প্রত্যাবাসনের পক্ষে সক্রিয় অবস্থান নেওয়ায় মুহিবুল্লাহকে হত্যা করা হয়: পরিবার

বাংলাদেশ

01 October, 2021, 09:25 am
Last modified: 01 October, 2021, 09:48 am
প্রত্যাবাসনের পক্ষে সক্রিয়তাসহ হত্যাকাণ্ডের পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে বলে দাবি করে তার পরিবান। ক্যাম্পে শঙ্কিত সাধারণ রোহিঙ্গারা। পরিস্থিতি থমথমে, নিরাপত্তা জোরদার। 

ক্যাম্পের বিতর্কিত কথিত সংগঠন আরসা নেতারাই মাস্টার মুহিবুল্লাহকে হত্যা করেছে বলে দাবি করেছেন রোহিঙ্গা নেতা মাস্টার মুহিবুল্লাহর ছোট ভাই হাবিব উল্লাহ।

কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্প-১ এ নিজ অফিসে অজ্ঞাত বন্দুকধারীদের গুলিতে নিহত হন সুপরিচিত রোহিঙ্গা নেতা মাস্টার মুহিবুল্লাহ (৫০)। বুধবার (২৯ সেপ্টেম্বর) রাত পৌনে নয়টার দিকে লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্প ইস্ট-ওয়েস্ট ১ নম্বর ব্লকে অজ্ঞাতনামাদের গুলিতে নিহত হন তিনি।

এ ঘটনার পর থেকে উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে জোরদার করা হয়েছে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা। বাসা থেকে তেমন বাইরে বের হয়নি রোহিঙ্গারা। বৃহস্পতিবার ক্যাম্পে সকল এনজিও কার্যক্রমও বন্ধ ছিল ।

মুহিবুল্লাহর ছোট ভাই হাবিবুল্লাহর দাবি, কুতুপালংয়ের লম্বাশিয়া ক্যাম্পের একটি মসজিদে বুধবার এশার নামাজ শেষ করে দু'ভাই এক সাথে বের হন। এরপর আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস (এআরএসপিএইচ) এর অফিসে অবস্থান করে সাধারণ রোহিঙ্গাদের সাথে কথা বলছিলেন মুহিবুল্লাহ। এসময় ২০-২৫ জনের একটি বন্দুকধারী দল সেখানে এসে তার ভাইকে লক্ষ্য করে গুলি করে। ওই অফিসে থাকা অন্যান্যদের মারধর করে ছেড়ে দিলেও তারা ভাইয়ের বুকে গুলি চালিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা।

হাবিবুল্লাহ আরো বলেন, "আমার ভাই রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের পক্ষে সক্রিয় ছিলেন। তিনি রোহিঙ্গাদের সবসময় বলতেন আমাদেরকে (রোহিঙ্গা) আমাদের দেশে (মিয়ানমারে) ফিরে যেতেই হবে। প্রত্যাবাসনে তার দৃঢ়তার জন্য সাধারণ রোহিঙ্গারাও তাকে ভালোবাসতেন, বিশ্বাস করতেন। রোহিঙ্গাদের যেকোনো সমস্যা সমাধানের জন্য আমার ভাই এগিয়ে আসতেন। তাদের অধিকার আদায়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করেছিলেন। সাধারণ রোহিঙ্গারা তাকে নেতা হিসেবে গণ্য করতেন ও মানতেন। শুধু ক্যাম্পে নয়, আন্তর্জাতিক মহলেও আমার ভাইয়ের পরিচিতি ছিল।"

তিনি আরো বলেন, "এটি কথিত সংগঠন 'আরসা' ও 'আল-ইয়াকিন'র নেতারা সহ্য করতে পারতেন না। তারা বলতেন, এখানে রোহিঙ্গাদের বিষয়ে আমরাই সিদ্ধান্ত নেব এবং সবকিছু করব। তোকে কেন নেতা মানা হবে? এ দ্বন্দ্ব থেকেই মুহিবুল্লাহ হত্যায় নেতৃত্ব দিয়েছে ক্যাম্পের 'আরসা' নেতা নামে পরিচিত মাস্টার আব্দুর রহিম, মুর্শিদ, লালুসহ ২০ থেকে ২৫ জনের একটি সশস্ত্র গ্রুপ। এদের মাঝে কয়েকজন কথিত 'আল ইয়াকিনের' সদস্য।"

নির্মম এ হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত করে ঘাতকদের শাস্তির দাবি করেছেন হাবিবুল্লাহ।

এদিকে, রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ খুনের পর রোহিঙ্গাদের মাঝে অজানা আতঙ্ক বিরাজ করছে। নিজেদের নিরাপত্তার কথা উল্লেখ করে মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হচ্ছেন না কোনো মাঝি বা নেতা।

