ব্যবসা-বাণিজ্য বাঁচাতে আগে শিক্ষা বাঁচান: সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

বাংলাদেশ

16 June, 2021, 02:15 pm
Last modified: 16 June, 2021, 05:09 pm
কিউএসের বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয় র‌্যাংকিংয়ে ২০২২ এর তালিকায়  বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অবস্থান ৮০১-১০০০তম। কেনো  র‌্যাংকিংয়ের উপর দিকে থাকতে পারছে না দেশের বিশ্ববিদ্যালয়? বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা দিয়ে কী ২০৪১ সালের উন্নত দেশে গড়া সম্ভব? এসব বিষয় নিয়ে দ্য বিজনেস স্টান্ডার্ডের উপ-নির্বাহী সম্পাদক শাখাওয়াত লিটনের সঙ্গে কথা বলেছেন শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম।

শিক্ষাবিষয়ক যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান কোয়াককোয়ারেল সাইমন্ডস (কিউএস) সম্প্রতি বিশ্বের সেরা ১৩০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা প্রকাশ করে। প্রতি বছর মোট ১১টি আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের ভিত্তিতে সারা পৃথিবীর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র‌্যাংকিং প্রকাশ করে কিউএস।

এ সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার দুরবস্থার কথা এবং এখান থেকে উত্তরণে কি কাজ করতে হবে তাও বলেছেন এ শিক্ষাবিদ । শিক্ষায় সর্বোচ্চ বাজেট বরাদ্দ রাখার কথা বলেছেন। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সসহ প্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে খাপ খাইয়ে শিক্ষা ব্যবস্থা তৈরির কথা বলেছেন। জোর দিতে বলেছেন প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নয়নে। 

শাখাওয়াত লিটন: কিউএসের র‌্যাংকিংয়ে ২০১২ সালে যেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ছিল ৬০০'র মধ্যে কিন্তু ২০২২ সালের র‌্যাংকিংয়ে তা নেমে গেছে  ১০০০ এর মধ্যে। যতগুলো বিষয় নিয়ে তারা র‌্যাংকিং করে এর মধ্যে একটি হচ্ছে একাডেমিক রেপুটেশন সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১০০ নম্বরের মধ্যে ১৮ নম্বর পেয়েছে। আমরা জানি পাশ মার্ক ৩৩ সেখান থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কি ফেল করলো? 

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: এটাকে এক ধরনের ফেল করাই বলে। ১০০ এর মধ্যে ৫০ বা ৬০ যদি আমাদের স্কোর হয় তাহলেও তো আমি ধারেকাছেও থাকছি না। আমরা এক সময় ৫০০ থেকে ৬০০'র মধ্যে ছিলাম। এখন পিছিয়ে পড়ছি কারণ আমাদের কোনো উন্নতি নেই। কিন্তু অন্য দেশের  ৫০০ বিশ্ববিদ্যালয় উন্নতি করে ঢুকে পড়েছে ওখানে। এর মধ্যে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ও স্থান করে নিয়েছে। চীনে যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আজকে আমরা দেখছি।  আগামী ২০ বছর পর পশ্চিমা বিশ্বের যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তাদের প্রতিযোগীতা হবে। যেটা এখই শুরু হয়েছে। 

যেমন, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা চলে। তারা এগিয়ে গেছে কিন্তু আমরা ক্রমাগত পিছিয়ে যাচ্ছি। শিক্ষার মান নিয়ে আপনি প্রশ্ন করেছিলেন। আমাদের শিক্ষার মান ক্রমাগত নিচের দিকে যাচ্ছে। এ বিষয়টি খুবই ভাবাচ্ছে। আমরা শিক্ষার কোয়ান্টিটি নিয়ে যতটা আলোচনা করি কোয়ালিটি নিয়ে ততটা আলোচনা করি না। 
আমরা সবাই বলি মান বাড়াতে হবে। জাতীয় ঐকমত্যও রয়েছে এ বিষয়ে। কিন্তু যারা এটিকে কাজের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করবে তাদের মধ্যে সেই সরকার এবং সরকারের নানা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজের প্রতিফলন দেখছি না। যেমন শিক্ষায় বাজেট বরাদ্দ বাড়ানো প্রয়োজন সেটি হচ্ছে না। 

লিটন: আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দেখা যায় একাডেমিক রেপুটেশনের চেয়ে নন রেপুটেশন নিয়ে আলোচনায় থাকে। ভিসিদের নানা দুর্নীতি নিয়ে গণমাধ্যমে প্রচার হয়, আলোচনা হয়। যাদের উপর বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয় তারা যদি এমন অনিয়ম দুর্নীতি নিয়ে থাকে তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেপুটেশন কোথায় দাঁড়ায়?

