বুটিকস ব্যবসায়ী জয়িতা পলির সাফল্যকথা

বাংলাদেশ

16 January, 2021, 10:55 am
Last modified: 16 January, 2021, 11:06 am
"আমি অনেক হিজড়া জনগোষ্ঠীর মানুষকে সম্মানজন কাজের ব্যবস্থা করেছি। তারপও শুরুতে লিঙ্গ পরিচয়ের কারণে অনেক সমস্যা মোকাবেলা করতে হয়েছে আমাকে। এখনও করছি। আমি শুধুমাত্র হিজড়া জনগোষ্ঠীর একজন হওয়ার কারণে আমাকে ব্যাংক লোন দেওয়া হয়নি।"

ছোটবেলা থেকেই আঁকাআঁকির সখ। স্কুলে ড্রয়িংয়ে খুব ভালো ছিলেন। কিন্তু ড্রয়িংয়ের ওপর উচ্চতর পাঠ নেওয়া সম্ভব হয়নি। কিন্তু তাতে থেমে যাননি, আঁকাআঁকির জন্য কাগজের পরিবর্তে বেছে নিয়েছেন থ্রি-পিস কাপড় ও শাড়ি। এই আকিঁয়ে হলেন জয়িতা পলি। নিজের ফ্যাশন হাউজের থ্রি-পিস ও শাড়িতে তিনি নিজেই ডিজাইন করেন। শুধু ডিজাইন না, সেই ডিজাইনের ওপর অ্যাক্রেলিক ও বুটিকসের কাজও করেন তিনি। 

এখন অবশ্য ব্যবসা বড় হয়ে যাওয়াতে বুটিকসের কাজ কমিয়ে দিয়েছেন। জয়িতার অধীনে কাজ করছে চারশ'র উপরে হিজড়া জনগোষ্ঠী ও প্রান্তিক নারীরা। জয়িতা নিজেও হিজড়া জনগোষ্ঠীর একজন এবং তিনি একজন উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী। স্থানীয় নারীদের অ্যাপ্লিকস ও বুটিকসের ওপর প্রশিক্ষণও দেন তিনি।

রাজশাহী মহানগরীর মোল্লাপাড়া এলাকায় নিজ বাড়িতেই তিনি গড়ে তুলেছেন তার 'ডি এ ফ্যাশন হাউজ'। এই ফ্যাশন হাউজ সার্বক্ষণিক ২০ জন লোক কাজ করেন। যার মধ্যে ১০ জনই হিজড়া জনগোষ্ঠীর। বাবা-মাকেও নিজের কাছেই রেখেছেন জয়িতা। 

জয়িতা পলির শুরুটা ২০১৪ সালে মাত্র ৮টা হাজার টাকা নিয়ে। তার এই ফ্যাশন হাউজের ওপর অনেক পরিবার নির্ভরশীল। তার ফ্যাশন হাউজ থেকে বিভিন্ন ধরনের হাতের তৈরি শাড়ী, থ্রি-পিস, বেড সীট ও কুশন কভার তৈরি করে বিক্রি করা হয়। তার ফ্যাশন হাউজ থেকে তৈরিকৃত এসব পণ্য ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্নস্থানে বিক্রি হয়।

জয়িতা পলি জানান, "ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকেই অল্প অল্প করে ডিজাইন করতাম। এসএসসিতে পড়াকালীন সময়েই হিজড়া কমিউনিটি রাইটস নিয়ে কাজ শুরু করি। যে প্রকল্পের সঙ্গে কাজ করতাম তা ২০১২ সালে শেষ হয়ে যায়। এইচএসসি পাশের পর মাত্র ৮ হাজার টাকা নিয়ে স্বল্প পরিসরে বুটিকসের কাজ শুরু করি। বাজার থেকে কাপড় কিনে নিয়ে এসে নিজেই ডিজাইন করে অ্যাপ্লিক ও বুটিকসের কাজ করে তা স্থানীয় বাজারে বিক্রি শুরু করি। স্থানীয় লোকজনের মধ্যেও দু'একজন করে কিনতে শুরু করে। তবে আমি হিজড়া জনগোষ্ঠীর একজন হওয়ায় প্রথমে লোকজন কিনতে চাইতো না।" 

