ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত সাত কলেজের দুর্দশা

বাংলাদেশ

মীর মোহাম্মদ জসীম, জয়নাল আবেদিন শিশির
24 December, 2020, 03:00 pm
Last modified: 26 December, 2020, 03:33 am
শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, কোনো পক্ষ থেকেই এ সংকট সমাধান করে শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।

বাহার চৌধুরী এবং আকবর হোসেন দুজনই ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা কলেজের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদে ভর্তি হন। বাহার ২০১৮ সালের ডিসেম্বরেই মার্স্টার্স পরীক্ষা দিয়ে বর্তমানে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন। অন্যদিকে, আকবরের এখনো মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষাই হয়নি এবং পরীক্ষা কবে শেষ হতে পারে এনিয়ে তার ধারণাও নেই।

"ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত আমার বেশিরভাগ বন্ধুই চাকরি জীবনে প্রবেশ করেছে, কিন্তু আমার এখনো পড়াশোনাই শেষ হয়নি। একারণেই নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছি।" বলেন আকবর।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা কলেজের  ডিগ্রি সম্পন্ন করার মধ্যে সময়ের যে পার্থক্য দেখা যায়, ২০১৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত হওয়া অন্য ৬টি কলেজের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা দেখা যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সাত কলেজ কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদাসিনতার ফল ভোগ করছে সাত কলেজের হাজার হাজার শিক্ষার্থী। 

ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল সরকারি কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, সরকারি বাংলা কলেজ ও সরকারি তিতুমীর কলেজ - এ ৭টি প্রতিষ্ঠানে প্রায় আড়াই লাখ শিক্ষার্থী আছে।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে, ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষের ব্যাচেলর অব আর্টস (বিএ) শিক্ষার্থীদেরই এখনো চূড়ান্ত পরীক্ষা হয়নি। সাত কলেজের গুণগত উচ্চশিক্ষা ও সার্বিক উন্নয়নে এখনো কোনো পদক্ষেপ নেয়নি শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের সাধারণ পরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ গোলাম ফারুক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান,  সাত কলেজের শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়ন প্রকল্প এখনো আলোচনাতেই সীমাবদ্ধ আছে। "এনিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কোনো নথিপত্র তৈরি করেনি এখনো।" বলেন তিনি। 

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, রাজনৈতিক কারণেই সাত কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়। এতো বড় সংখ্যক শিক্ষার্থীদের দায়িত্ব নেয়ার কোনো প্রস্তুতিই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ছিলনা বলেও জানান তিনি। "এটি বাস্তবিকভাবেই সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয় বা শিক্ষাবিদদের সাথে আলোচনা না করেই সরকার অধিভুক্তিকরণের সিদ্ধান্ত নেয়। একারণেই প্রতিমুহূর্তে জটিলতা বাড়ছে।" বলেন তিনি।

ফলাফল বিপর্যয় 

২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষে ৭ কলেজের শিক্ষার্থীদের ফলাফলে ধস নামে। কবি নজরুল সরকারি কলেজের ইংরেজি বিভাগের ১০০ জন শিক্ষার্থীর মাত্র ১ জন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়,  সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের একই বিভাগের ৯৮ জন শিক্ষার্থীর মাত্র ২ জন উত্তীর্ণ হয়। অন্যান্য শিক্ষাবর্ষ ও বিভাগের ফলাফলও সন্তোষজনক ছিলনা,গড়ে মাত্র ২১ শতাংশ শিক্ষার্থী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।  

ঢাকা কলেজের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী মেহেদি হাসান টিবিএস-কে জানান, শিক্ষকরা পাঠ্যসূচির মাত্র ২৫ শতাংশ  শ্রেণিকক্ষে পড়ালেও তাদের সম্পূর্ণ পাঠ্যসূচিই শেষ করতে হয়। একারণেই তারা উত্তীর্ণ হতে পারেননি বলে জানান তিনি।

সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মোহসিন কবির টিবিএস -কে জানান, প্রশ্নের ধরণ ও মূল্যায়নের পদ্ধতি পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু নতুন পদ্ধতির সাথে শিক্ষার্থীদের প্রস্তুত করতে ব্যর্থ হয়েছে প্রশাসন।একারণেই বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেননি। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের একজন শিক্ষক জানান, ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী উত্তরপত্রে নিম্নমানের উত্তর দিয়ে থাকে। "প্রশ্নের নির্দিষ্ট উত্তরই না থাকলে আমরা কীভাবে নম্বর দিব?" প্রশ্ন রাখেন তিনি।

সাত কলেজে শিক্ষক স্বল্পতা 

বর্তমানে সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজে মাত্র ৭০ জন শিক্ষক আছেন, যেখানে সঠিকভাবে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনায় ২০৪ জন শিক্ষক থাকার কথা ছিল। শিক্ষক স্বল্পতার কারণে গুণগত শিক্ষার মান নিশ্চিত করা অসম্ভব হয়ে উঠছে বলে জানায় কলেজ প্রশাসন। একইভাবে, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজেও ২৫০ জন শিক্ষকের বদলে আছেন মাত্র ১৪৪ জন।

বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের উপাধ্যক্ষ অধ্যাপক সাবিকুন নাহার জানান, শিক্ষার গুনগত মান নিশ্চিত ও শিক্ষকের সংখ্যা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করছেন তারা।

শিক্ষক স্বল্পতার কারণে ভুগছে অন্য ৫টি কলেজও। সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মোহসিন কবির জানান, তিনি বেশ কয়েকবার প্রশাসনের কাছে শিক্ষকের সংখ্যা বৃদ্ধির আবেদন করলেও চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষকের সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়নি কখনোই।

পরীক্ষা সংক্রান্ত কার্যক্রমের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকবলের অভাব