মনজুরুল: সুনামের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যায়লের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা থেকে আমরা দূরে চলে গেছি। এখানে শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের একার দায়িত্ব নয়, অন্য শিক্ষকদের যে বিশাল পরিবার সেখানেও অনেক ঘাটতি রয়ে গেছে।  

ষাটের দশকে আমাদের কয়টি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল? তখন জাতীয় রাজনীতি হতো কিন্তু কখনও কাজ ফাঁকি দিয়ে, গবেষণায় ফাঁকি দিয়ে শিক্ষকরা রাজনীতি করতো না। তারা করতো প্রাণের দায়ে বিবেকের দায়ে। এটিই হওয়া উচিত। পশ্চিমা বিশ্বের বহু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এই ধরনের কাজ করে থাকেন। 

শিক্ষক রাজনীতি ৮০ দশক পর্যন্ত দলীয় রাজনীতি থেকে মুক্ত ছিল। আমরা সংগ্রাম করেছি স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে, গণতন্ত্রের পক্ষে, মত প্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে। যেখানে সাংবাদিক, সংস্কৃতি কর্মীদের আমরা পাশে পেয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয় ছিল আস্থার জায়গা। পথ দেখানোর জন্যই বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি।

শিক্ষক যখন দলীয় রাজনীতির খাতায় নাম লেখালো সেদিন থেকে আমার মনে হয়েছে আমরা আসলে তখন থেকেই পেছনে যাচ্ছি। 

লিটন: শিক্ষকরা এখন কতোটা পথ দেখাতে পারছেন? 

মনজুরুল: না, তারা পথ দেখাতে পারছেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ বিসিএস এর জন্য উদগ্রিব হয়ে থাকে। আমি তাদের দোষ দিচ্ছি না। বিসিএস পরীক্ষা মনে হয় একমাত্র পরীক্ষা যেখানে মামার জোর লাগে না, নিজের মেধা খাটিয়ে চাকরি পেতে পারে। এজন্যই এঠহ আকর্ষণীয়। বিশ্ববিদ্যালয়তো বিসিএস চাকরিজীবী তৈরি করবে না। বিশ্ববিদ্যালয় মেধাবী বিজ্ঞানী তৈরি করবে, তৈরি করবে সমাজ সেবক। মানবিকতা এবং দর্শন নিয়ে ভাববেন সেরকম দার্শনিক এবং মানবিক মানুষ তৈরি করবে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন সেটি হচ্ছে না। কারণ আমরা পথ দেখাতে পারছি না। 

লিটন: তাহলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় শুধু কি নামেই বিশ্ববিদ্যালয়? আপনার কথায় যা বোঝা যাচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয় হতে গেলে যে জ্ঞান চর্চার কেন্দ্র হতে হয় সেই জায়গা থেকে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। এখানে কি আমরা বিশ্ববিদ্যালয়কেই দায়ী করবো? বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার আগে শিক্ষার্থীরা যে তিনটি ধাপ পাড় করে আসে সেখানে যদি শিক্ষার মানের ঘাটতি থাকে তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যয়ে এসে তা পুষিয়ে নেওয়া কতটুকু সম্ভব? 

মনজুরুল: আমি ঢালাওভাবে সব বিশ্ববিদ্যালয়কে অপবাদ দিচ্ছি না। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় আছে যেগুলো চেষ্টা করে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের চেষ্টার কোনো কমতি নেই। বহু গবেষক আছেন, শিক্ষক আছেন তাদের সংঘবদ্ধ করার প্রয়াস দেখি না। তাদের প্রণোদনা দেওয়ার জন্য কিছুই রাখে না। গবেষণায় যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয় তা খুবই অপ্রতুল । দিন শেষে গবেষণা কিছুই হয় না। 

