পোশাক শিল্পের বাইরে অন্য শিল্প খাতের সুরক্ষা উপেক্ষা করা হয়েছে: অভিমত বিশেষজ্ঞদের

বাংলাদেশ

টিবিএস রিপোর্ট 
12 July, 2021, 12:10 am
Last modified: 12 July, 2021, 04:04 pm
রপ্তানির বাইরে থাকা পোশাক খাত এবং অন্যান্য শিল্প দীর্ঘদিন ধরে নজরদারির বাইরে রয়েছে এবং সেকারণেই সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জে সেজান জুস কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকান্ড ঘটেছে বলে স্বীকার করেছেন আলোচনায় যুক্ত হওয়া উদ্যোক্তা ও বিশেষজ্ঞরা

বিদেশ থেকে চাপ থাকলেই কেবল কারখানা কর্তৃপক্ষ সুরক্ষা মান অনুসরণ করে এবং নজরদারি শিথিল হলেই সুরক্ষা বাস্তবায়নে শিথিলতা দেখায়। 

কর্মপরিবেশের বৈশ্বিক সুরক্ষা মানের দিক থেকে এমন প্রতিক্রিয়াই দেখিয়েছে বাংলাদেশের শিল্পখাত। রোববার (১১ জুলাই) শিল্প সুরক্ষা সম্পর্কিত এক ওয়েবিনারের আলোচনায় যুক্ত হয়ে এমন মন্তব্য করেন বিশেষজ্ঞরা।  

তারা উল্লেখ করেন যে, স্থানীয় বাজার ভিত্তিক ব্যবসায় জড়িত অধিকাংশ কারখানাই পর্যবেক্ষণের অভাবে সুরক্ষা মান অনুসরণ করে না। 

এসময় তারা রানা প্লাজা ধসের কথা উল্লেখ করে বলেন, ওই ট্র্যাজেডির পর বিদেশি ক্রেতাদের পক্ষ থেকে প্রবল চাপ থাকায় পোশাক খাত তাদের অধিকাংশ কারখানার অগ্নি, বৈদ্যুতিক ও কাঠামোগত সুরক্ষা বৈশ্বিক মান অনুসারে রূপান্তরিত করেছে। 

কিন্তু, ক্রেতা জোট অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ পেরিয়ে যাওয়ার পর দুর্ঘটনার সংখ্যা আবারও বাড়ছে। 

রপ্তানির বাইরে থাকা পোশাক খাত এবং অন্যান্য শিল্প দীর্ঘদিন ধরে নজরদারির বাইরে রয়েছে এবং সেকারণেই সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জে সেজান জুস কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকান্ড ঘটেছে বলে স্বীকার করেছেন আলোচনায় যুক্ত হওয়া উদ্যোক্তা ও বিশেষজ্ঞরা। 

'ইন্ডাস্ট্রিয়াল সেফটি অব দ্য আরএমজি সেক্টর ডিউরিং দ্য পোস্ট-অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্স পিরিয়ড' শীর্ষক ওই সংলাপের আয়োজন করে সিপিডি ও অলাভজনক জার্মান ফাউন্ডেশন ফ্রেডরিক এবার্ট স্টিফং- এফইএস।

সিপিডির ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা সৈয়দ মঞ্জুর ইলাহীর সভাপতিত্বে এ সময় তৈরি পোাশাক শিল্পের মালিক ও শ্রমিক পক্ষের প্রতিনিধি ছাড়াও উন্নয়ন সহযোগী ও আইএলও'র প্রতিনিধিরা শ্রম খাতে শ্রমিকের নিরাপত্তার বর্তমান অবস্থা এবং এ থেকে উত্তরনে তাদের মতামত তুলে ধরেন্। 

মঞ্জুর ইলাহী বলেন, পোশাক খাতে নিরাপত্তার বিষয়ে ক্রেতাদের চাপ থাকে। সেজন্য এখানে নিরাপত্তার বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়। আন্তর্জাতিক চাপ না থাকলে কমপ্লায়েন্স এবং নিরাপত্তায় উন্নতি করবো না – তাতো হতে পারে না। এ ধরনের নিরাপত্তা যারা নিশ্চিত করবেন, তাদেরও দায়িত্ব রয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। 

সিপিডির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, রানা প্লাজার ঘটনা নিরাপত্তা রক্ষার যে শিক্ষা দিয়েছে, পোশাকের বাইরে অন্যান্য খাত সেই শিক্ষা নিয়েছে কি? উত্তর হলো, না। পোশাকের বাইরে রপ্তানিমুখী অন্যান্য শিল্প এবং স্থানীয় শিল্পের নিরাপত্তায় এখনও নজরদারির ওপর গুরুত্ব দেন তিনি।

বিজিএমইএ প্রেসিডেন্ট ফারুক হাসান বলেন, অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের নজরদারিতে পোশাক শিল্প অভূতপূর্ব উন্নতি অর্জন করেছে। বর্তমানে স্থানীয় আরএমজি সাস্টেইনেবল কাউন্সিল (আরএসসি) এসব বিষয় দেখাশোনা করছে। 

তিনি জানান, চলমান কোভিড-১৯ মহামারির কারণে আরএসসি মাত্র সাত মাস তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পেরেছে।  

