বাড়ছে ডেঙ্গুর প্রকোপ, কাজে আসছে না ঢাকার মশা নিধন কর্মসূচি

বাংলাদেশ

03 October, 2021, 04:25 pm
Last modified: 03 October, 2021, 05:02 pm
দুই সিটি করপোরেশন বিভিন্ন সময়ে মশক নিধনে চিরুনি অভিযান, মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে জরিমানা করা এবং দুই মেয়র বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলেও রাজধানীবাসীকে ডেঙ্গুর হাত থেকে রক্ষা করতে পারেনি।
  • গত ৫ অর্থ বছরে বরাদ্দের প্রায় ২৪ শতাংশ টাকাই খরচ করতে পারেনি দুই সিটি করপোরেশন।
  • ডিএনসিসি খরচ করেছে প্রায় ৮৮ শতাংশ এবং ডিএসসিসি করেছে প্রায় ৬২ শতাংশ।
  • ২০২১-২২ অর্থ বছরে ডিএনসিসি'র বরাদ্দ বেড়েছে প্রায় ৩০ কোটি টাকা কিন্তু ডিএসসিসি'র বরাদ্দ কমেছে প্রায় ১৫ কোটি টাকা
  • মশা নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতিকে দূষছেন বিশেষজ্ঞরা
  • দুই সিটি মেয়র বলছেন ঢাকার মশা নিয়ন্ত্রণে

চলতি বছর দেশে ইতোমধ্যে ১৮ হাজার ৫৫০ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে। এছাড়া, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৬৮ জন। ফলে, সিটি করপোরেশনের মশা নিধন কর্মসূচি কার্যকর নয় বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

২০১৮ সালে পুরো বছর জুড়ে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ১০ হাজার ১৪৮ জন থেকে ২০১৯ সালে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় এক লাখ এক হাজার ৩৫৪ জনে। ২০২০ সালে এই সংখ্যা পুনরায় কমে দাঁড়ায় এক হাজার ৪০৫ জনে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ডেঙ্গু কোনো দেশে একবার প্রবেশ করলে প্রাথমিক অবস্থায় কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। একবছর সংক্রমণ বৃদ্ধি পেলেও পরের বছর সংক্রমণ সংখ্যা তাই রাতারাতি কমে আসে। শুরু থেকেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে আক্রান্তের সংখ্যা দ্রুত বাড়ে।

চলতি বছর, মশাবাহিত রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার লক্ষ্যে বরাদ্দ বাড়ানো হলেও সংক্রমণ দ্রুত বাড়ছে। ঢাকা সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ লার্ভা নিধনের লক্ষ্যে ফগিং ও স্প্রে করলেও তা মশা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়নি।

খাল ও নালাগুলো পরিষ্কার করা, কচুরিপানা ও আগাছা অপসারণ, নির্মাণাধীন স্থান ও জনপরিসরে ম্যাগনেটিক ফাঁদ স্থাপন, পানিতে গাপ্পি মাছ ছাড়ার মতো বিকল্প বহু উপায় অনুসরণ করে প্রতিবেশি দেশ ভারতের কলকাতাসহ বিশ্বের বড় শহরগুলো।

কীটতত্ত্ববিদদের পরামর্শ অনুসারে, পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য রক্ষায় শহরগুলো কীটনাশক থেকে পরিবেশবান্ধব 'গ্রিন ডাইভে'র দিকে ঝুঁকছে।

এমনকি ফ্লোরিডা এবং সিঙ্গাপুরের মতো শহরে ডেঙ্গু ও জিকা ভাইরাস ছড়ানো এডিস ও অন্যান্য প্রজাতির মশা প্রতিরোধে জেনেটিকালি পরিবর্তিত মশা ছাড়া হচ্ছে।

ঢাকায় মশক নিয়ন্ত্রণের অর্থ হলো কীটনাশকের কিনতে বাজেট বাড়ানো এবং নিয়মিত শহর পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালানো গতিশীল করা। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে মশক নিয়ন্ত্রিত কর্মসূচির জন্য বরাদ্দ অর্থের পরিমাণ দেখা যাক।

২০২১-২২ অর্থবছরে ডিএনসিসিতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১১০ কোটি টাকা। এর মধ্যে কীটনাশক কিনতে ৪৫ কোটি, আগাছা ও কচুরিপনা পরিস্কার করতে ৩.৫০ কোটি, মশক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি বাস্তবায়নে ৩ কোটি, আউট সোর্সিং-এ ২৭ কোটি, চিরুনী অভিযান পরিচালনায় ৪ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছে। এছাড়াও মশক নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রপাতি ক্রয়ের জন্য ডিএনসিসি বরাদ্দ রেখেছে ২৫ কোটি টাকা।

