নোয়াখালীতে খোলা আকাশের নিচে নষ্ট হলো ৪ কোটি টাকার সরকারি মেশিন

বাংলাদেশ

19 June, 2021, 10:55 am
Last modified: 19 June, 2021, 11:00 am
সড়কের পাশে অরক্ষিতভাবে পড়ে থাকায় গাড়ীগুলোর যন্ত্রাংশ খুলে নিয়ে গেছে লোকজন, একটি গাড়ীর মধ্যে গড়ে উঠেছে অস্থায়ী চা দোকান।
ছবি-টিবিএস

স্কিড স্টিয়ার লোডার, রোলার মেশিন, ছোট ট্রাকসহ কয়েকটি গাড়ীর যন্ত্রাংশ দীর্ঘদিন পর্যন্ত খোলা আকাশের নিচে পড়ে রয়েছে। কর্তৃপক্ষের রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবহারের অভাবে গত কয়েক বছরে নষ্ট হয়ে গেছে মেশিনগুলো। সড়কের পাশে অরক্ষিতভাবে পড়ে থাকায় গাড়ীগুলোর যন্ত্রাংশ খুলে নিয়ে গেছে লোকজন, চুরি হয়ে গেছে বড় বড় যন্ত্রাংশ। একটি গাড়ীর মধ্যে গড়ে উঠেছে অস্থায়ী চা দোকান। প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও সরকারি টাকা নষ্ট করে এ গাড়ীগুলো এনে এভাবে ধ্বংস করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয় সচেতন সমাজ।

এমন দৃশ্য দেখা গেছে নোয়াখালীর প্রথম শ্রেণির পৌরসভা চাটখিলে। চাটখিল পৌর কর্তৃপক্ষের এমন কর্মকাণ্ডে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন চাটখিল উপজেলা ও পৌরসভার সচেতন মানুষ।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত কয়েক বছরে পৌরসভা কর্তৃপক্ষের অবহেলায় নষ্ট হয়েছে ৭০ লাখ টাকা মূল্যের একটি স্কিড স্টিয়ার লোডার, তিনটি রোলার মেশিন যার প্রতিটির মূল্য ৩০ লাখ করে প্রায় ৯০ লাখ টাকা, ১ কোটি ২০ লাখ টাকা মূল্যের তিনটি ছোট ট্রাক।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, চাটখিল উপজেলা পরিষদ মসজিদের সামনে স্কিড স্টিয়ার লোডার মেশিনটি পড়ে আছে। স্থানীয়রা বলছে গত দুই বছর ধরে এ মেশিনটি একই স্থানে পড়ে আছে। কখনও একদিনের জন্য গাড়ীটি ব্যবহার হতে দেখেনি কেউ। এছাড়াও গাড়ীটি কি কাজে ব্যবহার করা হয় তাও তাদের জানা নেই। একই স্থান থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে দেখা যায়, পড়ে আছে আরও তিনটি ছোট ট্রাক। ট্রাকগুলোও দীর্ঘদিন পর্যন্ত ব্যবহার হচ্ছে না। যার ফলে চাকাসহ বেশ কিছু যন্ত্রাংশ মাটিতে মিশে যাওয়ার উপক্রম। তবে কর্তৃপক্ষ দাবি করছে দুটি ট্রাক ব্যবহার করার উপযোগী আছে। পৌর বাজারের চাটখিল মহিলা ডিগ্রী কলেজের সামনে পড়ে আছে একটি রোলার মেশিন। যার বেশিরভাগ যন্ত্রাংশই গাড়ীতে নেই।

এছাড়াও উপজেলা পরিষদ চত্বরে পড়ে আছে আরও একটি রোলার মেশিন। এটি নতুন ক্রয় করে আনার পর থেকে গত দুই বছর ধরে এখানে পড়ে আছে। একদিনও ব্যবহার হয়নি। আর পৌর শপিং কমপ্লেক্সের পাশে গত ১৫ বছর ধরে পড়ে থাকা অন্য একটি রোলার মেশিনকে ঘিরে গড়ে উঠেছে একটি চা দোকান।

মেশিনটি ঘিরে গড়ে উঠা চা দোকানি মোহাম্মদ ইব্রাহিমের সাথে কথা বললে তিনি জানান, গত ২০০৬ সাল থেকে রোলারটি এখানে পড়ে আছে। এই রোলারটি তার চা দোকানের ভিতরে আছে। যার ফলে এ গাড়ীটির যন্ত্রাংশগুলো এখনও আছে। তার দাবি দোকান না থাকলে মানুষজন অনেক আগেই যন্ত্রাংশ খুলে নিয়ে যেত।