ডিজাইন এবং বুটিকস ও অ্যাপ্লিকসের কাজ ভালো হওয়ায় ধীরে ধীরে ক্রেতা বাড়তে থাকে জয়িতার। শুরুতে শাড়ির ওপরই বেশি কাজ করা হতো। যশোরের এক ক্রেতার মাধ্যমে কলকাতাতেও বিক্রি হতো আমার ডিজাইনের শাড়ি। তিনি মারা যাওয়ার পর তা বন্ধ হয়ে যায়। 

এখন বেশিরভাগ থ্রি-পিস তৈরি হয় তার ফ্যাশন হাউজ থেকেই। ব্যবসা বেড়েছে। প্রতি মাসে ৭০০ পিস থ্রি-পিস ও ৫০ পিস শাড়ি তৈরি হয় তার ফ্যাশন হাউজ থেকে। তার কাছ থেকে চট্টগ্রাম, সিলেট ও ঢাকায় পণ্য কিনে নিয়ে সেখানে বিক্রি হয় বলে জানান তিনি।

"সিলেটের এক পাটি আমার কাছ থেকে পণ্য কিনে নিয়ে সরাসরি লন্ডনে পাঠায়।" 

জয়িতা পলি জানান, তার হাউজ থেকে তৈরি এক একটি থ্রি-পিস বিক্রি হয় ২৫০০ থেকে ৩০০০ টাকায়। ওয়ান পিস বিক্রি হয় ৭০০ থেকে ১১০০ টাকায়। টু-পিস বিক্রি হয় ১৫০০ থেকে ২২০০ টাকায় এবং শাড়ি বিক্রি হয় ২৫০০ থেকে ৩৫০০ টাকায়। খরচ বাদে গড়ে প্রতিমাসে তার দেড় লাখ টাকার মতো আয় হয়। 

তিনি বলেন, "আমি অনেক হিজড়া জনগোষ্ঠীর মানুষকে সম্মানজন কাজের ব্যবস্থা করেছি। তারপও শুরুতে লিঙ্গ পরিচয়ের কারণে অনেক সমস্যা মোকাবেলা করতে হয়েছে আমাকে। এখনও করছি। আমি শুধুমাত্র হিজড়া জনগোষ্ঠীর একজন হওয়ার কারণে আমাকে ব্যাংক লোন দেওয়া হয়নি।"

অথচ বড় পরিসরে ব্যবসা পরিচালনার জন্য তার ব্যাংক ঋণ প্রয়োজন, জানান পলি।

পলির কাজের স্বীকৃতির জন্য রাজশাহী জেলা প্রশাসন তাকে ২০১৭ সালে শ্রেষ্ঠ জয়িতা নির্বাচিত করে। এছাড়া এসএমই আঞ্চলিক পণ্য মেলা (২০২০) এ দ্বিতীয় নারী উদ্যোক্তার পুরস্কার পান তিনি। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন তাকে ২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর করোনাকালীন মানবিক যোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

জয়িতা পলির প্রতিষ্ঠানে চার বছর ধরে কাজ করছেন হিজড়া জনগোষ্ঠীর রুবিনা। রাজশাহীর পুলিশ লাইন স্কুল অ্যান্ড কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী তিনি। এখানে তিনি কাপড়ে ডিজাইন করা, প্রিন্ট করা, সেলাই, চুমকি ও পাথর বসানোসহ সব ধরনের কাজ করেন।

তিনি বলেন, "এখানে এসে কাজ শুরুর পর আমার নিজের খরচ আমি নিজেই চালাতে পারি। মাসে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা আয় হয়।"

জয়িতা পলির কাছ থেকে কাজের অর্ডার নিয়ে বাসায় নিয়ে গিয়ে অ্যাপ্লিকস ও বুটিকসের কাজ করেন নগরীর হড়গ্রাম শেখপাড়া এলাকার আজমিরা বেগম। তিনি বলেন, "দুই বছর ধরে তার কাছ থেকে থ্রি-পিস ও শাড়ি নিয়ে তাতে পাথর ও চুমকি বসানোর কাজ করে দেই। এইজন্য একটা থ্রি-পিস বাবদ ৩৫০ টাকা ও একটি শাড়ি বাবদ ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা পাই। তার সাথে দুই বছর ধরে কাজ করলেও এখন লেনদেন নিয়ে কোনো সমস্যা হয়নি। কাজ শেষে পাওনা টাকা পরিশোধ করে দেন তিনি।"

 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.