ঢাকার দুই সিটির ৩৭টি ওয়ার্ডে নেই কোনো খেলার মাঠ কিংবা পার্ক 

বাংলাদেশ

18 June, 2021, 03:10 pm
Last modified: 18 June, 2021, 04:21 pm
খেলার মাঠ, পার্ক এবং খোলা জায়গার সংকট শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
  • দুই সিটির ১২৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৩৭টিতে নেই কোন খেলার মাঠ কিংবা পার্ক
  • প্রয়োজনের তুলনায় মাঠের জমি আছে মাত্র ২৪ শতাংশ
  • প্রয়োজনের তুলনায় পার্কের জমি আছে মাত্র ১৬ শতাংশ
  • বাড়ির ছাদকে শিশুদের জন্য খেলার স্থান হিসেবে তৈরি করার পরামর্শ গবেষকদের
  • দুই সিটি সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেবে বলে জানিয়েছে

ক্রমবর্ধমান নগরায়নের ফলে রাজধানীতে খেলার মাঠের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে। এটি শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে বলে সতর্ক করেছেন মনোবিজ্ঞানীরা।

তাদের মতে, খেলার মাঠ, পার্ক এবং খোলা জায়গার সংকট কিশোর অপরাধ বৃদ্ধির সাথে নিবিড়ভাবে জড়িত।

সংশোধিত ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) প্রণয়নের অংশ হিসাবে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের ১২৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৩৭টিতে কোন খেলার মাঠ কিংবা পার্ক নেই।

ঢাকার পরিসর বিবেচনা করে, পার্ক এবং খেলার মাঠের জন্য যথাক্রমে ১,১৩৭ একর এবং ১,৮৭৬ একর এলাকা বরাদ্দ রাখা উচিত।

ছবি-সালাহউদ্দিন আহমেদ/টিবিএস

অথচ পার্ক আছে মাত্র ২৭১ একর জায়গা জুড়ে এবং খেলার মাঠে জন্য রয়েছে কেবল ২৯৪ একর।

এই পার্ক এবং খেলার মাঠগুলোর  বেশিরভাগেরই অবস্থা শোচনীয়। অধিকাংশই উন্মুক্ত নয়। যেগুলো সবার জন্য উন্মুক্ত সেখানে আবার খেলার উপযোগী ব্যবস্থা নেই। পার্কের চারপাশ আগাছায় পূর্ণ এবং সামান্য বৃষ্টিতেও পানি জমে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করে।

জরিপ অনুযায়ী, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) ৫৪টি ওয়ার্ডের মধ্যে মাত্র ১৬টি ওয়ার্ডে এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) ৭৫টি ওয়ার্ডের মধ্যে মাত্র ৭টি ওয়ার্ডে খেলার মাঠ ও পার্ক রয়েছে। যার মধ্যে ৭টি ওয়ার্ডের পার্কের পরিমাণ যৎসামান্য।

ডিএনসিসির ১১ নং ওয়ার্ডে মাত্র ০.২২ একর, ২৬ নং ওয়ার্ডে ০.১০ একর, ২৯ নং ওয়ার্ডে ০.৬১ একর, ৩৬ নং ওয়ার্ডে ০.৩৩ একর এবং ডিএসসিসির ১০ নং ওয়ার্ডে মাত্র ০.০৬ একর, ১৯ নং ওয়ার্ডে ০.১৯ একর, ৩৬ নং ওয়ার্ডে ০.০৭ একর পার্ক রয়েছে।

ছবি-সালাহউদ্দিন আহমেদ/টিবিএস

এছাড়া দুই সিটি কর্পোরেশনের ১৮টি ওয়ার্ডে খেলার মাঠের পরিমাণ এক একরেরও কম। ডিএনসিসির ৪৬ নং ওয়ার্ডে মাত্র ০.৬৩ একর, ৫০ নং ওয়ার্ডে ০.৪৪ একর এবং ডিএসসিসির ৩৮ নং ওয়ার্ডে ০.০৯ একর, ৪০ নং ওয়ার্ডে ০.৩১ একর, ৪৯ নং ওয়ার্ডে ০.৩২ একর, ৭০ নং ওয়ার্ডে ০.১৬ একর জায়গায় খেলার মাঠ রয়েছে।