সুতোয় বাঁধা শিক্ষাজীবন। প্রাক প্রাথমিক শিক্ষা থেকে একজন শিক্ষার্থীর পথচলা শুরু। জীবন গঠন শুরু হয় প্রাথমিকে। সে সাংস্কৃতিক পাঠ গ্রহন করে, মানবিকতার পাঠ গ্রহণ করেন।  নীতি-নৈতিকতা এবং নান্দনিকতার পাঠও গ্রহন করে। প্রাথমিক পর্যায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। 

প্রাথমিকের পর আছে মাধ্যমিক। মাধ্যমিক হচ্ছে এক ধরনের পৃথিবীর জন্য প্রস্তুতি। তারপর যখন একজন শিক্ষার্থী মান অর্জন করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখেন তখন বিশ্ববিদ্যালয় স্বয়ংক্রিয়ভাবে তার জন্য সব দরজা খুলে দেয় এবং সেই দরজা দিয়ে পৃথিবীর সব জায়গায় পৌঁছায়। এটি হলো আদর্শিক চিত্র। 

কিন্তু আমরা মাধ্যমিক পর্যায়ে মানসম্পন্ন শিক্ষা দিতে পারছি না। একজন বিজ্ঞানী বললেন, গণিতের যে জ্ঞান নিয়ে একজন এসএসসি পাশ করছে সে জ্ঞানও সপ্তম শ্রেণীর। যে ভাষা দক্ষতা নিয়ে এসএসসি পাশ করছে সেটি ৬ষ্ঠ থেকে সপ্তম শ্রেণির মানের। এ থেকে বোঝা যায় আমরা শ্রেণি অনুযায়ী শিক্ষা দিতে পারছি না।

কীভাবে হবে? আমাদের প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকদের বেতন ভাতা এতই অপ্রতুল যে এখানে খুব ভালো মানের শিক্ষক আকৃষ্ট হচ্ছেন না। 

লিটন: প্রাথমিক শিক্ষা কি সব চেয়ে বেশি অবহেলিত ?

মনজুরুল: টাকা বরাদ্দই আসল কথা না। যারা পড়াবেন সেই শিক্ষকের মান বাড়াতে হবে। আমার একটি স্বপ্ন ছিল প্রাইমারিতে যারা পড়াবেন তারা বর্তমান বাজারমূল্য অনুযায়ী ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা বেতন পাবেন। যদি ৬০ থেকে ৭০ হাজার বেতন দেওয়া হতো তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব চেয়ে মেধাবী সেখানে আকৃষ্ট হতো। ভালো শিক্ষক ছাড়া ভালো শিক্ষার্থী তৈরি হয় না। 

লিটন: গবেষণায় এসেছে দেশের অর্থনীতির উন্নয়নে শিক্ষায় বরাদ্দ বাড়াতে হবে, শিক্ষকদের সম্মান দিতে হবে। আপনি কিভাবে দেখছেন?

মনজুরুল: বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে নজর না দিয়ে আমাদের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে বেশি নজর দিতে হবে। শিক্ষা নীতিতে আছে  প্রাথমিক পর্যায়ে থাকবে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। শেষ পর্যায়ে সেখানে একটি পরীক্ষা হতে পারে। পঞ্চম শ্রেণির শেষে একটি পরীক্ষা অষ্টম শ্রেণির শেষে একটি পরীক্ষা। এত নির্মমভাবে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার চাপে ফেলে দেওয়া হয় যে শিক্ষায় কোনো আনন্দ নেই। এমন নিরানন্দ শিক্ষা আমি কোনো দেশে দেখিনি। 

শিক্ষার প্রতি সম্মান প্রয়োজন। শিক্ষার প্রতি সম্মান দেওয়ার জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকতে হবে। সেই সদিচ্ছাটা হলো শিক্ষাকে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকারের জায়গায় দেওয়া। কিউবাতে জিডিপির ৯.৫ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয় শিক্ষায়। ভিয়েতনামে ৬ থেকে ৭ শতাংশ দেয়া হয়। অর্থাৎ তারা রাজনৈতিকভাবে সদিচ্ছা পোষণ করছে। এই সদিচ্ছাই  আমাদের নেই। প্রথমে শিক্ষায় বরাদ্দ বাড়াতে হবে এরপর বরাদ্দের সঠিক ব্যবস্থাপনা করতে হবে। আর্থিক ব্যবস্থাপনা এবং অন্যান্য ব্যবস্থাপনা।

