পাহাড়ি কৃষি গবেষণায় দেশীয় প্রথম কফি
বাংলাদেশ
দেশীয় কফির নতুন জাত উদ্ভাবন করেছেন খাগড়াছড়ির পাহাড়ি কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা। এই কফির নামকরণ করা হয়েছে 'বারি কফি-১'। সব ঠিকঠাক থাকলে আগামী দুই মাসের মধ্যে এই জাতটির অনুমোদন পাওয়া যাবে বলে আশা করছেন গবেষণা প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা।
অনুমোদন মিললে এটিই হবে দেশীয় কফির প্রথম জাত। এরই মধ্যে গবেষকরা কফির সংগৃহীত জার্মপ্লাজম থেকে মূল্যায়নের মাধ্যমে রোবাস্তা কফির অগ্রবর্তী লাইন চিহ্নিত করেছেন। একই সঙ্গে জাত সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের পর সমন্বয় করে তা মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর উদ্যোগও নিয়েছেন।
উদ্যান ও মাঠ ফসলের প্রযুক্তি বিস্তার প্রকল্পের পরিচালক এবং সবজি বিজ্ঞানী ড. মোঃ আবু তাহের মাসুদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'রোবাস্তা প্রজাতির এই কফিটি বেশ উন্নত একটি জাত। সারাবিশ্বেই এর তুমুল জনপ্রিয়তা রয়েছে। এটি চাষাবাদের জন্য পার্বত্য এলাকা বেশ উপযোগী। পাহাড়ি এলাকায় দ্রুততম সময়ের মধ্যেই এর ফলন হয়। এখানে পোকার উপদ্রবও কম হয়, ফলে ফলনও হয় বেশ ভালো।
খুব শীঘ্রই এটি অনুমোদনের জন্য কৃষি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে বলে জানিয়েছেন এই বিজ্ঞানী। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় যাচাই-বাছাই শেষে অনুমোদন দেবে, এটা মোটমুটিভাবে নিশ্চিত। এরপরই উন্মুক্ত করা হবে 'বারি কফি-১'।
জানা গেছে নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকেই খাগড়াছড়ির পাহাড়ি কৃষি গবেষণাকেন্দ্রে কফির ৪০টি চারা দিয়ে গবেষণা শুরু হয়। ওই সময় খুব বেশি গবেষণার তেমন অগ্রগতি হয়নি। তবে গত পাঁচ থেকে সাত বছরে কফি চাষের বেশ অগ্রগতি হয়েছে।
বিশ্বে ৬০ প্রজাতির কফি থাকলেও বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদযোগ্য প্রজাতি মাত্র দুটি। সেগুলো হলো 'কফি রোবাস্তা' ও 'কফি অ্যারাবিকা'। 'রোবাস্তা' জাতের কফি বাংলাদেশের আবহাওয়ার জন্য খুব উপযোগী। এটি সাধারণত সমুদ্র থেকে ৫০০-১০০০ মিটার উচ্চতায় এবং ১০০০-২০০০ মিলিমিটার বৃষ্টিতে ভালো ফলে। এরমধ্যে বাংলাদেশের পার্বত্যাঞ্চল ও টাঙ্গাইলের মধুপুরগড়ের আবহাওয়ায় এটি সম্প্রসারণ সম্ভব।
প্রক্রিয়াজাতকরণ মেশিন উদ্ভাবন
খাগড়াছড়ি পাহাড়ি কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মুন্সী রাশীদ আহমেদ বলেন, "এ দেশে কফি চাষ কৃষকের মধ্যে জনপ্রিয় না হওয়ার অন্যতম কারণ এর প্রক্রিয়াজাত ও বাজারজাত করার সমস্যা। এই সমস্যা সমাধানে এরই মধ্যে চার ধরনের প্রক্রিয়াজাতকরণ যন্ত্র তৈরি করেছে প্রকৌশলীরা। যন্ত্রগুলো হলো- কফি পালপার মেশিন, ডি-হলার, রোস্টার এবং ব্রাইন্ডার যা খুবই স্বল্প মূল্যে ক্রয় করতে পারবেন কৃষকরা," বলেন তিনি।
"সবমিলিয়ে এক লাখ থেকে সোয়া লাখ টাকায় কেনা যাবে এসব যন্ত্র, যেখানে বিদেশ থেকে এসব যন্ত্র আমদানি করতে খরচ হয় প্রায় পাঁচ লাখ থেকে ছয় লাখ টাকা পর্যন্ত। এই যন্ত্রের মাধ্যমে খুব সহজেই প্রাথমিকভাবে প্রক্রিয়াজাত শেষে বাণিজ্যিকভাবে কফি বাজারজাত করতে পারবেন কৃষকরা। যা এই পার্বত্যাঞ্চলের চাষীদের জন্য নতুন মাইলফলক হয়ে থাকবে," যোগ করেন তিনি।
কফি চাষে সমৃদ্ধ হবে পার্বত্য অর্থনীতি