তবে, নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন রোহিঙ্গা নেতা দাবি করেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক ও রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের পক্ষে সক্রিয় অবস্থান নেওয়ায় মিয়ানমার সরকারের পূর্ব পরিকল্পনা মতে রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহকে হত্যা করেছে। মুহিবুল্লাহর সহযোগী আরও কয়েকজন রোহিঙ্গা নেতা মিয়ানমারের টার্গেটে রয়েছে বলে দাবি করেন এই রোহিঙ্গা নেতারা।

সচেতন রোহিঙ্গাদের অভিযোগ, প্রত্যাবাসনের বদলে বাংলাদেশে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী প্রমাণে মরিয়া হয়ে উঠেছে মিয়ানমার সরকার। এজন্য তারা বিপথগামী লোভি রোহিঙ্গাদের দিয়ে ক্যাম্পে দীর্ঘদিন ধরে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ করানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। বিশ্ব দরবারে রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী হিসাবে তুলে ধরে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে রোহিঙ্গা গণহত্যায় মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গাম্বিয়ার করা মামলাটি প্রশ্নবিদ্ধ করাই মিয়ানমারের মূল লক্ষ্য বলে দাবি তাদের।

রোহিঙ্গা নেতা হামিদ উল্লাহ বলেন, "আমরা দেশে ফিরে যেতে চাই। তবে মিয়ানমার সরকার একদিকে যেমন আমাদের ফিরিয়ে নেওয়ার কথা বলছে, অন্যদিকে যাতে আমাদের আর মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিতে না হয় সেজন্য প্রাণান্ত চেষ্টা চালাচ্ছে। তার দাবি, ক্যাম্পে এখন যেসব সন্ত্রাসী কার্যক্রম চলছে সবই হচ্ছে মিয়ানমারের ইশারায়। তারা বিপথগামী কিছু রোহিঙ্গাকে ব্যবহার করে কথিত বিতর্কিত সংগঠন আল-ইয়াকিন ও আরসার নাম ভাঙিয়ে ক্যাম্পে নানা ধরনের সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাচ্ছে। রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যাকান্ড এর অংশ বলে দাবি করেন তিনি।"

রোহিঙ্গা নেতা দিল মোহাম্মদ বলেন, "আমরা আমাদের সম্পদ হারিয়ে ফেলেছি। রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের জন্য অনেক বড় ক্ষতি হয়েছে। এ ঘটনার পর থেকে ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের অবাধ বিচরণ কমে গেছে। সবার মাঝে অজানা শঙ্কা কাজ করছে।"

রোহিঙ্গাদের মাঝে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব থাকা ১৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক এসপি নাইমুল হক বলেন, "ঘটনার পর থেকে ক্যাম্পে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে, পরিস্থিতি প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।"

উখিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ আহাম্মদ সঞ্জুর মোরশেদ বলেন, "ময়নাতদন্ত শেষে নিহত মুহিবুল্লাহ'র মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এখনো মামলা হয়নি। কাউকে আটক করা সম্ভব হয়নি। বৃহস্পতিবার বিকাল ৫টায় জানাজা শেষে লম্বাশিয়া কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়েছে।"

কক্সবাজারে শরনার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার শাহ রেজওয়ান হায়াত বলেন, "রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ড ঘিরে যেসব অভিযোগ বা কথাবার্তা আমরা শুনতে পাচ্ছি সব বিষয় মাথায় রেখে তদন্তের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সহযোগিতা করা হবে।"

মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ড থেকে পরবর্তীতে যাতে বিশৃঙ্খলা না হয় এ জন্য সর্বস্তরে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, "বৃহস্পতিবার ক্যাম্প এনজিওদের নিয়মিত কার্যক্রম প্রায় বন্ধ ছিল। জরুরি কাজে যারা ক্যাম্পে যান তারাও অন্যদিনের চেয়ে আরো আগে ক্যাম্প ত্যাগ করেন।"

চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আনোয়ার হোসেন বলেন, "রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের ধরতে অভিযান চলছে। একইসঙ্গে কী কারণে তাকে হত্যা করা হয়েছে সেটিও খতিয়ে দেখছি আমরা। পুলিশের পাশাপাশি সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা এ বিষয়ে তৎপরতা চালাচ্ছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।"

মুহিবুল্লাহ মিয়ানমারের রাখাইনের মংডু এলাকার লংডাছড়া গ্রামের মৌলভি ফজল আহমদের ছেলে। বৃহস্পতিবার বিকাল ৫টায় জানাজা শেষে লম্বাশিয়া কবরস্থানে তার মরদেহ দাফন করা হয়।

 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.