ভর্তুকি মূল্যের নিত্যপণ্য কিনতে মধ্য আয়ের মানুষও টিসিবির লাইনে দাঁড়াচ্ছেন

বাংলাদেশ

12 July, 2021, 11:50 pm
Last modified: 13 July, 2021, 02:03 pm
টিসিবির এক বিক্রেতা বলেন, “পণ্য শেষ হয়ে যায়, তবু মানুষের লাইন আর শেষ হয় না।”

দৈনিক মজুরি ভিত্তিক কাজ বা ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সবই এখন বন্ধ। স্কুল, কলেজ, অফিস বন্ধ থাকায় অনেকের চাকরি থাকলেও বেতন মিলছে না। লকডাউনে পেশা বদল করে, অন্য কিছু একটা করার সুযোগও নেই। ফলে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষজন প্রতিনিয়ত ভর্তুকি মূল্যের খাদ্যপণ্য বিক্রয় কেন্দ্রগুলোতে ভিড় করছে পণ্য কিনতে। 

তবে সেখানেও বিপত্তি, চাহিদার তুলনায় পণ্যের যোগান দিতে পারছে না সরকার।  

ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) ঢাকাসহ সারাদেশেই ৪৫০টি কেন্দ্রে প্রতি লিটার ১০০ টাকা দরে সয়াবিন তেল, ৫৫ টাকা কেজি দরে মসুর ডাল ও চিনি বিক্রি করছে।

ঢাকার কয়েকটি বিক্রয়কেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিদিনই পণ্য কিনতে মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। আগে এসব লাইনে শুধু নিম্ন আয়ের মানুষকেই দেখা যেত। অনেক সময় ক্রেতার অভাবে একজন ডিলার সব পণ্য সারাদিন বসে থেকেও বিক্রি করতে পারতো না। কিন্তু, লাইনে দাড়ানো মানুষের পোশাক-আশাক দেখেই অনেকটা আন্দাজ করা যায় মধ্যবিত্তরাও বিক্রয়কেন্দ্রগুলোর অন্যতম ক্রেতা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিটি বিক্রয়কেন্দ্রেই ২৫০-৩০০ লোকের উপস্থিতি তৈরি হয় মুহুর্তেই। এ কারণে দ্রুত পণ্যের পরিমাণও ফুরিয়ে যাচ্ছে। অনেককে আবার পণ্য ছাড়াই ফিরতে হচ্ছে। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে রামপুরার এক ডিলার মো. স্বপন টিবিএসকে বলেন, "পণ্য শেষ হয়ে যায়, তবু মানুষের লাইন আর শেষ হয় না। অথচ এক সময় পণ্য নিয়ে সারাদিন বসে থাকতে হতো, ক্রেতা পাওয়া যেত না। এখন গাড়ি আসার আগেই মানুষ লাইন দিয়ে দাড়িয়ে থাকে।"

ছবি: টিবিএস

বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিদিন কোন ডিলার কোন পয়েন্টে পণ্য বিক্রি করবে- তা ঠিক করে দেয় টিসিবি। ১০টার মধ্যে নির্দিষ্ট স্থানে পণ্য বিক্রি শুরুর কথা থাকলেও ব্যাংকে টাকা দিয়ে পণ্য তুলে আনতে বেশ সময় লেগে যায়। কিন্তু এখন অনেক স্থানে মানুষ ৯টারও আগে থেকে লাইনে দাড়িয়ে থাকতে শুরু করে। 

মধ্য বাড্ডায় একটি স্থানে একদিন পরপর ট্রাক পাঠায় টিসিবি। কিন্তু, সেখানে প্রায় প্রতিদিনই সকাল থেকে মানুষ লাইন দিয়ে দাড়ায়। 

খিলগাঁও শহাজাহানপুর টিসিবিরি এক বিক্রয়কেন্দ্রে দুই ঘন্টা যাবৎ দাঁড়িয়ে থাকা মোহাম্মদ ইউসুফ হারুন চৌধুরী টিসিবিএসকে বলেন, এক সময় ইস্টার্ন হাউজিংয়ে চাকরি করতাম। চাকরি ছেড়ে ব্যবসা শুরু করেছিলাম। কিন্তু করোনার কারণে ব্যবসা বন্ধ। আমার স্ত্রী খুবই অসুস্থ। আর্থিক অনটনে আছি। তাই এখানে কম দামে নিত্যপণ্য কিনতে এসেছি।  