হলুদ, আম্রপালি, মাল্টা, আনারস, কলা ও কাঁঠালসহ নানা ফল-ফসলে সমৃদ্ধ পার্বত্য চট্টগ্রামের অর্থনীতি। আর সেই অর্থনীতিকে আরও চাঙ্গা করবে নতুন উদ্ভাবিত কফি, এমনটাই আশাবাদী কৃষি বিজ্ঞানীরা। আবাদ উপযোগী পাহাড়ি মাটি এবং পঁচনশীল না হওয়ায় কফি চাষে বেশ সম্ভাবনা দেখছেন তারা। এরই মধ্যে কফি চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন পাহাড়ের ছোট-বড় অনেক বাগান মালিক। ব্যক্তিগত উদ্যোগেও অনেকে কফির চারা রোপণ করছেন।
খাগড়াছড়ি শহরের অদূরে আলুটিলার একটি বাগান ঘুরে দেখা গেছে, রোবাস্তা জাতের কফির ৩৯৫টি গাছে থোকায় থোকায় ফল ধরেছে। যেগুলো পেকে খয়েরী বর্ণ ধারণ করেছে সেগুলোই ঝুড়িতে ভরছেন শ্রমিকরা। বিরুবালা ত্রিপুরা নামের এক শ্রমিক জানান, গত ডিসেম্বর থেকেই তারা পাকা কফি তুলতে শুরু করেছেন। এখন প্রায় শেষের পথে। এগুলো তুলে তারা পাহাড়ি কৃষি গবেষণা কেন্দ্রে দিয়ে আসবেন। সেখানেই প্রক্রিয়াজাত করা হবে।
পাহাড়ি কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের অধীন এই বাগানে 'অ্যারাবিকা' জাতের আরও ২০০টি চারা রোপণ করা হয়েছে বলে জানান বাগানের তত্ত্বাবধায়ক বলিন্দ্র ত্রিপুরা। তিনি বলেন, প্রতিটি গাছ থেকে এক মৌসুমে সাত থেকে আট কেজি কফিফল তোলা যায়। রোপণের পর তিন বছরের মধ্যেই ফুল আসতে শুরু করে। গত বছর তারা এই বাগান থেকে ৪৫০ কেজি কফি তুলতে পেরেছিলেন। এ বছরও এমন ফলন পাবেন বলে ধারণা করছেন তিনি।
এই বাগান ছাড়াও জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার সহায়তায় খাগড়াছড়িতে আরও সাতটি এবং সাজেকে তিনটি কফি বাগান সৃজন করা হয়েছে। প্রতিটিতেই এক হাজার করে কফির চারা রোপণ করা হয়েছিলো। ২০২২ সালের মধ্যে বাগানগুলো থেকে পুরোদমে ফলন পাওয়া যাবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কৃষি কর্মকর্তারা৷ কৃষকরা যদি যথাযথ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এই কফির আবাদ সম্প্রসারণ করতে পারেন তবে তা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে বলে মনে করছেন খাগড়াছড়ি পাহাড়ি কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মুন্সী রাশীদ আহমেদ।
তিনি বলেন, "কফি চাষে পাহাড় কিংবা অন্য ফসলের কোনো ক্ষতি হয় না। কফি মরু অঞ্চলের উদ্ভিদ হওয়ায় সহজেই মিশ্র ফসল হিসেবে বনজ উদ্ভিদের সঙ্গে হালকা ছায়ায় সেচহীন অবস্থায় চাষ করা যায়। এতে রোগবালাইয়ের আক্রমণ হয় না বললেই চলে। এছাড়া পোস্ট-হার্ভেস্ট প্রক্রিয়ায় এক বছরও রাখা যায় এই কফি,"
"তবে এই পোস্ট-হার্ভেস্ট প্রসেসিং করতে হয় খুব সাবধানে। এ জন্য প্রয়োজন যথাযথ প্রশিক্ষণ তাছাড়া বাজারজাত করার মতো কোনো প্রতিষ্ঠানও গড়ে ওঠেনি এখনো। ফলে কৃষকরা নিজ উদ্যোগেই তা বিক্রি করতে হচ্ছে। এই দুটি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারলে আগামী চার থেকে পাঁচ বছরের মধ্য দেশে কফির আমদানি কমানো সম্ভব হবে। দেশে উৎপাদিত কফি দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানিও করা যাবে। এজন্য বাজারজাতকরণে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তা, যথাযথ জ্ঞান, দক্ষতা ও উন্নতজাতের চারা প্রয়োজন।" যোগ করেন তিনি।
খাগড়াছড়ি চেম্বার অব কমার্সের পরিচালক সুদর্শন দত্ত বলেন, "যেহেতু এই অঞ্চলে কফি চাষের বাণিজ্যিক সম্ভাবনা রয়েছে তাই পরিকল্পনার মাধ্যমে খাগড়াছড়ি বিসিক শিল্প নগরীকে কাজে লাগানো যেতে পারে। এখানে একটি প্রক্রিয়াজাত কারখানা গড়ে তোলা সম্ভব হলে এই কফি ভবিষ্যতে পার্বত্য এলাকার অন্যতম একটি অর্থকরী ফসলে পরিণত হবে।"
Comments
While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.