পৌরসভার একাধিক বাসিন্দা জানান, পৌরসভার একাধিক স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সরকারি মেশিনগুলো দীর্ঘদিন পর্যন্ত পড়ে থাকার কারণে সরকারের কোটি কোটি টাকা যেমন নষ্ট হয়েছে, তেমনি পৌরবাসী বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। মেশিনগুলোর সঠিক ব্যবহার হলে পৌরসভার রাস্তাঘাট সহ অনেক পরিবর্তন হত বলেও মনে করছেন তারা।

পৌরসভার ২নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা আলা উদ্দিন বলেন, গত দুই বছর আগে তার বাসা থেকে ১০০ মিটার দূরে একটি অত্যাধুনিক নতুন স্টিড স্টিয়ার লোডার মেশিন রাখা হয়। যার বাজারমূল্য প্রায় এক কোটি টাকা বলে তিনি শুনেছেন। তবে এ গাড়ীটি কখনও ব্যবহার হতে দেখেন নি। বর্তমানে চাকাসহ গাড়ীটির বেশিরভাগ অংশই নষ্ট হয়ে গেছে। কোটি টাকা দামের গাড়ীটি ক্রয়ের পর ব্যবহার না করায় হতাশা প্রকাশ করেন তিনি।

মহিলা কলেজ এলাকার বাসিন্দা রুবেল মিয়া জানান, গত ৫ বছরের বেশি সময় ধরে তার দোকানের পাশে একটি ট্রাক অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। ট্রাকটি বৃষ্টিতে ভিজছে আর রোদে শুকাচ্ছে। তারই পাশে এক বছর ধরে পড়ে আছে একটি রোলার মেশিন। রোলারটির বসার সিট, হুইলসহ বিভিন্ন যন্ত্রাংশ ইতোমধ্যে চুরি হয়ে গেছে। গাড়ী দু'টি পৌরসভার হলেও কখনও এগুলো দেখতে পৌরসভার কোন কর্মকর্তা ও কর্মচারী আসেন নি।

স্থানীয় ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান বলেন, 'উপজেলা পষিদের ভিতরে আমার বাসা। দীর্ঘদিন ধরে উপজেলা মাঠের খোলা আকাশের নিচে তিনটি ট্রাক অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। প্রতিদিন এটার পাশ দিয়ে একাধিকবার আসা যাওয়া করি আমরা। ট্রাক তিনটির মধ্যে একটি মাঝে মাঝে ব্যবহার হলেও অপর দু'টি কয়েক বছর ধরে ব্যবহার করা হচ্ছে না'।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চাটখিল পৌরসভার সচিব আলতাফ হোসেন বলেন, 'স্কিড স্টিয়ার লোডার মেশিনটি পৌরসভার টাকা দিয়ে ক্রয় করা হয়নি। গত কয়েক বছর আগে মেশিনটি মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের পৌরসভায় পাঠানো হয়েছিল। মেশিনটি ব্যবহার না হওয়ায় নষ্ট হয়ে গেছে। বর্তমানে তা মেরামতের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করা হয়েছে। নির্দেশনা আসার পর আমরা কাজ শুরু করবো'। তিনটি ছোট ট্রাক ও তিনটি রোলারের নষ্ট হয়ে যাওয়া ও যন্ত্রাংশ চুরি হয়ে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি এর সঠিক কোন সদুত্তর দিতে পারেন নি।

চাটখিল পৌরসভার সাবেক মেয়র মোহাম্মদ উল্যাহ পাটোয়ারী জানান, 'স্কিড স্টিয়ার লোডার মেশিনটি আগ থেকেই এই স্থানে পড়েছিল। আমি পৌরসভার সচিবের মাধ্যমে গাড়িটির বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু চিঠির কোন উত্তর না আসায় আমরা গাড়িটির কোন সুরাহা করতে পারিনি'।

তিনি আরও জানান, দীর্ঘদিন অব্যবহৃত থাকার কারণে গাড়িটি অকেজো হয়ে গেছে।

চাটখিল পৌরসভার বর্তমান মেয়র মো. নিজাম উদ্দিন ভিপি সরকারের কোটি টাকার সম্পদ অযত্নে নষ্ট হয়ে যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে জানান, 'এগুলো আমার সময় নেওয়া হয়নি। মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর গত ফেব্রুয়ারি মাসে আমি পৌরসভার ক্ষমতা গ্রহণ করি। এ গাড়ীগুলো রাখার জন্য পৌরসভার নির্দিষ্ট কোন গ্যারেজ না থাকায় এখানে সেখানে পড়ে আছে। এসব গাড়ীর তালিকা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। নষ্ট হয়ে যাওয়া গাড়ীগুলো ও নির্দিষ্ট স্থানে গাড়ীগুলো রাখার বিষয়ে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে'। 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.