লাইনের কিছুটা পেছনের দিকে থাকা মো. রনি, একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, নিরাশ হয়ে চলে যাচ্ছিলেন। তখন কথা হয় এ প্রতিবেদকদের সাথে।

তিনি বলেন, আমি প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা দাঁড়িয়ে আছি, আর পারছি না। ইতোমধ্যে অনেকেই দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে চলে গেছেন। আবার লাইনে যে পরিমাণ লোক দেখা যাচ্ছে তাতে আদৌ পণ্য পাব কিনা সন্দেহ আছে। তাই বাড়ি চলে যাচ্ছি। 

খামারবাড়িতে টিসিবির বিক্রয়কেন্দ্রে কথা হয় মো. জাকির হোসেনের সঙ্গে, তিনি একটি বেসরকারি কলেজে পড়াতেন। তিনি বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ, আয় বন্ধ। কোন রকমে জোড়াতালি দিয়ে চলতে হচ্ছে।
  
শাহজাহানপুরের টিসিবির একজন বিক্রয় কর্মী রুবেল বলেন, এখন আমাদের পণ্যের চাপ খুব বেশি। আজ আমাদের আসতে দেরী হয়েছে। কারণ আমদের গোডাউন থেকে পণ্য পেতেও দেরী হয়েছে।

রুবেল বলেন, লকডাউন দেওয়ার পর থেকেই প্রচুর লোক হয়; আমরা সবাইকে পণ্য দিতে পারি না। প্রতিদিনই অনেক লোক পণ্য নিতে না পেরে চেঁচামেচি করে। কিন্তু এটাতো আমাদের হাতে নাই। 

ছবি: টিবিএস

টিসিবি গত ৫ তারিখ থেকে পণ্য বিক্রি শুরু করেছে। ৪৫০টি ট্রাকের মাধ্যমে সারাদেশে বিক্রয় কার্যক্রম পরিচালনা করছে প্রতিষ্ঠানটি। 

ঢাকায় বিক্রয় কেন্দ্রে প্রতিটি ট্রাকে বিক্রির জন্য মোট ২১০০ কেজি তেল,চিনি ও ডাল দেয় টিসিবি। ঢাকার ডিলাররা জানান, ৪০০ কেজি ডাল, এক হাজার লিটার তেল ও ৭০০ কেজি চিনি দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ, একটি বিক্রয়কেন্দ্র থেকে মাত্র দুইশ মানুষ ২ কেজি করে ডাল ও ৫০০ মানুষ ২ লিটার করে তেল ও ৩৫০ জন ২ কেজি করে চিনি কিনতে পারবে। তবে যেখানে ৫ লিটারের তেলের বোতল দেওয়া হয়, সেখানে ২০০ মানুষ তেল কিনতে পারে। 

কিন্তু, টিসিবির গাড়ি থেকে পণ্য বিক্রির সময় থেকে শুরু করে বিক্রি শেষ হওয়া পর্যন্ত মানুষের ভীড় লেগেই থাকে। পণ্য শেষ হয় কিন্তু মানুষের ছোট হয় না। অনেকে পণ্য না পেয়ে মন খারাপ করেও ফিরে যায়। 

এ বিষয়ে টিসিবির মুখপাত্র বলেন, আমরা একেকটি পণ্যের বাজার চাহিদার ১০-১২ শতাংশ পণ্য সরবরাহ করছি। যা একসময় ছিল ১-২ শতাংশ। সক্ষমতার বাইরে চাইলেও রাতারাতি আমরা বিক্রি বাড়াতে পারি না। যদিও, এবার চাহিদার কথা বিবেচনা করে ৫০টি অতিরিক্ত ট্রাক দেওয়া হয়েছে।

জানা গেছে, ঢাকায় ৮০টি ও ঢাকা বিভাগে ১১২টি ট্রাকে করে পণ্য বিক্রি করছে টিসিবি। 

উল্লেখ্য, পিপিআরসি ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বলছে, করোনার কারণে বাংলাদেশে নতুন করে আড়াই কোটি মানুষ নতুন করে দরিদ্রের কবলে পড়েছে।
 
জানতে চাইলে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ এর সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, "লকডা্উন দিলে অনেক মানুষের আয়-উপার্জন বন্ধ হয়ে যায়। ছোট ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, দোকানপাট, দৈনন্দিন মজুরি ভিত্তিক কাজ সবই বন্ধ থাকে। কিন্তু খাওয়া তো বন্ধ রাখা যায় না। তাই এসময় সরকারের খাদ্য নিরাপত্তায় যথেষ্ট বরাদ্দ বাড়ানো উচিত।"

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.