নোয়াখালীতে তাণ্ডব: মামলায় অভিযুক্ত ও গ্রেপ্তারকৃতদের বেশিরভাগই কিশোর-তরুণ 

বাংলাদেশ

টিবিএস রিপোর্ট 
22 October, 2021, 11:15 pm
Last modified: 23 October, 2021, 10:10 am
জেলা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, মামলার আসামি, গ্রেপ্তার ও হামলায় অংশ নেওয়াদের বেশিরভাগই বয়সে নাবালক কিশোর ও তরুণ। এদের মধ্যে শিশুও আছে। 

নোয়াখালীতে গত শুক্রবার জুমার নামাজের পর বেশ কয়েকটি মন্দির ও হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িতে হামলার ঘটনায় পুলিশ এখন পর্যন্ত পুরো জেলায় অন্তত ১৩০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। 

জেলা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, মামলার আসামি, গ্রেপ্তার ও হামলায় অংশ নেয়া বেশিরভাগই বয়সে নাবালক কিশোর ও তরুণ। এদের মধ্যে শিশুও আছে। 

এদিকে, হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর হামলার ঘটনায় কুমিল্লা, ফেনী ও নোয়াখালী পরিদর্শন করে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-ও এমন তথ্য জানিয়েছে। 

টিবিএস'র প্রতিবেদকরা গত শুক্রবারের হামলার ঘটনার অন্তত ১২টি ভিডিও পর্যালোচনা, অর্ধশতাধিক প্রত্যক্ষদর্শীদের সাথে কথা বলেও এমন চিত্র পেয়েছেন। 

এছাড়া জিজ্ঞাসাবাদে এসব শিশু-কিশোররা পুলিশকে বলেছে, তারা অনেকেই পুরো ঘটনার বিষয়ে ওয়াকিবহাল নয়। তারা শুধু শুনেছে কোরআন শরীফের অবমাননা হয়েছে, শুধু এ কারণেই তারা উত্তেজিত হয়ে হামলা চালিয়েছে। 

পুরো জেলায়, বৃহস্পতিবার বিকেলে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত মোট মামলা হয়েছে ১৮টি, এসব মামলায় ২৮৫ জনকে এজাহারনামীয় আসামি করা হয়েছে। এর বাইরে, অন্তত ৫,৫০০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে। 

হত্যা, অগ্নিসংযোগ, হামলা ও ভাংচুরের ও পুলিশের কাজে বাধা দেয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে এসব মামলায়। তবে বিদ্বেষ ও ইচ্ছাকৃতভাবে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে মামলা এখনো করা হয়নি বলে নোয়াখালী আদালতকে জানিয়েছে পুলিশ।  

এসবের মূলে কি রাজনীতি কি না- এমন প্রশ্নে জেলার পুলিশ সুপার শহীদুল ইসলাম বৃহস্পতিবার দুপুরে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড'কে বলেন, আমরা এখনো এমন কিছু পাইনি।'তবে, আশ্চর্যজনকভাবে হামলায় অংশ নেয়া বেশিরভাগেরই বয়স ১৮-২০ বছর। এদেরকে মূলত ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। তবে, মূল হোতারা এলাকা থেকে পালিয়ে গেছে।' 

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের উপ-পরিচালক আবু আহমেদ ফয়জুল কবির বলেন, 'মব হলে, কিছু কিশোর-যুুবকদের আগে থেকে তৈরি করা হয়, এদেরকে মূলত হ্যামিলনের বাঁশিওলার মত ব্যবহার করা হয়েছে। এদের মেন্টর আছে, তাদেরকে খুঁজে বের করাটা জরুরি।' 