বিজিএমইএ প্রেসিডেন্ট বলেন, সকলের সহায়তায় তারা পোশাক শিল্পে নিরাপত্তা নিয়ে আরও বেশি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে চান।

বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনর (বিকেএমইএ) ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ হাতেম বলেন, সেজান কারখানার ঘটনা দেখিয়েছে, আমরা এতদিন পোশাক খাত নিয়েই ভেবেছি, অন্য খাত নিয়ে নয়। এই ঘটনার পর সময় এসেছে পোশাক খাতের বাইরে স্থানীয় অন্যান্য শিল্পকে নিরাপত্তার আওতায় আনার। স্থানীয় শিল্পগুলোর ৯০ শতাংশই সেফটির বিষয়ে কনসার্ন নয়।
 
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাতেমা খাতুন বলেন, অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের উদ্যোগের ফলে পোশাক খাতের অগ্রগতিতে অনেক উন্নতি যুক্ত হয়েছে। কিন্তু, সম্প্রতি বেশকিছু শিল্প দুর্ঘটনা দেখা দেওয়ায় প্রশ্ন উঠেছে, অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের মাধ্যমে অর্জিত অগ্রগতি আমরা ধরে রাখতে পারছি কিনা।

কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক মো. নাসির উদ্দিন আহমেদ বলেন, ৯০ লাখ নিবন্ধিত কারখানা, দোকান ও প্রতিষ্ঠানের বাইরে আরো প্রায় সাড়ে চার লাখ প্রতিষ্ঠান নিবন্ধনের বাইরে রয়ে গেছে। প্রতিষ্ঠানগুলো সঠিকভাবে পরিদর্শনের ক্ষেত্রে তাদের জনবলের ঘাটতির বিষয়টি তুলে ধরেন তিনি। 

এব্যাপারে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের সোশ্যাল কমপ্ল্যায়েন্স অ্যান্ড সেফগার্ডিং বিভাগের পরিচালক জেনেফা জব্বার বলেন, "সম্মিলিত চাপ না দিলে শ্রমিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা যাবে না।"

শ্রমিক নেতা জে. এম. কামরুল আনাম বলেন, একাধিকবার তাগাদা দেওয়া সত্ত্বেও সরকার রেমিডিয়েশন কো-অর্ডিনেশন সেল (আরসিসি) এবং আরএমজি টেকসই পরিষদ (আরএসসি) এর সাথে কোনও বৈঠক ডাকেনি।

বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার্স সলিডারিটির প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক কল্পনা আক্তার বলেছেন, সরকারী দপ্তরগুলোর সামর্থ্যের অভাবে অ্যাকর্ড এবং অ্যালায়েন্স সুরক্ষার জন্য কাজ করতে এসেছিল। তবে সরকারি দপ্তর এবং আরএমজি খাতের সংস্থাগুলো উভয় সংস্থার সাথে দূরত্ব বজায় রেখেছে, তিনি যোগ করেন।   

শ্রমিক নেতা বাবুল আক্তার বলেছেন, দেশের আইন অনুযায়ী কারখানার মালিকদের কাজের জায়গায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব রয়েছে।
শিল্প সুরক্ষা নিয়ে সিপিডির গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। 

তিনি বলেন, প্রায় চার হার পোশাক কারখানার মধ্যে এখনো প্রায় ২২.৫% কারখানার কোন ধরণের ধরনের ইনস্পেকশনের বাইরে রয়ে গেছে। 

প্রতিবেদনে তিনি দেখান, ২০১৩ সালে রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর পোশাক খাতের নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নয়নে অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের কার্যক্রমের কারণে এ খাতের শ্রম নিরাপত্তায় উন্নতি হয়েছিল। তবে একই সময়ে সরকার গঠিত ন্যাশনাল ইনিশিয়েটিভ ও রেমিডিয়েশন কো-অর্ডিনেশন সেল (আরসিসি) এর কার্যক্রমে প্রত্যাশিত অগ্রগতি হয়নি। এছাড়া, অ্যাকর্ডের কার্যক্রম শেষ হওয়ার পর গঠিত আরএমজি সাসটেইনেবল কাউন্সিল (আরএসসি) এর কিছু দুর্বলতাও তিনি তুলে ধরেন।

প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, মে ২০১৮ থেকে এপ্রিল ২০২১ সালের মধ্যে সংবাদপত্রের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে পোশাক কারখানায় মোট ৪৬টি দুর্ঘটনা ঘটেছে; যা সময়ের সাথে সাথে সংখ্যা বাড়ার ইঙ্গিত দেয়।

ডাঃ মোয়াজ্জেম আরও ব্যাখ্যা করেছেন যে, ২০১৯ অর্থবছরের তুলনায় ২০২০ অর্থবছরে দুর্ঘটনার সংখ্যা ১০০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং তারপরে ২০২১ অর্থবছরে (চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত) ২০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।

আগুন, শর্ট-সার্কিট, কাঠামোগত পতন, বয়লার বিস্ফোরণের মতো বিভিন্ন কারণে এই দুর্ঘটনাগুলি ঘটেছিল। আগুন এবং বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট ছিল প্রধান কারণ; যা মোট ঘটনার ৩৫ শতাংশ, তিনি যোগ করেন।
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.