এ অর্থ বছরে ডিএসসিসিতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩৫.৩০ কোটি টাকা। এর মধ্যে কীটনাশক কিনতে ২২.৫০ কোটি, আগাছা ও কচুরিপনা পরিস্কার করতে পাঁচ লাখ, মশক নিধনের যন্ত্রপাতি পরিবহনের জন্য ৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা বরাদ্দ রেখেছে। এছাড়াও মশক নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রপাতি ক্রয়ের জন্য ডিএসসিসি বরাদ্দ রেখেছে নয় কোটি টাকা।

দুই সিটি করপোরেশন বিভিন্ন সময় মশক নিধনে চিরুনি অভিযান, মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে জরিমানা করা এবং দুই মেয়র বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলেও রাজধানীবাসীকে ডেঙ্গুর হাত থেকে রক্ষা করতে পারেনি।

দুই সিটি কর্পোরেশন এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে সফল হয়েছে দাবি করলেও কীটতত্ববিদরা বলছেন এ ধরনের লোক দেখানো অভিযান আর জরিমানা করে মশা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব না। দেশের কীটতত্ববিদদের কাজে লাগিয়ে ভেক্টর ম্যানেজমেন্ট পদ্ধতির মাধ্যমে মশা নিয়ন্ত্রনের ব্যবস্থা নিলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। বছরের শুরু থেকেই মশা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করা এবং বাজেট অনুযায়ী অর্থের ব্যবহারকে না করাকেই দূষছেন তারা।

দেশের মোট ডেঙ্গু রোগীর মধ্যে রাজধানী ঢাকার বাইরে আক্রান্ত সংখ্যা এ পর্যন্ত ২ হাজার ৩১৩ জন। যাদের মধ্যে সেপ্টেম্বরের ৩০ দিনেই আক্রান্ত হয়েছেন ১৪৭৬ জন। যা রাজধানীর বাইরের মোট রোগীর প্রায় ৬৪ শতাংশ।

বাজেটের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মশা

রাজধানী ঢাকায় দিন দিন এডিস মশার সংক্রমণ বাড়ার সঙ্গে মশা নিয়ন্ত্রণে দিন দিন বাজেটে বরাদ্দের পরিমাণ বাড়লেও এখনও নিয়ন্ত্রণে আসেনি মশা। প্রতি বছরই বর্ষা মৌসুমে এডিস মশার কামড়ে বিপর্যস্ত হচ্ছে নগরবাসীর জনজীবন। কিন্তু এ মশা নিয়ন্ত্রণেই গত পাঁচ অর্থবছরে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ব্যয় করেছে প্রায় ২৯২ কোটি ৬৬ লাখ টাকা।

গত পাঁচ বছরে মশা নিয়ন্ত্রণে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) বরাদ্দ প্রায় ৩৭৮ শতাংশ বাড়লেও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) বেড়েছে মাত্র ১৮ শতাংশ।

তবে বিভিন্ন হাসপাতালের তথ্য এবং কীটত্তত্ববিদদের গবেষণা অনুযায়ী উত্তরের থেকে দক্ষিণ সিটিতেই এবছর ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেশি।

সরকারি তথ্য মতে, ২০১৯ সালে দেশে প্রায় এক লাখ এক হাজার ৩৫৪ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয় এবং ১৭৯ জনের ডেঙ্গুজনিত মৃত্যু হওয়ার পরে দুই সিটি করপোরেশন মশা নিয়ন্ত্রণে নড়েচড়ে বসলেও মশা নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতিতে আসেনি তেমন কোনো পরিবর্তন। বছর বছর মশা নিয়ন্ত্রণে বরাদ্দ বাড়ালেও তা সম্পূর্ণ খরচও করতে পারেনি দুই সিটি কর্পোরেশন।

গত অর্থ বছরে দক্ষিণে মশা নিয়ন্ত্রণে বরাদ্দ প্রায় ৫১ কোটি থাকলেও খরচ করতে পেরেছে মাত্র ২০ কোটি টাকা। অপরদিকে উত্তর সিটি কর্পোরেশনে ৮০ কোটি ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দ থাকলেও খরচ করেছে ৫৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা।

বুধবার একটি অনুষ্ঠানে ডিএসসিসি মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, "মঙ্গলবার আমাদের রোগীর সংখ্যা ২৫ জনের নিচে ছিল। গত পাঁচ দিন ধরে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় প্রতিদিন ২০ জনের ঘরে রোগী পেয়েছি। সুতরাং দক্ষিণ সিটিতে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।"

