বিএনপি নেতারা ভ্যাকসিন নিচ্ছেন, হাইকমান্ড এখনো সিদ্ধান্তহীন

বাংলাদেশ

22 February, 2021, 02:35 pm
Last modified: 22 February, 2021, 02:36 pm
'আমরা এখনো পর্যবেক্ষণ পর্যায়ে আছি। ইতোমধ্যে এ ব্যাপারে আমাদের প্রতিক্রিয়াও জানিয়েছি।'

করোনা আক্রান্ত হয়ে দুই মাস চিকিৎসাধীন ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান। সুস্থ হওয়ার পর প্রথম ধাপেই অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন নিয়েছেন তিনি। 

ডায়াবেটিস-সহ নানা বার্ধক্যজনিত জটিলতা আছে এই প্রবীণ রাজনীতিবিদের। তবে ভ্যাকসিন নেওয়ার পর সুস্থ আছেন বলে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছেন তিনি। 

দুই সপ্তাহে ২০ লাখেরও বেশি মানুষ ভ্যাকসিন নিলেও বিএনপি নেতা-কর্মীরা অনেকটাই বিভ্রান্ত। শুরুর দিক থেকে ভ্যাকসিন নিয়ে দলের শীর্ষ নেতাদের মুখে নানা সমালোচনা আসায় নেতা-কর্মীরাও সেসব সমালোচনায় মেতেছিলেন। তবে দলটির নানা সূত্র বলছে, দেশের অন্যতম বৃহত্তম রাজনৈতিক দলটির নেতা-কর্মীরা দেশের বিভিন্নপ্রান্তে বিক্ষিপ্তভাবে ভ্যাকসিন নিচ্ছেন।

তবে এ ব্যাপরে এখনো দোলাচলে দলটির হাইকমান্ড। নেতা-কর্মীদের জন্য নেই স্পষ্ট কোনো নির্দেশনা। শীর্ষ নেতারা বলছেন, দলীয় নেতাকর্মীদের ভ্যাকসিন নিতে নিষেধ করা হয়নি। নিজেদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে অনেক নিচ্ছেন। 

জানতে চাইলে বিষয়টি নিয়ে এখনো পর্যবেক্ষণ চলছে বলে জানিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এবং দলের পক্ষ থেকে গঠিত জাতীয় করোনা পর্যবেক্ষণ সেলের উপদেষ্টা খন্দকার মোশাররফ হোসেন। 

তিনি বলেন, 'আমরা এখনো পর্যবেক্ষণ পর্যায়ে আছি। ইতোমধ্যে এ ব্যাপারে আমাদের প্রতিক্রিয়াও জানিয়েছি। একটা সোর্স থেকে করোনার টিকা নিয়ে আসা হচ্ছে, এটা সঠিক নয়।'

তবে বিএনপি দলীয়ভাবে ভ্যাকসিন নেওয়া কিংবা না নেওয়ার কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিচ্ছে না। এটা যার যার ব্যক্তিগত বিষয়। অবস্থা বুঝে তিনি নিজেও ভ্যাকসিন নেওয়ার চিন্তা করবেন- এমন কথা জানিয়েছিন বিএনপির সিনিয়র এই নেতা। 

এদিকে সোমবার রাজধানীর শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ভ্যাকসিন নেওয়ার কথা বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান খন্দকার মাহবুব হোসেনের। রোববার তিনি বলেন, 'আমি নিবন্ধন করেছি, নিজের নিরাপত্তার জন্যই ভ্যাকসিন নেব।' 

'সবকিছুর মধ্যে রাজনীতি টেনে না আনাই ভালো' উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'ভ্যাকসিনটি কান্ট্রি অব অরিজিন থেকে না কেনায় জনমনে প্রশ্ন তৈরি হয়েছিল। এখন সেটা কমে এসেছে।'

নেতা-কর্মীদের ভ্যাকসিন নিতে উদ্বুদ্ধ করবেন কি না- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, 'না, তা বলব না। এটা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ব্যাপার। শেখ হাসিনা নিজেও (ভ্যাকসিন) নেন নাই।' এখানে দলগত সিদ্ধান্তের কোনো ব্যাপার দেখছেন না তিনি।