যেমন শিক্ষক নিয়োগের বিষয় সবচেয়ে মেধাবীদেরকে নিয়োগ দেওয়া। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা রাখা। এমন ব্যবস্থা করে যদি আমি বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে পারি তাহলে আমরা তৃতীয় পর্যায়ে যাবো।

তৃতীয় পর্যায়ে আমাদের পাঠ্যক্রমকে আধুনিক করতে হবে সাথে সাথে পরীক্ষার পদ্ধতিকেও যুগপোযোগী করতে হবে। মূল্যায়নের বিকল্প পদ্ধতি উদ্ভাবন করতে হব। শিক্ষার্থীদের আনন্দ দিয়ে তাদের জগৎ সংসারের প্রতি ও প্রকৃতির প্রতি দায়বদ্ধ করতে হবে। 

এমন পরিকল্পনা গ্রহণ করার মানসিকতা তৈরি হয়নি। শিক্ষকদের যে পরিমাণ সম্মান দেওয়া প্রয়োজন সেটি দেখছি না। 

ব্যবসায়ীদের প্রতি সম্মান রেখেই বলছি, এ বাজেট অত্যন্ত ব্যবসা বান্ধব বাজেট। আমরা কি সারা জীবনই ব্যবসা করবো? যখন চতুর্থ শিল্প বিপ্লব এসে যাবে আমরা যদি প্রস্তুত না থাকি যেখা যাবে গার্মেন্টস ব্যবসা ধুলিস্যাৎ হয়ে যাচ্ছে। কারণ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স চীনে তৈরি হচ্ছে। ১০০ শ্রমিকের কাজ এই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স করবে। সব সেলাইয়ের কাজ করা হবে কম্পিউটারের মাধ্যমে। যেখানে শ্রমিকের প্রয়োজন হবে না। 

লিটন: তাহলে ব্যবসায়ের স্বার্থেই কি শিক্ষায় গুরুত্ব প্রয়োজন? 

মনজুরুল:  ভারত, শ্রীলংকা থেকে সুপার ম্যানেজার বাংলাদেশে আসে। তারা ছয় বিলিয়ন ডলার নিয়ে যায়। আমাদের প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স আবার বিদেশে চলে যাচ্ছে। যেই শিক্ষা ব্যবস্থা সুপার ম্যানেজার তৈরি করবে সেই শিক্ষাব্যবস্থা আমরা কেনো করতে পারিনি। ওই ছয় বিলিয়ন ডলার দেশে রেখে যদি আমরা শিক্ষার বিনিয়োগ করতাম। 

চীন, সিঙ্গাপুর, শ্রীলংকা, নেপাল প্রতিটি দেশ তাদের নতুন দর্শন উপহার দিচ্ছে। আমাদেরও দেয়া উচিত। বাজেট আসলেই ব্যবসায়ীরা হাততালি দেয়। কিন্তু আমি কখনও দেখেনি প্রাথমিক শিক্ষকরা হাততালি দিয়েছেন। শিক্ষকদের বাজেট থেকে বাইরে রাখা হয়।

এখন অনলাইনে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে , কিন্তু ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থীদের না আছে অ্যানড্রয়েড ফোন না আছে ল্যাপটপ। এখানে ডিজিটাল বৈষম্য তৈরি হয়েছে। 

আমি একটা দাবি তুলেছিলাম এই ৭০ ভাগ শিক্ষার্থীর একটি ডাটাবেজ তৈরি করুন। যাদের প্রয়োজন তাদের বিনামূল্যে ইন্টারন্টে সংযোগসহ ল্যাপটপ দিন। তাদের অ্যাপস তৈরি করে দেন। যেটিকে শিক্ষা অ্যাপ বলে। তাহলে সেই শিক্ষার্থীরা আনন্দের সঙ্গে লেখাপড়া করে পৃথিবীটাকে আবিষ্কার করবে। কিন্তু  এটি বিবেচনায় আনা হয়নি। এবারের বাজেটেও তাদের কথা মনে রাখা হয়নি। তাহলে এই বৈষম্য নিয়ে আমরা কতদূর যাব।

লিটন: দুদক, নির্বাচন কমিশনসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের যে দায়িত্ব পালন করার কথা সেটি যখন করতে পারে না, তাদের ভেতর যখন অনেক দুর্বলতা আছে সেখানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কীভাবে ভালো করবে? 