ডিএসসিসির ২, ৩, ১৬, ২৫, ২৮, ৩৪, ৩৫, ৩৭, ৪৬, ৪৮, ৫০, ৫১, ৫২, ৫৩, ৫৪, ৫৫, ৫৬, ৬০, ৬১, ৬২, ৬৪, ৬৭, ৭১, ৭২, ৭৩, ৭৪ ও ৭৫- এ ২৭টি ওয়ার্ডে মাঠ কিংবা পার্ক কিছুই নেই। এছাড়া ডিএনসিসির ২১, ২৩, ২৫, ৩০, ৩৫, ৩৭, ৩৮, ৩৯, ৪১ এবং ৪৭ নং- এ ১০টি ওয়ার্ডেও নেই কিছুই।

দুই সিটি কর্পোরেশনের এ ৩৭ টি ওয়ার্ডের বাসিন্দারা কেউই পাচ্ছে না মাঠ ও পার্কের সেবা।

ছবি-সালাহউদ্দিন আহমেদ/টিবিএস

নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, বিদ্যমান পার্ক ও খেলার মাঠ সংস্কারের পাশাপাশি জমি অধিগ্রহণের মাধ্যমে মেগা প্রকল্পের আওতায় নতুন এবং ওয়ার্ড ভিত্তিক খেলার মাঠের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ছাড়া এখন আর বিকল্প নেই।

মাত্র কয়েকটি মাঠের সংস্কার সাধন হয়েছে।  এসব মাঠেরও বেশিরভাগ জুড়ে নির্মাণ সামগ্রী ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকায় শিশু-কিশোরেরা সেখানে খেলতে পারে না। অধিকাংশ শিশুকে বাড়িতেই সময় কাটাতে হচ্ছে; নির্জন পড়ে থাকছে মাঠগুলো।

মধ্য বাড্ডার বাসিন্দা সমীরন বেগম বলেন, "আমার বাড়ির কাছে কোনও খেলার মাঠ বা পার্ক নেই।" 

মাঝে মাঝে নিজের আট বছরের শিশুকে বাইরে নিয়ে গেলে তারা সড়কেই হাঁটাহাটি করেন। তিনি বলেন, বাচ্চারা সারাদিন বাসায় থাকলে দম বন্ধ হয়ে হাঁপিয়ে উঠবে।

ছবি-সালাহউদ্দিন আহমেদ/টিবিএস

বিভিন্ন এলাকার কিশোর-তরুণেরা শুক্র ও শনিবার সকালে আগারগাঁওয়ের বাণিজ্য মেলা ভেন্যুতে খেলতে যায়। সেখানে তারা ক্রিকেট এবং ফুটবল খেলে থাকে, যদিও তবে খেলার জন্য খুব স্বল্প পরিসরের জায়গাই বরাদ্দ সেখানে।

বন্ধুদের সাথে ধানমন্ডি থেকে খেলতে আসা তানিব জানান, তাদের খুব ভোরে এসে খেলার জন্য এখানে জায়গা দখলে নিতে হয়। নাহলে কিছুক্ষণ পরেই অন্যান্যদের  ভিড় জমে যায়।

আবার কাজিপাড়া থেকে সেখানে খেলতে যাওয়া জুয়েল খান জানান, মাঠের আশেপাশে নির্মাণ সামগ্রী পড়ে থাকায় প্রায়ই দেখা যায় কেউ না কেউ আহত হন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, যে কোনও শহরের প্রতিটি ব্যক্তির জন্য প্রায় নয় বর্গমিটার খোলা জায়গা প্রয়োজন এবং এই খোলা জায়গা হওয়া উচিত পার্ক বা খেলার মাঠ। অথচ ঢাকা শহরে এই স্থানের পরিমাণ ব্যক্তিভেদে এক বর্গমিটারেরও কম।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাম্প্রতিক জরিপে বলা হয়েছে, দুই সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন অঞ্চলে বসবাসরত প্রায় আড়াই কোটি মানুষের জন্য কমপক্ষে ২ হাজার পার্ক এবং ৪ হাজার খোলা মাঠ প্রয়োজন এবং তাদের ক্ষেত্রের পরিমাণ ন্যূনতম এক একর হওয়া উচিত।