তবে জনসম্পৃক্ততার বিষয়টি মাথার রেখে সবদলের অংশগ্রহণ প্রয়োজন ছিল বলে মনে করেন বিএনপির ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক ও দলটির জাতীয় করোনা পর্যবেক্ষণ সেলের সদস্য ইকবাল হোসেন শ্যামল। 

তিনি বলেন, 'আমাদেরকে ডাকা হলে আমরা সহযোগিতার জন্য প্রস্তুত ছিলাম। কিন্তু সরকার সেটা করেনি। তাছাড়া ভ্যাকসিনটি পাশের দেশে (ভারত) তৈরি হওয়ায় জনমনে প্রশ্ন আছে।' বিষয়টি তাদের সংগঠনকে ভাবাচ্ছে বলে জানান তিনি।  

এদিকে দলীয় এক প্রতিক্রিয়ায় বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী জানিয়েছিলেন, 'পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানরা যেভাবে টিকার প্রথম ডোজ নিয়ে মানুষকে ভরসা দিচ্ছেন, আশ্বস্ত করছেন, আপনারাও (রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী) সেই পথ অনুসরণ করুন।'

২২ জানুয়ারির ওই প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি নেতা রিজভী ভারতের পাঠানো ভ্যাকসিনটি অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার তৈরি নাকি ভারত বায়োটেকের উদ্ভাবিত টিকা, এ নিয়েও জনমনে সন্দেহ-সংশয় রয়েছে বলেও মন্তব্য করেছিলেন।

সরকার প্রধানের মাধ্যমে ভ্যাকসিন উদ্বোধনের বিএনপির সেই পরামর্শে কোনো সাড়া দেয়নি সরকার। উল্টো রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ভ্যাকসিন বিষয়ে বিএনপির অবস্থানের সমালোচনা চলছে। 

এ বিষয়ে ২৬ জানুয়ারির এক সংবাদ সম্মেলনে করোনা টিকার মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে বিভ্রান্তি না ছড়াতে বিএনপির প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপিকে গঠনমূলক সমালোচনার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেছিলেন, 'অতীতের মতো টিকা নিয়েও বিএনপির মিথ্যাচার জনগণ আমলে নেবে না। প্রধানমন্ত্রীর ওপর আস্থা রাখুন। অপপ্রচার ও সংশয়বাদীদের প্রত্যাখ্যান করুন।'

তবে বেশ আগে-ভাগেই ভ্যাকসিন নিতে পারায় সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। তিনি টিবিএসকে বলেন, 'এ কাজে আরও রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা থাকা দরকার ছিল। অনেক বেশি আমলাতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত হচ্ছে। যার কারণে জনগণ প্রথমে আগ্রহ পায়নি।'

এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় ওয়ার্ড কাউন্সিলর কিংবা ইউনিয়ন পরিষদ প্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করা দরকার। এখনো উচ্চবিত্তরাই ভ্যাকসিন নিচ্ছে। কিন্তু কম অবস্থাসম্পন্ন লোক কিংবা বাড়ির গৃহকর্মীর জন্যও ভ্যাকসিন প্রয়োজন- সেটা বুঝতে হবে। 

বিএনপি নেতদের ভ্যাকসিন প্রতিক্রিয়া

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী ১৩ ফেব্রুয়ারি স্বপরিবারে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে টিকা নিয়েছেন। 

টিকা নেওয়ার দিন সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'টিকা সবার। টিকা নিয়ে কোনো রাজনীতি নেই। তবে সরকার সরাসরি টিকা কিনতে পারত। তা না করে দ্বিতীয় পক্ষের মাধ্যমে টিকা কিনে জনগণের করের টাকা অপচয় করেছে।'

একই দিন টিকা নিয়েছেন চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক এস এম সাইফুল আলম। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, 'টিকা নেওয়ার পর আমি সুস্থ আছি। কোনো পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নাই।'

টিকা নিয়ে বিএনপির অবস্থানের কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় নেতারা জানাবেন।'

চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক ডা. শাহাদাত হোসেন অবশ্য আগে-ভাগেই (১১ ফেব্রুয়ারি) চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে টিকা নিয়েছেন।

চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সাবেক সহ-দপ্তর সম্পাদক ইদ্রিস আলী বলেন, 'টিকা না নেওয়ার কোনো নির্দেশনা নেই। নেতা-কর্মীরা টিকা নিচ্ছেন।'

বরিশাল সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মো. মজিরুব রহমান সারোয়ার বলেন, 'ভ্যাকসিনের ব্যাপারে আমরা ইতিবাচক এবং শিগগিরই এটি নেওয়ার কথা ভাবছি। আমি ইতোমধ্যেই আমার কয়েকজন রাজনৈতিক সহকর্মীর সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলেছি, তারাও ভ্যাকসিন নিতে আগ্রহী।'

বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক ও রাজশাহী মহানগর বিএনপির সভাপতি মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল বলেন, 'যখন দেশের সব মানুষ টিকার আওতায় আসবে, কেবলমাত্র তখনই আমি ও আমার পরিবার টিকা নেব।'

'মহামারির মতো দুর্যোগ রোধে সরকারকে যেভাবে কাজ করতে হয়, তাতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। এমনকি সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে তো কেউ জনসম্মুখে টিকা নেয় না। ফলে তাদের ওপর জনগণের কোনো আস্থা নেই,' বলেন তিনি।

'কয়েকটি টিকা নিয়ে এসে মানুষকে দিলে দুর্যোগে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব নয়' জানিয়ে তিনি আরও বলেন, 'সর্বস্তরের মানুষের জন্য টিকার ব্যবস্থা করতে না পারলে ওই টিকা দিয়ে কিছুই হবে না।'

বগুড়া-৬ (সদর) আসনের সাংসদ ও জেলা বিএনপির আহ্বায়ক গোলাম মো. সিরাজ বলেন, 'আমি নিজে করোনা টিকা নিয়েছি অনেক আগেই। টিকা নেওয়ার বিষয়ে দলীয় নেতা-কর্মীদেরও উৎসাহিত করছি আমরা। করোনা টিকা নিয়ে বিএনপির বিরুদ্ধে বাজারে একটি প্রপাগান্ডা আছে যে, বিএনপি করোনা টিকা নেওয়ার বিরোধী; আসলে ব্যাপারটি সত্য নয়। বিশ্বে এখনো ১৩০টি দেশ করোনা টিকা পায়নি। কিন্তু আমরা পেয়েছি। এজন্য সরকার ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। আসলে ভালো কাজকে ভালো বলতে হবে।'

স্ত্রীসহ প্রায় সপ্তাহখানেক আগে করোনা টিকা নিয়েছেন বগুড়া-৪ (কাহালু-নন্দীগ্রাম) আসনের বিএনপি দলীয় সাংসদ মো. মোশারফ হোসেন। তিনি বলেন, 'করোনা টিকা নেওয়ার বিষয়ে বাজারে বিএনপির বিরুদ্ধে গুজব রয়েছে। আসলে বিএনপি গুজবের পক্ষে নয়। বিএনপি আসলে খারাপ কিছুকে প্রশ্রয় দিয়ে লালিত করে না। সরকারের নানা দিক দেখে অনেকে হয়তো ভয় পেয়েছেন। কিন্তু টিকা নেওয়া বা না নেওয়ার বিষয়ে কোনো নির্দেশনা নেই। প্রত্যেক সচেতন মানুষের টিকা নেওয়া উচিত। দলীয় নেতাকর্মীরা টিকা নিচ্ছেন। তবে সরকারের উচিত টিকা নেওয়ার বিষয়ে জনসচেতনা সৃষ্টি করা হয়। টিকা নিয়ে কোনো কারণে কেউ অসুস্থ হলে তাকে চিকিৎসা দেওয়ার আশ্বস্ত করা।'


  • প্রতিবেদনটি তৈরিতে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের চট্টগ্রাম, বগুড়া, বরিশাল ও রাজশাহী প্রতিনিধিরাও কাজ করেছেন

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.