খাবার খরচ চালাচ্ছি, সেগুলোও ফুরোনোর পথে। দেশ থেকেও টাকা আনতে পারছি না। বাড়ির সবাই আমাদের নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন।'' বললেন ধীমাণ।

এখানে খাবারের সমস্যা সবচেয়ে বেশী উল্লেখ করে তিনি বলেন, "কয়েকদিন ধরে শুধু সবজি খেয়ে বেঁচে আছি। রাস্তায় বের হতে পারছি না, কারণ পুলিশ সমস্যা করে। লকডাউনের মেয়াদ যদি বাড়ানো হয় তাহলে আমাদের সমস্যা আরও বাড়বে। কারও কাছ থেকে কোনো সহযোগিতা পাচ্ছি না।"

''বাংলাদেশ হাইকমিশন থেকে আমাদের কোনো সহযোগিতা করা হচ্ছে না। রোববার (২৯ মার্চ) হাইকমিশনের হটলাইনে যোগাযোগ করে আমাদের সবার পাসপোর্টের কপি পাঠিয়েছি। যেভাবেই হোক আমরা দেশে যেতে চাই।'' বললেন ধীমাণ।

দিল্লির বি এল কে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যাওয়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বিজয়নগর উপজেলার বাসিন্দা আসিফ ইকবাল বলেন, ২০১৬ সালের আগস্ট মাসে আমার কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়। চিকিৎসকদের পর্যবেক্ষণের জন্য আমাকে দিল্লিতে আসা-যাওয়া করতে হয়। সেজন্য গত ২৭ জানুয়ারি আমি আখাউড়া চেকপোস্ট দিয়ে ভারতে আসি। চিকিৎসা শেষে গত ২৫ মার্চ আমার দেশে ফেরার কথা ছিল।

লকডাউনের কারণে ফাঁকা সড়ক। ছবিটি মঙ্গলবার ভারতের তেলেঙ্গানা রাজ্যের হায়দরাবাদ শহরের সেকান্দারাবাদ এলাকা থেকে তোলা। ছবি: হাফিজুর রহমান

''কিন্তু লকডাউনের কারণে ফ্লাইটের টিকিট বাতিল হয়েছে। নতুন করে টিকিট কাটার টাকাও নেই। এসেছিলাম সুস্থ্য হতে, এখন অসুস্থ্য হয়েই দেশে ফিরতে হবে। এখানে বাংলাদেশিদের অবস্থা খুবই করুণ।''

মহারাষ্ট্রের মুম্বাই শহরে আটকা পড়া আরেক বাংলাদেশি নাগরিক নির্মল কুমার। ময়মনসিংহ জেলা সদরে বাড়ি তার। ২২ বছরের তরুণ নির্মল তিন মাস ধরে লিভার ক্যান্সারে ভুগছেন। বাবাকে সঙ্গে নিয়ে মুম্বাইয়ের টাটা মেমোরিয়াল সেন্টারে গিয়েছেন চিকিৎসা নিতে। কিন্তু চিকিৎসা পুরোপুরি না হওয়ায় তাকে আবার এপ্রিল মাসে যেতে বলেছেন চিকিৎসকরা। বর্তমানে সেখানে একটি বাসা ভাড়া নিয়ে থাকছেন তারা। লকডাউনের কারণে হোটেল বন্ধ থাকায় খাওয়া-দাওয়ায় সমস্যা হচ্ছে তাদের। সময় যত গড়াচ্ছে পরিস্থিতি ততই নাজুক হচ্ছে। আর কদিন গেলে রাস্তায় রাত কাটাতে হবে তাদের। তাই দ্রুত তাদেরকে দেশে ফেরাতে সরকারি কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন তিনি।

হায়দারাবাদের ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী বাংলাদেশি নাগরিক হাফিজুর রহমান কথা বলেছেন সেদেশে আটকে পড়া কয়েক বাংলাদেশির সঙ্গে। তাদের খাওয়া-দাওয়ায় বেশি সমস্যা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তিনি। 
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.