মনজুরুল: মানুষের প্রতিটি অঙ্গের যদি শক্তি না থাকে তাহলে মানুষ দুর্বল হয়ে যাবে। ঠিক সেভাবে আমাদের দেশে প্রতিটি প্রাতিষ্ঠানিক অঙ্গের শক্তি দিতে হবে। না হলে আমরা বিকলঙ্গ জাতিতে পরিণত হবো। আমি টিআইবিতে অনেকদিন ছিলাম ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য হিসেবে। এখনও আছি ন্যায়পাল হিসেবে। দেখছি টিআইবি যখনই একটি প্রতিবেদন তৈরি করে, জাতীয় সংসদ থেকে সবাই এটির নিন্দা করে। আমরা বিদেশি পয়সা নিয়ে এটি করছি, দেশের বিরুদ্ধে দাড়িয়েছি- এসব বলা হয়। কিন্তু আমরা যে দুর্নীতির বিষয় তুলে ধরছি সেটিতো সরকারের পক্ষেই যাওয়ার কথা। সে কথা বলা হয় না। বাংলাদেশে দুর্নীতি এভাবেই প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শক্তিশালী হয়ে গেছে।

লিটন: শিক্ষা ব্যবস্থার ভেতর দুর্নীতি সহনশীল পরিবেশে যারা বড় হয়ে আসছে তাদের কাছ থেকে কী আশা করা যায়?

মনজুরুল: রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ-  প্রশাসন, জাতীয় সংসদ ও আদালত। নিম্ন আদালতের চিত্র খুব আশাহত করে। সেখানে মানুষ সুবিচার পায় না। দিনের পর দিন মামলার জট লেগেই থাকে। বিচার ব্যবস্থার ওই একটি জায়গা আস্থার জায়গা। প্রশাসনকে মানুষ বিশ্বাস করে না। 

রাষ্ট্রের প্রধান তিনটি অঙ্গ যদি সক্রিয় না দেখাতে পারে বাকি প্রতিষ্ঠানগুলো কিভাবে সক্রিয় হয়ে দেখাবে? সে জন্য সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি  ২০২৪ সালে যে নির্বাচন হবে সেই নির্বাচন যেন সুষ্ঠু হয়। সেই নির্বাচনের পরে যে সরকার আসবে তারা যেন সব শক্তি নিয়ে শিক্ষার উন্নয়নে লেগে পরে। যদি বর্তমান সরকার ক্ষমতায় থেকে যায় বুঝতে হবে তাদেরকে ওই পরিবর্তন না করলে ২০৪১ সালে উন্নত দেশ তো দূরের কথা তার ধারে কাছেও পৌঁছাতে পারবো না। 

লিটন: বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা দিয়ে ২০৪১ সালে উন্নত দেশের স্বপ্ন দেখা কতটা যৌক্তিক? 

মনজুরুল: আমি এর যৌক্তিকতা দেখি না। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় র‌্যাংকিংয়ে কেন এত পেছনে থাকে? তার কারণ হলো বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকটি বিষয় বিবেচনা করা হয় তার মধ্যে শিক্ষা ও গবেষণাকে প্রথমে গুরুত্ব দেওয়া হয়। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা কিভাবে আন্তর্জাতিকভাবে প্রভাব বিস্তার করছে, বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য কিনা, বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক যোগাযোগ আছে কিনা, বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে নিজের দেশের অর্থনৈতিক সংযোগ আছে কিনা এগুলোও বিবেচনা করা হয়। 

ব্যবসায়ীদের ভবিষ্যতের জন্য বলতে চাই, আপনরা যদি শিক্ষায় বিনিয়োগ না করেন তবে ব্যবসা বাণিজ্যে ৫ থেকে ১০ বছরের মধ্যে ধস নামবে। কারণ আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স চলে এসেছে। আমাদের শ্রমিকগণ সবগুলো কারখানা কাজ অন্য দেশে নিয়ে নিবে। দেখা যাবে পাঁচ হাজার শ্রমিকের কাজ করবে ৫টি কম্পিউটার । তখন আমরা কীভাবে টিকে থাকবো? আমাদেরও সেভাবে অগ্রসর হতে হবে। আর সেই কাজটা করবে বিজ্ঞানীরা। 

