ফসল উৎপাদনে নিশ্চিত লাভ না থাকায় তামাক চাষে ঝুঁকছেন হাজারো চাষী

বাংলাদেশ

29 May, 2021, 04:55 pm
Last modified: 29 May, 2021, 04:55 pm
তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন ২০০৫ অনুযায়ী, তামাক চাষে নিরুৎসাহিত করতে নীতিমালা প্রণয়নের কথা বলা হয়েছে। সরকার ২০৪০ সালের মধ্যে দেশ তামাক মুক্ত করার ঘোষণা দিলেও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) ১৫ বছরে তামাক উৎপাদন বন্ধ কিংবা হ্রাস করতে কোনো সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারেনি।

জীবনের অর্ধেক সময় জুড়েই তামাক চাষ করেছেন ৪৭ বছর বয়সী চাসাহ্লা মারমা। প্রায় প্রতি মৌসুমেই সিগারেট প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে ফসল বিক্রির পরেও তিনি ঋণগ্রস্ত থাকতেন।

কিন্তু, নিজের জমি আর মূলধন না থাকায় তার অন্য কিছু করার মতো সুযোগও নেই।

চাসাহ্লা তামাকজাত পণ্য বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে বিনামূল্যে বীজ পেয়ে থাকেন। বান্দরবানের থানচি উপজেলার সাঙ্গু নদীর পাশে ইজারা নেওয়া দুই একর জমিতে তিনি এই বীজ বপন করেন।

তামাক পাতা পরিণত হওয়ার পর জটিল কিউরিং বা সংরক্ষণ পর্ব শেষ হলে তামাক কোম্পানি থেকে প্রতিনিধি আসে। এপ্রিলের শেষ নাগাদ তারা পাতার আকার, রঙ, আর্দ্রতা এবং পুরুত্ব অনুযায়ী সেগুলো আলাদা করেন। পরবর্তীতে, মান অনুযায়ী প্রতি কেজি তামাকের জন্য ১২০ থেকে ১৭০ টাকা পর্যন্ত মূল্য নির্ধারণ করা হয়।

অন্যান্য ফসল চাষ করে চাসাহ্লা যা পেতেন, তার থেকে এই মূল্য তুলনামূলক বেশি। কিন্তু, ইজারার অর্থ পরিশোধ, কিউরিংয়ের শ্রমিক মজুরি, সারের জন্য কোম্পানির কাছ থেকে নেওয়া ঋণ এবং অন্যান্য খরচের পর পরিবারের ব্যয় বহনের খুব সামান্য অর্থ অবশিষ্ট থাকে।

তবে, চাসাহ্লা এতকিছুর পরেও একই মৌসুমের ভূট্টা কিংবা সরিষার মতো অন্যান্য ফসল চাষের কথা ভাবতে পারেন না। কেননা, এসব শস্য চাষের জন্য কোনো আর্থিক প্রণোদনার ব্যবস্থা নেই। এছাড়া, অন্যান্য ফসলের ক্ষেত্রে তাকে তিন ঘন্টা ব্যয় করে ৭০ কিলোমিটার পার্বত্য অঞ্চল পাড়ি দিয়ে নদীর ওপাড়ে বান্দরবান শহরে ফসল পৌঁছানোর মাধ্যমে লাভের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।

চাসাহ্লার মতো প্রায় ২০০ দরিদ্র কৃষকের জন্য এই প্রতিকূলতা জয় করা বেশ কঠিন। থানচির বালিপাড়ার যে প্রত্যন্ত অঞ্চলে তাদের বাস, সেখানে নিশ্চিত কোনো খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থাও নেই। বিচ্ছিন্ন এই কৃষকরা তাই না চাইলেও অনেকটা বাধ্য হয়ে তামাক চাষ করেন।

তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন ২০০৫ অনুযায়ী, তামাক চাষে নিরুৎসাহিত করতে নীতিমালা প্রণয়নের কথা বলা হয়েছে। সরকার ২০৪০ সালের মধ্যে দেশ তামাক মুক্ত করার ঘোষণা দিলেও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) ১৫ বছরে তামাক উৎপাদন বন্ধ কিংবা হ্রাস করতে কোনো সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারেনি।

তামাক-বিরোধী আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্টরা জানান, শীর্ষ তামাক ব্যবহারকারী দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান অন্যতম। দেশের প্রায় ৩৫ দশমিক ৩ শতাংশ জনগোষ্ঠী ধূমপান করেন অথবা অন্যান্য তামাকজাত পণ্য ব্যবহার করে থাকেন। বছরের পর বছর কর আরোপ সত্ত্বেও নিম্ন-মানের সিগারেট বিক্রি বৃদ্ধির হার থেকে ধারণা করা যায় যে দেশে তামাক ও তামাকজাত পণ্য সুলভ এবং সহজলভ্য।

উচ্চ কর হার থাকলেও প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে সিগারেটের দাম কম। আন্দোলনকারীদের বক্তব্য অনুযায়ী, সরকার তামাক চাষে বাধাদান বা কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় স্বল্পমূল্যে কাঁচামাল সংগৃহীত করা সম্ভব হচ্ছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালের পর তামাক চাষের পরিমাণ ৮৯ হাজার টন থেকে কমে ৮৬ হাজার টনে নেমে আসে। অন্যদিকে, এক লাখ একর তামাক চাষের জমি মাত্র পাঁচ হাজার একর পর্যন্ত কমে।

