নদী ভাঙ্গনের গতি বাড়িয়েছে আম্পান, সকাল সন্ধ্যায় জোয়ার ঢুকছে লোকালয়ে

বাংলাদেশ

সানা উল্লাহ সানু, লক্ষ্মীপুর সংবাদদাতা
27 May, 2020, 10:40 pm
Last modified: 27 May, 2020, 11:02 pm
এখনো নদীতে ব্যাপক ঢেউ, সকাল সন্ধ্যায় জোয়ারে প্লাবিত হচ্ছে মেঘনা উপকূলবর্তী পুরো এলাকা।

মেঘনাপাড়ের বাড়ি থেকে ভেসে আসছিল কান্নার শব্দ। নারী-পুরুষের বুকফাটা আহাজারিতে চারপাশের বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। বাড়ির এক পরিবারকে প্রতিবেশি বাড়ির সদস্যরা বিদায় জানাতে গিয়ে এ কান্না। মেঘনা তীরে শূন্য পড়ে আছে ভাঙা ভিটে। ঘূর্ণিঝড় আম্পানের পর গত ২১ মে তারিখের লক্ষ্মীপুরের উপকূলীয় কমলনগর উপজেলার চর ফলকন গ্রামে এমন দৃশ্য চোখে পড়ে।

এর আগের দিন ঝড়ের প্রভাবে উত্তাল মেঘনার জোয়ার লোকালয়ে ঢুকে মেঘনা উপকূলকবর্তী এলাকার শামছুল হক (৭০) এর শত বছরের পুরনো বসত ভিটে ভেঙ্গে নিয়ে যায়। আম্পানের পর মেঘনা যে উত্তাল হয়েছে তা এখনো থামেনি। ভাঙ্গনের গতি বেড়েছে। এখনো নদীতে ব্যাপক ঢেউ, সকাল সন্ধ্যায় জোয়ারে প্লাবিত হচ্ছে মেঘনা উপকূলবর্তী পুরো এলাকা। 

শামছুল হকের মতো বহু লোক ঘর স্থানান্তরের প্রস্তুতি নিচ্ছে সবসময়। কথাগুলো জানাচ্ছিল, ওই এলাকার কলেজ ছাত্র মোঃ মাহবুবুর রহমান।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জেলার পাঁচ উপজেলার রামগতি এবং কমলনগর সরাসরি মেঘনা নদী দ্বারা বেষ্টিত। অপর উপজেলা লক্ষ্মীপুর সদর এবং রায়পুরের সামান্য কিছু অংশে মেঘনা প্রবাহমান। ১৯৭৬ সালে নির্মিত বেড়ি বাঁধের মাধ্যমে তিনটি উপজেলার বন্যা নিয়ন্ত্রণ, পানি নিষ্কাশন, শস্য উৎপাদন ও লবণাক্ত পানি প্রবাহ রোধ করা হচ্ছিল। কিন্তু ২০০৭ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় আইলার আঘাতে উক্ত পোল্ডারের রামগতি ও কমলনগর উপজেলার ৩৭ কিলোমিটার এলাকা মেঘনা নদীতে বিলীন হয়ে যায়। ক্ষত-বিক্ষত হয় লক্ষ্মীপুর অংশের ১৩ কিলোমিটার (মতিরহাট-মজুচৌধুরী হাট)। এরপর বেড়িবাঁধ না থাকায় রামগতি-কমলনগরে নদী ভাঙ্গন বেড়েছে। সদর অংশে নদী ভাঙ্গন তীব্র না হলেও ক্ষত বিক্ষত বেড়িবাঁধটি দীর্ঘদিন সংস্কার না হওয়ায় সামান্য জোয়ার লোকালয়ে ঢুকছে। 

অন্যদিকে জেলার রায়পুর উপজেলার চর বংশী এবং চর মোহনা এলাকায়ও বেড়িবাঁধ না থাকায় নদী ভাঙ্গন রয়েছে।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা জেমসের পরিচালক আসাদুজ্জামান চৌধুরী জানান, দুর্যোগ বর্ষপঞ্জির ১৫ মার্চ থেকে ঝড়ের মৌসুম শুরু হয়ে শেষ হয় ১৫ অক্টোবর। ফলে এ সাত মাস বিভিন্ন ধরনের দুর্যোগের মুখোমুখি হয় উপকূলের মানুষ। বেড়িবাঁধ না থাকায় এসময় বহু এলাকায় অতিরিক্ত জোয়ারের পানি ও জলোচ্ছ্বাসে ব্যাপক ক্ষতি হয়। শত শত একর জমির ফসল বিনষ্ট হয়। ওই সব এলাকায় জোয়ারের পানিতে রাস্তাঘাটের ব্যাপক ক্ষতি হয়। এ ছাড়াও বাড়ি ঘরে পানি ঢুকে চরম দুর্ভোগের সৃষ্টি হয়। এলাকা ছেড়ে চলে যেতে হয় বহু মানুষকে।

