বই বিতরণ না হওয়া শিক্ষার জন্য প্রাথমিক উদ্বেগ

বাংলাদেশ

03 February, 2021, 01:25 pm
Last modified: 03 February, 2021, 05:54 pm
স্কুলগুলোতে বই বিতরণ না হওয়ায় বিশেষজ্ঞদের প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার আশঙ্কা বাস্তবে রূপ নিচ্ছে এমনটাই মনে হচ্ছে।

স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য যে নতুন বই প্রতিবছর দেওয়া হয় তার মধ্যে ১০০ সেটেরও বেশি বই এখনো বিতরণ হয়নি। বিষয়টি ভাবাচ্ছে পাবনার ডেমরায় অবস্থিত একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আতিকুর রহমানকে।  তার স্কুলের শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন তিনি।

স্কুলটিতে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষার্থী আছে ৭০০ জন; সবার মধ্যেই বিতরণের জন্য বিদ্যালয়ে বইও এসেছে ৭০০ সেট। বিগত বছরগুলোতে বছর শুরুর দিনে বই উৎসবের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মাঝে বই বিতরণ হতো। তবে এবার বই বিতরণে সময় লেগেছে ৭ দিন। এরপরও এখন পর্যন্ত ১০০ জন শিক্ষার্থী বই নিতে আসেনি, যা বিদ্যালয়টির মোট শিক্ষার্থী সংখ্যার ১৪ শতাংশেরও বেশি। 

"শিক্ষার্থীদের পরিবারের ওপর মহামারির যে প্রভাব পড়েছে তা পুষিয়ে নিতে এসব শিক্ষার্থী রোজগারের কাজে সম্পৃক্ত হয়েছে এমনটাই আশঙ্কা করছি। তাদের বিদ্যালয়ে ফিরিয়ে আনাটা বেশ কঠিন হবে," বলেন আতিকুর রহমান।

দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের বিভিন্ন জেলার প্রতিনিধিরা অন্যান্য জেলার ব্যাপারেও এমন তথ্যই দিয়েছেন। 

ভোলার চরফ্যাশনের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ২১ শতাংশ শিক্ষার্থী নতুন ক্লাসের জন্য বই সংগ্রহ করতে আসেনি। 

বোরহানুদ্দীন উপজেলার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ১৮ শতাংশ শিক্ষার্থী অনুপস্থিত ছিল, তাদের সবাইকেই দেশের অন্যান্য বিদ্যালয়ের মতোই বার্ষিক পরীক্ষা ছাড়াই পরবর্তী শ্রেণীতে উত্তীর্ণ করা হয়েছে। 

ব্রাহ্মণবাড়িয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ইমরান আহমেদ তার বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও একই চিত্রের কথা জানিয়েছেন। তিনি জানান, তার স্কুলের ১০ শতাংশ শিক্ষার্থী বই নিতে আসেনি। এসব শিক্ষার্থী পড়াশোনা বন্ধ করে দিতে পারে এমন আশঙ্কা করছেন এই শিক্ষক। 

স্কুলগুলোতে বই বিতরণ না হওয়ায় বিশেষজ্ঞদের প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার আশঙ্কা বাস্তবে রূপ নিচ্ছে এমনটাই মনে হচ্ছে।

২০১৯ সালে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের চালানো এক জরিপে দেখা যায়, প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার ১৭.৯০ শতাংশ থেকে ৪০ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। ২০২৩ সাল নাগাদ এ হার কমিয়ে ১০ শতাংশে নিয়ে আসার লক্ষ্য হাতে নিয়েছে সরকার। 

তবে বিনামূল্যে বই বিতরণ, দুপুরের খাবার ও উপবৃত্তির দেওয়ার মতো উদ্যোগ নিয়ে গত এক দশকের অর্জন হুমকির মুখে পড়েছে বর্তমান অবস্থায়।

মহামারির প্রভাবে বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার সম্ভাব্য সংখ্যার কোনো নিশ্চিত তথ্য নেই এখন পর্যন্ত। 

"বিদ্যালয় পুনরায় খুলে দেওয়ার পর আসল চিত্র বোঝা যাবে, তখন বুঝতে পারবো কতো সংখ্যক শিক্ষার্থী আর বিদ্যালয়ে আসছে না," বলেন ক্যাম্পেইন ফর পপুলার এডুকেশনের (সিএএমপিই) নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী। মাঠ পর্যায় থেকে তারা যেসব তথ্য পাচ্ছেন, বহু শিক্ষার্থীই বই নিতে বিদ্যালয়ে ফিরে আসেনি বলে জানান তিনি। 

"শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার দ্বিগুণও হতে পারে, অনেক শিক্ষার্থী নতুন শ্রেণীতে ভর্তি হয়নি এমন তথ্যও পাচ্ছি আমরা।" বলেন তিনি। 