তবে সিটি কর্পোরেশন দ্বয়ের অধীনে কেবল ২৩৫টি খেলার মাঠ রয়েছে এবং এর মধ্যে ১৪১টিই প্রাতিষ্ঠানিক মাঠ। মাত্র ৪২টি খেলার মাঠ জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত। এছাড়াও ১৭ সরকারী মাঠ, ২৪টি আবাসিক কলোনী মাঠ এবং ১২টি ঈদগাহ রয়েছে।

সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, মেয়েদের জন্য কোনও খেলার মাঠ নেই। মেয়েরা মাত্র ৭% মাঠে খেলতে পারে।

ছবি-সালাহউদ্দিন আহমেদ/টিবিএস

নগর পরিকল্পনাবিদ এবং গবেষকরা জানান, খেলার জন্য নির্ধারিত স্থান আধা মাইল দূরে থাকলেই অভিভাবকেরা তাদের সন্তানদের আর খেলতে পাঠাতে চান না। তাছাড়া যেসব মাঠে বড় রাস্তা বা প্রধান সড়ক পার হয়ে যেতে হয়, সেখানে শিশুরা নিজেরাও খেলতে যেতে নিরাপদ বোধ করে না। ফলে বাড়ির নিকটবর্তী স্থানে খেলার মাঠ তৈরী করাটা খুব দরকার।

নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মাহমুদ খান বলেন, পুরুষ ও নারী উভয়ের জন্যই বয়স ভিত্তিক খেলার মাঠ তৈরি করা জরুরী; পাশাপাশি শিশু ও নারীদের জন্য থাকা উচিত পৃথক খেলার মাঠ।

তিনি বলেন, প্রতিটি ওয়ার্ডে মেয়েদের জন্য কমপক্ষে একটি খেলার মাঠ থাকতে পারে এবং এর জন্য সরকারী বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজের মাঠকে প্রাধান্য দেয়া যেতে পারে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসএসসি)  মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, ডিএসসিসি প্রতিটি ওয়ার্ডে অন্তত একটি খেলার মাঠ তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে।

তিনি বলেন, প্রয়োজনীয় স্থান সংকুলান না করা গেলে কর্পোরেশন দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অংশ হিসাবে এটি বাস্তবায়ন করবে।

মেয়র বলেন "আমরা ইতিমধ্যে বিভিন্ন ওয়ার্ডের অধীনে পাঁচটি জায়গায় খেলার মাঠ এবং পার্ক তৈরির উদ্দেশ্যে জমি বরাদ্দ নিয়েছি। বেশ কয়েকটি খেলার মাঠ এবং পার্ক আধুনিকীকরণ করা হয়েছে এবং এ তালিকায় আরও কিছু পার্ক-খেলার মাঠ রয়েছে"।  

ডিএসসিসি সূত্র থেকে জানা যায়, ডিএসসিসির ১৮টি পার্কের মধ্যে ১১টি প্রস্তুত রয়েছে এবং তন্মধ্যে ১০টি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। এছাড়াও ১০টি খেলার মাঠের মধ্যে তিনটির নির্মাণ সম্পন্ন করা হয়েছে।  বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে বাসাবো বালুর মাঠ এবং ভূঁইয়া মাঠ প্রকল্পের কাজ চলছে।

এদিকে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব) ডিএসসিসি এলাকায় একটি খেলার মাঠ কাজের সূত্রে ব্যবহার করছে। ডিএসসিসির কর্মকর্তারা বলেন, তারা একাধিকবার এটি মুক্ত করে দিতে র‍্যাবকে বললেও র‍্যাবের পক্ষ থেকে সাড়া পাওয়া যায় নি।  
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.