জেলার চৌমুহনীর শ্রী শ্রী রাধামাধব জিউর মন্দিরের ব্যবস্থাপক অনন্ত কুমার ভৌমিক বলছেন, শুক্রবার বেলা সোয়া দুইটা থেকে আড়াইটার মধ্যে আমাদের মন্দিরের লোহার গেট ভেঙ্গে শতাধিক লোক হুড়মুড় করে ঢুকতে থাকে। দূর থেকে পালিয়ে যতদূর দেখলাম সবাই ইয়াং, কম বয়সী বাচ্চা বাচ্চা ছেলেপেলে। একেক জন হাতে রামদা, চাপাতি, বাঁশ আর লাঠি নিয়ে কি তাণ্ডবটাই না চালালো, অথচ এদের বয়স আমার সন্তানের চেয়েও কম। 

ইসকন মন্দিরের সেবক দুরন্ত কিশোর শ্যামল দাস বলেছেন, যতন সাহা আর প্রান্ত দাস নামে যে দুজন ব্যক্তি তাদের মন্দিরে আক্রমণেকারীদের আঘাতে মারা যান,  তারা কেউই পরিণত কিংবা পূর্বণয়স্ক কারো আঘাতে মারা যাননি। 
 
তিনি বলেন, 'আমি গেটের সাথে থাকা ভবনের তৃতীয় তলা থেকে স্পষ্ট তাকিয়ে দেখছিলাম প্রান্ত দাসকে কয়েকটি ছেলে গলা চেপে পুকুরে ফেলে দিতে, আর যতন সাহাকে যারা আঘাত করেছে তারাও যুবকই ছিল, কম বয়স্ক।'

নোয়াখালীর পুলিশ সুপার টিবিএস'কে বলেন, হামলায় অংশ নেওয়া কিশোর-তরুণরা মূলত কয়েক গ্রুপে ভাগ হয়ে একই সাথে, পর পর বেশ কয়েকটি মন্দিরে হামলা চালায় যাতে পুলিশ একসাথে মোকাবেলা করতে না পারে। তারা মূলত ছোট-ছোট গ্রুপে ভাগ হয়ে একইসাথে একইসময়ে অন্তত ১০টি স্থানে হামলা-ভাংচুর চালিয়েছে।     

নোয়াখালীর নরোত্তমপুরের ইসকন মন্দিরের পাশের বাড়ির বাসিন্দা ৮৫ বছর বয়সী পুষ্পা রাণী দাস টিবিএস'কে বলেন, 'ছোট-ছোট বাচ্চাদের, আমার নাতি-নাতনির সন্তানদের সমান বয়সীদের দেখলাম মন্দিরে ভাংচুর করছে, মন্দিরের সেবক ও পাশের আরেকটি মন্দিরের বাসিন্দারের মারধার-জখমের মতো ঘটনা দেখলাম। আশ্চর্যের বিষয়, এরা বয়সে পরিণত নয়। এক আট বছরের শিশুকেও দেখলাম লাঠি নিয়ে তেড়ে আসছে। মুক্তিযুদ্ধেও এমন ছবি দেখিনি, এমন তরুণ প্রজন্ম নিয়ে দেশ কিভাবে সামনে এগোবে!' 

এদিকে, বেশ কয়েকজন কিশোর যাদের প্রকৃত বয়স ১৫-১৬ বছর, তাদেরকে মামলায় ১৮ বছর দেখানো হয়েছে বলে পরিবারের কাছ থেকে অভিযোগ পাওয়া গেছে। 

এদের একজন বেগমগঞ্জ উপজেলার আলাইয়াতপুরের মনির, তার বাবা জয়নাল আবেদীন বলেন, ওইদিন জুমার নামাজ পড়তে বড় মসজিদে গিয়েছিল মনির। তবে তার ছেলে হামলায় অংশ নিয়েছে বলে তার বিশ্বাস হয়না। 'এতটুকুন ছেলে, বয়স ১৫-১৬, অথচ পুলিশ বলছে তার বয়স ১৮। তাকে তো সংশোধন করার কথা, অথচ তাকে এখন জেল-আদালতের বারান্দায় জীবন পার করতে হবে।' 

গণিপুরের হানিফ নামে এক কিশোরকেও মামলাও আসামি করা হয়েছে, তার বাবা জাহাঙ্গীর আলমও একই অভিযোগ করেছেন। 