ডিএনসিসি মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম মশা নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে বলেন, "এডিস মশার বংশবিস্তার রোধকল্পে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রায় এক হাজার ৭০০ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে পত্র প্রদান করা হচ্ছে। সুপারভাইজার এবং মশক নিধন কর্মীদের জন্য একটি নির্দেশিকাও তৈরি করা হয়েছে। মশা নিয়ন্ত্রণে কর্মীরা দিন-রাত কাজ করে যাচ্ছে।

প্রয়োজন ভেক্টর ব্যবস্থাপনা

কীটতত্ত্ববিদ ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, "দুই সিটি কর্পোরেশনের যেভাবে মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার ছিল তা নিতে পারেনি কতৃপক্ষ। শুধু শুধু জনগণের দোহাই দিয়ে এডিস মশার সংক্রমণকে বাড়িয়ে দিয়েছে। আমাদের জনপ্রতিনিধি ও রাজনীতিবিদদের যে অঙ্গীকার থাকা প্রয়োজন সে অঙ্গীকার তারা রাখতে পারেনি। ঢাকার ডেঙ্গু সংক্রমণ কমাতে কিংবা বাড়াতে সিটি করপোরেশনের কোনো ভূমিকা নেই।"

সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) এর চেয়ারম্যান কীটতত্ত্ববিদ ড. মনজুর আহমেদ টিবিএসকে বলেন, "আমাদের ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনে যে পরিমাণ টাকা মশা নিয়ন্ত্রণে বরাদ্দ হয় তা পুরোপুরি দরকারও হয় না। সঠিকভাবে এবং সময়মতো কীটনাশক প্রয়োগ, লার্ভিসাইডিং করা, ফগিং করলে মশা নিয়ন্ত্রণ খুব বড় কোনো বিষয় না কিন্তু আমাদের যেমন কীটতত্ত্ববিদের অভাব, তেমনি কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণেরও অভাব রয়েছে। শুধু ঢাক-ঢোল পিটিয়ে কর্মসূচি পালন করলেই মশা নিয়ন্ত্রণ হবে না।"

রাজধানীর ডেঙ্গু কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, "জুলাই মাস থেকে যে হারে ডেঙ্গুর সংক্রমণ বাড়ছিল এখন সে হারে কমছে না। এটা পরিবেশের কারণেই বেড়েছে, আবার কমবে। এতে সিটি কর্পোরেশনের কোনো কার্যক্রম তেমন কাজে আসেনি।"

ভেক্টর ম্যানেজমেন্টের মাধ্যমে সঠিকভাবে মশা নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী পদক্ষেপ নিলে ডেঙ্গুর হাত থেকে নগরবাসী মুক্তি পেতে পারে বলে দাবি এ কীটতত্ত্ববিদের।

মশা নিধনের অন্যান্য মডেল

২০১৯ সালে ঢাকায় যখন ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছিল তখন ডিএনসিসি মেয়র কলকাতায় মশা নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি জানতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। এক ভিডিও কনফারেন্সে কলকাতা পুরসভার ডেপুটি মেয়র অতীন ঘোষ জানান, কলকাতা 'গত নয় বছরে' কোনো কীটনাশক ব্যবহার করেনি।

"আমরা পরিবেশবান্ধব ও জৈবিক কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে মশা নিয়ন্ত্রণ করছি," বলেন অতীন। একইসঙ্গে তাদের 'থ্রি টায়ার মনিটরিং ব্যবস্থা' ঢাকার জন্যও কার্যকর হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

এসিড মশা কেবল লার্ভিসাইড ও অ্যাডাল্টিসাইড ছড়ানোর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়, এর মাধ্যমে শুধু কিউলেক্স মশা নিধন সম্ভব বলে ডিএনসিসিকে মেয়রকে জানান তিনি।

চলতি বছরের শুরুতে কলকাতা মিউনিসিপ্যাল করপোরেশন শহরের নিউ টাউন এলাকায় ম্যাগনেটিক নেট স্থাপন করে মশা নিয়ন্ত্রণের আরেকটি কৌশল অবলম্বন করে।

অন্যদিকে, সিঙ্গাপুর গতবছর ভয়াবহ ডেঙ্গু প্রকোপ প্রতিরোধ করতে ল্যাবে তৈরি মশা ছাড়ে। ব্যাকটেরিয়াবাহী এই মশা ডিম পরিস্ফুটন বন্ধ করে মশার প্রজনন রোধ করে।

চলতি বছরের মে মাসে, বিল গেটস ফান্ডের অর্থায়নে একটি বায়োটেক ফার্ম ডেঙ্গু ও জিকা ভাইরাসের মতো মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণে ফ্লোরিডা প্রণালিতে পরিবর্তিত জিনের মশা ছাড়ে।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.