সব সময় বাইরে থেকে প্রযুক্তি এনে কাজ করতে পারবো না আমরা। আমাদের সমস্যা হবে। আগামীতে হ্যাকিং অনেক বাড়বে। এখনই যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিটি প্রতিষ্ঠান হ্যাকিংয়ের ঝুঁকিতে আছে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশ হ্যাকিংকে প্রতিহত করতে পারছে না। আমদের একবার বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা হ্যাকিং করে নিয়ে গেছে কিন্তু এ বিষয়ে আমাদের ভালো প্রস্তুতি নেই। তাদের প্রতিহত কারা করবে? সেই ডিভাইস কি আছে আমাদের রয়েছে?

পদ্মাসেতু হচ্ছে আমরা বেশ আনন্দ পাচ্ছি কিন্তু আমাদের নিজেদের বিজ্ঞানীদের দিয়ে যদি এ কাজটি করাতে পারতাম আমাদের আরও বেশি খুশি লাগতো। নিজের দেশে বিজ্ঞানী তৈরির কোন বিকল্প নেই। তাই গবেষণার মান বাড়াতে হবে। সাথে সাথে শিক্ষায় বরাদ্দও বাড়াতে হবে। বিদেশি ভাষা শিক্ষায়ও জোর দিতে হবে। 

সরকারের প্রতি আবেদন থাকবে প্রাথমিক শিক্ষকদের জন্য আলাদা পে-স্কেল করুন। তাদের বেতন ভাতা বাড়িয়ে দিন। এখানে কয়েক বিলিয়ন ডলার ব্যয় করলে আমরা এক প্রজন্মের ভেতর দৃশ্যপট পরিবর্তন করে দিতে পারবো।

লিটন: শিক্ষায় অগ্রগতিতে আমাদের আশার বিষয় কোনটি? 

মনজুরুল: আমি অনেক আশার বিষয় দেখছি। কারণ শিক্ষাকে প্রতিটি পরিবার অগ্রাধিকার দিচ্ছে, এটি আশার কথা। নারী শিক্ষায় যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে সেটিও সর্বমহলে প্রশংসিত।

দ্বিতীয় হচ্ছে তরুণরা তৈরি হচ্ছে। তারা প্রস্তুত, অনেক শিক্ষকও প্রস্তুত। প্রাথমিক শিক্ষক তারা অনেকেই প্রস্তুত। একটু যদি জীবনমান উন্নয়ন করা হয় তাদের, তাহলে বন্ধু-বান্ধব নিয়ে দেশের  শিক্ষার উন্নয়নে ঝাঁপিয়ে পড়বে তারা। 

আর একটি বিষয় হলো সাম্প্রদায়িক বিভেদ নেই আমাদের। অনেকগুলো দেশ থেকে আমরা এখানে নিরাপদ আছি। আমাদের সংস্কৃতিতে ধর্ম খুব গুরুত্বপূর্ণ। ধর্ম মঙ্গলের বিষয়। ধর্মের মঙ্গলময় বিষয় মানুষ গ্রহণ করছেন। ধর্মের নামে একটি মহল  অপসংস্কৃতি তৈরি করছে, তাদের মানুষ প্রত্যাখান করছে। এখানেও আমি গর্বিত।

এখন তরুণরা অনেক কিছু জানে। অনেক তরুণ নিজেদের প্রচেষ্টায় বিদেশে লেখাপড়া করতে যাচ্ছে। তারা যখন দেখবে তাদের জন্য বাংলাদেশের কাজ করার ভাল সুযোগ আছে, তখন এই মেধাবীরা বাংলাদেশে চলে আসবে। কাজেই বুদ্ধির কোনো অভাব নেই। শুধু যদি প্রতিবন্ধকতার জায়গাগুলো আমরা সরিয়ে দিতে পারি, সক্ষমতার যায়গাটা তৈরি করতে পারি তাহলেই এই দেশ লাফ দিয়ে এগুবে। আমি মনে করি, এ দেশের উন্নয়নের জন্য তরুণরা ভাবে। যদি সরকার তাদের সহায়তা করে, দেশের উন্নয়নে একটি বিপ্লব তারা ঘটাতে পারবে। 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.