অন্যদিকে, তামাক চাষীদের জন্য নেই কোনো সহায়ক নীতিমালা। দিন রাত মাঠে তামাক চাষ এবং পাতা শুকানোর জন্য কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন তারা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই লাভের চেয়ে জীবিকার তাগিদেই তারা এ পথ বেছে নিয়েছেন। ২০২০ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের বৃহত্তম তামাকজাত পণ্য বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকোর অধীনে দেশে প্রায় ৩৩ হাজার রেজিস্ট্রিকৃত তামাক চাষী আছে।

ডিএইর মহাপরিচালক মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ বলেন, "সারাদেশে যদি আমরা বিপণন কৌশল বিস্তার করতে পারতাম, তাহলে কৃষকরা সবজি ও অন্যান্য ফসলের যথাযোগ্য মূল্য লাভের মাধ্যমে তামাক চাষ বন্ধ করে দিত।"

তামাকাজাত পণ্য বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানগুলো চাষের পূর্ব থেকে শুরু করে সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে পাতা কেনার মাধ্যমে তাদের সহায়তা করে থাকে।

কৃষকরা তামাক চাষ করে কী পরিমাণ লাভ করে থাকে, ডিএই বর্তমানে তা অনুসন্ধানে জরিপ পরিচালনা করছে বলে জানান জনাব আসাদুল্লাহ। জরিপের প্রতিবেদন থেকে কৃষকদের কীভাবে অন্যান্য ফসল চাষে উৎসাহিত করা যায় সেই পরিকল্পনা গৃহীত হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

তিনি আরও জানান, তামাক চাষের বদলে কৃষকরা যেন অন্যান্য ফসল চাষ করে সেজন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে তাদের ভূট্টা, সূর্যমুখী, শীতের সবজি, পেঁয়াজ, বোরো ধান এবং আলুর বীজ সরবরাহ করা হয়।

আখ, বাদাম ও ফুলকপির মতো উচ্চমূল্যের ফসল তামাক আয়ের বিকল্প হতে পারে বলে মন্তব্য করেন বান্দরবান জেলার ডিএই উপ পরিচালক ডাক্তার এ কে এম নাজমুল হক।

ফসল ক্রয়ের বিষয়টি উল্লেখ করে, বড় বড় সংস্থাগুলোকে তিনি বিনিয়োগ এবং কৃষকদের সাথে যৌথভাবে কাজ করার পরামর্শ দেন।

তবে, বালিপাড়ার তামাক চাষীরা জানান, ডিএই খুবই সীমিত পরিসরে বীজ বিতরণের কাজটি করেছে।

গত মৌসুমের আগে ডিএইর স্থানীয় কার্যালয় থেকে অন্যদের সাথে বিনামূল্যে বীজ পান বালিপাড়ার ৩২ বছর বয়সী ঊষা নু মারমা। দশ বছর ধরে পারিবারিক যে জমিতে তিনি তামাক চাষ করছিলেন, সেখানে তিনি সবজির চাষ করেন।

"আমাকে জঙ্গল থেকে কাঠ কেটে আনতে হত এবং সংরক্ষণ বা কিউরিংয়ের সময় সারারাত ধরে জাগতে হত। যে টাকা আমি পেতাম তা যথেষ্ট ছিল না," বলেন ঊষা।

তবে, নদীর ওপাড়ে সবজি বিক্রি করলে তিনি লাভ করতে পারবেন না বলেও আশঙ্কা করেছিলেন। কেননা, গ্রামবাসীরা অধিকাংশই জুম চাষী। তারা যা উৎপাদন করে, তাই গ্রহণ করে থাকে।

"এখানে জীবিকার কোনো উৎস খুঁজে পাওয়া বেশ কঠিন," বলেন ঊষা।

তবে, ঊষার মতো ভবিষ্যতেও নিরবিচ্ছিন্নভাবে সহযোগিতা পেলে কুষ্টিয়ার বহু কৃষকও তামাক চাষ বন্ধে রাজি আছেন।

সম্প্রতি কুষ্টিয়ার তামাক চাষী শাহিন আলী জানান, চলতি বছর সিগারেট প্রস্তুতকারকরা প্রতি কেজি তামাক পাতা ১৬০ টাকা থেকে কমিয়ে ১৩০ টাকা দরে কেনায় কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার ছয় হাজার তামাক চাষীদের অধিকাংশই বিপুল ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। এমনকি, অনেকে তাদের উৎপাদিত ফসলও বিক্রি করতে পারেননি।

অন্যদিকে, চলতি বছর জেলার ধানচাষীরা লাভ করেন বেশি। কেননা, এ বছর উৎপাদন খরচের থেকে ধান ভালোদামে বিক্রি করা সম্ভব হয়েছে।

"আমার মতে, ধানের দাম উচ্চ থাকলে কৃষকরা কয়েক বছরের মধ্যেই তামাক চাষ বন্ধ করে দিবে," বলেন শাহিন।

কথায় কথায় শাহিন জানান, ধানের বাজারে অস্থিরতা বিদ্যমান থাকায় ছয় মাস আগে শাহিন এবং অন্যান্য চাষীরা ধানের পরিবর্তে তামাক চাষ করাকেই বেছে নেন। 
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.