এর বাইরে লক্ষ্মীপুরে চর শামসুদ্দিন উপজেলার আব্দুর রশিদের ছেলে রাকিব ও চৌমহুনী পৌরসভার রশিদ মিয়ার দোকান এলাকার জসিম রিক্সা ড্রাইভারের ছেলে জসিমওকে একইভাবে মামলায় ১৮ বছর বয়স দেখানো হয়েছে।

এসব বিষয়ে, বেগমগঞ্জ থানা ও নোয়াখালী জেলা পুলিশের কেউ কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।  

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সাবিনা শারমিন বলছেন, বাংলাদেশে যে শিশু আইন আছে তাতে বলা হয়েছে ১৮ বছরের নিচে সকলে শিশু বা কিশোর বলে গণ্য হবে। 

'এই আইনেই বলা আছে যে, শিশু-কিশোরদের প্রাপ্তবয়স্কদের সাথে বিচার হবে না, তাদের বিচার হবে আলাদা শিশু আদালতে, ওদেরকে অপরাধীও বলা যাবে না। তাদের জন্য টার্মও ভিন্ন হবে, বিচার প্রক্রিয়াও ভিন্ন হবে। এদেরকে গ্রেপ্তার করা হলেও সাধারণ জেল-হাজতে রাখা যাবে না।' 

মামলাগুলোর তদন্তের সাথে নিবিড়ভাবে যুক্ত থাকা কয়েকজন কর্মকর্তা টিবিএস'কে বলেছেন, ঘটনার দিন শুক্রবার হওয়ার চৌমুহনী শহরের বেশিরভাগ দোকানপাট ছিল বন্ধ। এছাড়া বাজারটির চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের পর এই বিভাগে সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার। বাজারে প্রচুর টোকাই, ভবঘুরে ও শ্রমিকরা কাজ করে, মূলত এদেরকে উত্তেজিত করে হামলা করানো হয়। যার একটা বড় অংশই কিশোর-তরুণ। 

তবে অভিযুক্তদের অপরিণত বয়সের কথা উল্লেখ করে, অধ্যাপক সাবিনা শারমিন আরও বলেন, 'এই এইজ গ্রুপটা হচ্ছে ভালনারেভল, মোটিভেট করা সহজ। আর ওরা নিজেরাও হিরোগিরি দেখাতে যায়, হুজুগ তুলে বললেই হয়- এই চল যাই। স্লোগানেই কাজ হয়ে যায় ওদের। সাহস দেখানোর প্রবণতা এই বয়সীদের মধ্যে বেশি কাজ করে। সব সময় খুব একটা বিবেচনা করে কাজ করে- তাও না। হুজুগেই অনেক সময় চলে যায়। এর পরিণতি কী হবে ওই মুহূর্তে আসলে ওরা ভাবে না। তবে, শুধু কিশোর-তরুণদের ধরলেই হবে না, যারা এদেরকে উত্তেজিত করেছে, বাধ্য করেছে তাদেরকেও আইনের আওতায় আনতে হবে।'   
 
এদিকে, হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা-ভাংচুরের মামলায় এখন রাজনৈতিকভাবে বিএনপি ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের জড়ানো হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন বেগমগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতি কামাক্ষ চন্দ্র দাস। তিনি বলেছেন, এসব মামলায় তাদের অন্তত শতাধিক নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে, যাদের বেশিরভাগই ঘটনার সময় কোনভাবেই চৌমুহনী ও আশপাশের এলাকায় ছিলেন না। 

তবে এমন অভিযোগ অস্বীকার করে জেলার পুলিশ সুপার শহীদুল ইসলাম বলেন,  আমরা অপরাধীদের ধরছি, এখন কে কোন দলের সেটা তো আমাদের দেখার বিষয় নয়। আর আমরা কারো রাজনৈতিক পরিচয় দেখে কাউকে গ্রেপ্তার করছি না।

 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.