সাত কলেজের দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই প্রশাসনিক ও পরীক্ষা সংক্রান্ত কার্যক্রম চালাতে লোকবলের অভাবে পড়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তাদের সূত্রে জানা যায়, সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনায় অন্তত ২৫০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর প্রয়োজন হলেও বর্তমানে মাত্র ৫০ জন একাজে নিয়োজিত আছেন।

গত বছর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের কাছে ২৪০টি নতুন পদের আবেদন জানালেও মাত্র ৩০টি পদের অনুমোদন দেয়া হয়। এই কার্যক্রম পরিচালনায় একটি ভবন প্রয়োজন হলেও মাত্র চারটি কক্ষেই যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালিত হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও এ সংকটের জন্য দায়ী, কারণ সংকট সমাধানে কোনো পদক্ষেপই নেয়নি কর্তৃপক্ষ। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামান টিবিএস-কে বলেন, সুষ্ঠুভাবে সাত কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা ও সংকট সমাধানে প্রশাসন কাজ করে যাচ্ছে।

গুনগত মান উন্নয়নে নেয়া উদ্যোগের অভাব  

শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, কোনো পক্ষ থেকেই এ সংকট সমাধান করে শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।

সাত কলেজের কর্তৃপক্ষ অভিযোগ তুলেছে, তারা বারবার শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনায় বসার পরও তেমন কোনো সাড়া পাননি।

সাত কলেজের সমন্বয়কারী ও কবি নজরুল সরকারি কলেজের অধ্যাপক আইকে সেলিম উল্লাহ খন্দকার টিবিএস-কে জানান, শিক্ষক স্বল্পতা, গ্রন্থাগার ও গবেষণাগার সহ নানা অবকাঠামোর অভাবে ভুগছে সাত কলেজ দীর্ঘদিন ধরেই। "সাত কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম উন্নয়নের প্রকল্প হাতে নেয়ার জন্য বেশ কয়েকবার আমরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছি, তবে কোনো ফলই পাইনি।" বলেন তিনি।

ইতিবাচক পরিবর্তন 

কামাল উদ্দিন ২০০৯ সালে ঢাকা কলেজ থেকে মাস্টার্সে উত্তীর্ণ হন। তিনি মাত্র ১২ টি ক্লাসে অংশ নিয়েছেন এবং কখনোই গ্রন্থাগারে প্রবেশ করেননি। পরীক্ষার আগে নীলক্ষেতের বইয়ের দোকান থেকে গাইড কিনে পরীক্ষার আগের রাতে সেগুলো পড়েই পরীক্ষা দিতেন।

ক্লাসে অংশ না নিয়েই ও গ্রন্থাগারে না গিয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের বিষয়টি কলেজগুলোতে বিদ্যমান শিক্ষার মান ও মূল্যায়নকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। 

তবে শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য কিছু পদক্ষেপও নিয়েছে কলেজ প্রশাসন। ৭০ শতাংশের কম উপস্থিতির ক্ষেত্রে জরিমানা নির্ধারণ করা হয়েছে। গাইড বইয়ের বদলে বিষয়ভিত্তিক বই পড়ছেন এখন শিক্ষার্থীরা।

সরকারি তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী সাইফ উদ্দিন জানান, " এখন আমাদেরকে নিয়মিত ক্লাসে অংশ নিতে হয় এবং আগের চেয়ে বেশি পড়াশোনা করতে হয়। আমরা ভেবেছিলাম পরীক্ষার আগে কয়েকদিন পড়েই উত্তীর্ণ হয়ে যাবো, যা এখন আর সম্ভব নয়।"

অধ্যাপক আইকে সেলিম উল্লাহ খন্দকার জানান, বর্তমানে  ৬০-৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী নিয়মিত ক্লাস করছেন।

শিক্ষার্থী আন্দোলন 

দেশের কলেজগুলোর স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের পাঠ্যসূচীর আধুনিকায়ন ও উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৯৯২ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এর আগে সরকারি কলেজগুলোর কার্যক্রম বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত হতো। সেসময়ও সাত কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ছিল।

২০১৭ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি সাত কলেজ আবারও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয়। সকল সরকারি কলেজগুলোকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নিয়ে আসার লক্ষ্যেই এ সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও এ পরিকল্পনা পরে আর বাস্তবায়িত হয়নি।

কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই সাত কলেজের পুণরায় অধিভুক্তকরণের কারণে শিক্ষা জীবনে নানা সমস্যার মুখে পড়তে থাকে শিক্ষার্থীরা। অধিভুক্তকরণের ৫ মাস পরও পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা হয়নি। ২০১৭ সালের জুলাই মাসে পরীক্ষার তারিখ ঘোষণার দাবিতে শাহবাগে আন্দোলন শুরু করে সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা। 

আন্দোলনে পুলিশের টিয়ার গ্যাস ও লাঠির আঘাতে চোখ হারিয়েছেন সরকারি তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী সিদ্দিকুর রহমান।আন্দোলনে সিদ্দিকুরের চোখ হারানোও সাত কলেজ সংকটের সমাধান করতে পারেনি।

সেশনজট, পরীক্ষার নির্ভুল ফলাফল, তাদের জন্য প্রশাসনিক ভবন নির্মান, সঠিক সময়ে পরীক্ষা নেয়া ও পরীক্ষার ফলের ন্যায্য মূল্যায়নের দাবিসহ নানা দাবিতে ২০১৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত একাধিকবার রাস্তায় নেমেছে সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা। 

অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন জানান, শুধু সরকারের কেন্দ্রীয় নীতিই শিক্ষার্থীদের দাবি পূরণ করে শিক্ষার মান নিশ্চিত করতে পারে। তবে একাজে সরকারকে অবশ্যই বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের সাথে আলোচনা করতে হবে বলেও জানান তিনি।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.