রামগতি উপজেলার চর বাদাম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোঃ জসিম মিয়া জানান, বর্ষা মৌসুমে মেঘনা নদীর ভাঙন ভয়াবহ রুপ নেয়। বর্ষা এলে মেঘনাপাড়ের ভাঙনে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে এলাকার মানুষ। বৃষ্টি বাড়লেই ভাঙন বাড়ে। বৃষ্টি ও জোয়ারের তীব্রতায় ভাঙন আরো ভয়াবহ রূপ নেয়।

পাটোয়ারীহাট এলাকার কলেজ ছাত্র মোঃ রাকিব হোসেন লোটাস জানান, আম্পানের পর প্রতিদনিই নদীর জোয়ারে এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। এখন মেঘনার সংযোগ খাল পাড়ের বাড়ি ঘরেও ভাঙন দেখা দিয়েছে।

এলাকাবাসীর সূত্রে জানা যায়, উপকূল রক্ষায় ২০১৪ সালের ৫ আগস্ট 'লক্ষ্মীপুরের রামগতি ও কমলনগর উপজেলা এবং সংলগ্ন এলাকাকে মেঘনা নদীর অব্যাহত ভাঙন থেকে রক্ষাকল্পে নদীর তীর সংরক্ষণ' প্রকল্প নামে এক হাজার ৩৫০ কোটি টাকার একটি প্রকল্পের অধীন ১৯৮ কোটি টাকা বরাদ্দ অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে পানি উন্নয়ন বোর্ড জুলাই ২০১৪ থেকে জুন ২০১৯ এর মধ্যে প্রকল্পটি সম্পূর্ণ করবে বলে নির্দেশনা ছিল। ওই প্রকল্পের অধীন রামগতি উপজেলায় সাড়ে চার কিলোমিটার এবং কমলনগর উপজেলায় এক কিলোমিটার নদীর তীর রক্ষায় বাঁধ নির্মাণ করা হয়।

অন্যদিকে প্রকল্পের আওতায় ২০১৭ সালের ১৪ মার্চ লক্ষ্মীপুরের জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রামগতি-কমলগর নদীর তীর রক্ষা বাঁধের দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজের ঘোষণা দেন। কিন্ত প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা ৩ বছর পরেও প্রকল্পের অবশিষ্ট অর্থ ছাড় হয়নি। ফলে আশপাশে পূর্ণাঙ্গ বাঁধ না থাকায় পূর্বের নির্মিত বাধঁগুলো এখন হুমকির সম্মুখীন।

এমতাবস্থায় স্থানীয়রা বলছে, পুরো প্রকল্প বাস্তবায়িত না হলে ১৯৮ কোটি টাকার বাঁধগুলো বিলীন হবে এবং অনেক লোকালয়ও থাকবে না।

এ বিষয়ে লক্ষ্মীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী ফারুক আহমেদ জানান, রামগতি-কমলনগর রক্ষায় ৩১ কিমি এলাকার জন্য নতুন করে ডেভলেপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপোজাল (ডিপিপি) তৈরি করে পানি উন্নয়ন বোর্ডে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে। তবে পূর্বের প্রকল্পের বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি। 

অন্যদিকে দীর্ঘ দিন কোন সংস্কার কাজ না করা লক্ষ্মীপুর সদর অংশের ১৩ কিমি এলাকার জন্য ভিন্ন আরেকটি ডিপিপি প্রনয়ন করছে বলে জানান পানি উন্নয়ন বোর্ডের এই কর্মকর্তা।

লক্ষ্মীপুর-৪ (রামগতি-কমলনগর) আসনের সংসদ সদস্য মেজর (অব:) আবদুল মান্নান বলেন, "সকল ঘূর্ণিঝড়েই রামগতি-কমলনগরে জোয়ার ঢুকে এবং নদী ভাঙ্গে। এলাকা রক্ষায় আমি বারবার চেষ্টা করে যাচ্ছি। নতুন প্রকল্পেটি অনুমোদন করা গেলে এলাকা রক্ষা করা সম্ভব হবে। কিন্ত এরই মধ্যে অতি প্রবল ভাঙ্গন কবলিত এলাকার জন্য ৯ কোটি টাকার একটি বরাদ্দে ১০টি পয়েন্টে বালুভর্তি জিও ব্যাগ ডাম্পিং প্রকল্প নেয়া হয়েছে।" 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.