দিনাজপুর কালেক্টরেট স্কুল অ্যান্ড কলেজে এধরণের ঘটনা দেখা যাচ্ছে। গত বছর দ্বিতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছিল ৪০ জন শিক্ষার্থী। এবছর এ সংখ্যা কমে ২৯-এ দাঁড়িয়েছে। মহামারির জন্যই শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে গেছে বলে মনে করছে বিদ্যালয়টির প্রশাসন। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা জানান, তারা দেশের সব বিদ্যালয়ে বই পাঠিয়েছেন, তবে কতোজন শিক্ষার্থী বই সংগ্রহ করতে আসেনি এ সংক্রান্ত কোনো জরিপ চালানো হয়নি। 

"আমরা এ বিষয়টি বিবেচনায় রাখছি," বলেন তিনি। 

মাধ্যমিক বিদ্যালয়েও মহামারির প্রভাবে একই ধরনের প্রভাবই পড়েছে। বর্তমানে মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার ৩৬ শতাংশ। পুনরায় বিদ্যালয় খোলার পর এ হার বৃদ্ধি পেয়ে ৪৫ শতাংশ অতিক্রম করতে পারে এমন আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। 

দিনাজপুর ইদগাহ গার্লস হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ফজলুর রহমান জানান, গত বছর ১৪১ জন শিক্ষার্থী ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছিল। এ সংখ্যা কমে এবছর ১২২-এ দাঁড়িয়েছে। 

তিনি বলেন, সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো প্রতিবছর তার বিদ্যালয়ে ২৫০টি আসনে ভর্তি হওয়ার জন্য প্রায় ৬০০ জন শীক্ষার্থী আবেদন করে, এবছর মোট আবেদন জমা পড়েছে মাত্র ১২২টি। 

"আমরা ভর্তি পরীক্ষা ছাড়াই তাদের ভর্তি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি," বলেন ফজলুর রহমান।

শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার অন্যতম প্রধান কারণ হলো দারিদ্র্য। একাধিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্যানুযায়ী, মহামারির কারণে এবছরে দারিদ্র্যের হার দ্বিগুণ বেড়ে ৪০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। 

ক্যাম্পেইন ফর পপুলার এডুকেশনের (সিএএমপিই) সাম্প্রতিক এক জরিপে শিক্ষার্থীদের পরিবারের অর্থনৈতিক টানা পোড়নের কথা উঠে এসেছে। ৫৮ শতাংশ শিক্ষার্থী প্রয়োজনীয় ডিভাইসের অভাবে অনলাইন ক্লাসে অংশ নিতে পারেনি, এমনটাই উঠে এসেছে জরিপের ফলাফলে।

জরিপের ফলাফলে আরও দেখা যায়, শিক্ষার্থীদের পরিবারের মৌলিক চাহিদা পূরণের সামর্থ্যের হার ৭৩ শতাংশ থেকে কমে ২৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। 

অর্থনৈতিক বেহাল দশার কারণে অনেক অভিভাবক অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে, ফলে বৃদ্ধি পেয়েছে বাল্যবিবাহের হারও।

সম্প্রতি দারিদ্র্য সীমায় প্রবেশ করা জনগোষ্ঠীর ২০ শতাংশের দারিদ্র্য বিমোচন শিক্ষা খাতে মহামারি পূর্ববর্তী অবস্থা ফিরিয়ে আনতে পারে। 

তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, মহামারির সময় ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে ফিরিয়ে আনতে এটিই যথেষ্ট হবে না। দ্রুতগতিতে দারিদ্র্য বিমোচন ভবিষ্যতে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধ করতে পারে। 

সবচেয়ে গুরূত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, বিদ্যালয়ে মহামারির পূর্ববর্তী অবস্থা ফিরে আসতে কতো সময় লাগবে।   

শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার সমস্যা ছাড়াও, এক বছর পর বিদ্যালয়ে ফিরে আসা শিক্ষার্থীদের এতোদিনে যে শিক্ষা গ্যাপ তৈরি হয়েছে, তা পুষিয়ে নেওয়াও আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ।

ক্যাম্পেইন ফর পপুলার এডুকেশনের (সিএএমপিই) এক জরিপে দেখা গেছে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৬৯ শতাংশ শিক্ষার্থী সংসদ টেলিভিশন, রেডিও ও অন্যান্য অনলাইন মাধ্যমে অনুষ্ঠিত অনলাইন ক্লাসে অংশগ্রহণ করেনি। এদের মধ্যে ৫৮ শতাংশ শিক্ষার্থীর অনলাইন ক্লাসে অংশগ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় ডিভাইস ছিল না।

বিদ্যমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন বিশেষ মনোযোগ। দেশজুড়ে বিদ্যালয়গুলোতে দুপুরের খাবার প্রদান কর্মসূচীর সম্প্রসারণ, উপবৃত্তির পরিমাণ ও সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি এসব পদক্ষেপ পরবর্তী সময়ে শিক্ষা ব্যবস্থার অবনতি রোধে সহায়ক হবে বলে জানান রাশেদা কে চৌধুরী।  
 


লেখক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের উপ-নির্বাহী সম্পাদক। দিনাজপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রতিনিধিরা প্রতিবেদনটি তৈরিতে সাহায্য করেছেন। 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.