টেকসই জীবিকা অর্জনে সুনামগঞ্জের মানুষের যত প্রতিবন্ধকতা  

বাংলাদেশ

29 June, 2021, 01:35 pm
Last modified: 29 June, 2021, 01:50 pm
কৃষিতে সরকারের ভর্তুকি ও প্রয়োজনের তুলনায় কম অনুদান, ত্রাণের অপ্রতুলতা, কম দামে ধান বিক্রি, জলমহালে মাছ ধরা বন্ধের সময় বিকল্প আয় না থাকায় এই অঞ্চলের মানুষগুলো পিছিয়ে রয়েছে।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ সুনামগঞ্জের মানুষের নিত্যসঙ্গী। ফলে টেকসই জীবিকা অর্জনে রয়েছে নানা প্রতিবন্ধকতা। কৃষিতে সরকারের ভর্তুকি, প্রয়োজনের তুলনায় কম অনুদান, ত্রাণের অপ্রতুলতা, কম দামে ধান বিক্রি, জলমহালে মাছ ধরা বন্ধের সময় বিকল্প আয় না থাকায় এই অঞ্চলের মানুষগুলো পিছিয়ে রয়েছে বলে জানা গেছে। 

সম্প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থায়নে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) কর্তৃক পরিচালিত একটি গবেষণায় জানা গেছে, সুনামগঞ্জে টেকসই জীবিকা অর্জনের পথ অনেক কঠিন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, প্রাকৃতিক সম্পদে প্রকৃত সুবিধাভোগীর কম সংখ্যা, জমির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে গুরুত্ব না দেয়া, চাষযোগ্য পতিত জমির কম ব্যবহার, পতিত জমিকে চাষযোগ্য করে তোলার ক্ষেত্রে সেবা প্রদানকারী এবং সুবিধাভোগী উভয় পক্ষের উদ্যোগ এবং উদ্যমের প্রচন্ড অভাব দেখা যায়। 

যে কারণে এখনো বেশিরভাগ মানুষের জন্য জলমহাল ও বিভিন্ন উন্মুক্ত জলাশয় থেকে মাছ ধরা ও এক মৌসুমে ধান চাষই নির্ভরশীল আয়ের উৎস। অবশ্য মাছ ধরার জন্য জলাশয়ের ইজারা নিতে যে পরিমাণ খরচ তাও সাধারণ জেলেরা দিতে পারে না। তাই এই ইজারা নিয়ে নেয় প্রভাবশালীরা।

সুনামগঞ্জের তাহিরপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বিশ্বজিৎ সরকার টিবিএসকে বলেন, 'ধান এবং মাছ কেন্দ্রিক কর্মসংস্থানের বাইরে গিয়ে জীবিকা নির্বাহের খুব বেশি সুযোগ তৈরি হয়নি। কয়লা বা বালু কেন্দ্রিক কিছু কাজ থাকলেও তা ঋতুভিত্তিক'। 

'তবে এলাকার মানুষের জীবনযাত্রার মান পরিবর্তন করতে হলে স্থানীয়ভাবে কলকারখানা স্থাপন ও ইকো-ট্যুরিজম ভিত্তিক কর্মসংস্থানকে গুরুত্ব দিতে হবে'। 

সিপিডির গবেষণা বলছে, আয়ের মূল জায়গা এক মৌসুমের ধান চাষ হলেও সার, বীজ ও অন্যান্য কৃষি উপকরণে ভর্তুকি সবসময়ই প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। সারের ক্ষেত্রে সরকার নির্ধারিত মূল্য এবং প্রকৃত ক্রয়মূল্যের মধ্যে তারতম্য দেখা যায়।

ধানের ক্ষেত্রেও সরকার নির্ধারিত বিক্রয়মূল্য এবং কৃষকদের বিক্রয়মূল্যের মধ্যে তারতম্য দেখা যায়। প্রণোদনা বা ভর্তুকি বন্টনের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র আবাদী জমিভিত্তিক বিভাজন ছাড়া সুবিধাভোগী নির্বাচনের বিশেষ কোন নীতি নেই। নিম্ন আয়ের মানুষ সবচেয়ে বিপদে পড়ে যখন মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকে এবং বোরো ধান লাগানো ও ফসল কাটার মধ্যবর্তী সময়টুকুতে।  

সুনামগঞ্জের মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চাহিদা থাকলেও সাধারণ কৃষক বা মৎসচাষীরা প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ সুবিধা খুব একটা পায় না। বিভিন্ন দক্ষতা ও আয়বৃদ্ধিমূলক প্রশিক্ষণ এবং ঋণ কার্যক্রমে নারীদের অংশগ্রহণ আরও কম।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশম্ভরপুর উপজেলার স্থানীয় বাসিন্দা আরাফ আহমদ বলেন, 'আমরা ছোট পরিসরে মাছ চাষ করছি। অনেকেই চেষ্টা করছে। কিন্তু এর জন্য ঋণ বা সরকারের সহযোগিতা পাওয়ার সুযোগ খুব সীমিত'। 

সিপিডির গবেষণা বলছে, দক্ষতা বৃদ্ধির প্রশিক্ষণে নারীর অংশগ্রহণ ২০১৮ তে ছিল ২৭ শতাংশ, যা পরের বছর নেমে আসে ১৫ শতাংশে। আয় বর্ধনমূলক প্রশিক্ষণে নারীর অংশগ্রহণ ২০১৮ তে ছিল ২৪ শতাংশ যা ২০১৯ এ নেমে এসেছে ২১ শতাংশে।  

জানা গেছে, স্থানীয় পর্যায়ে বাস্তবায়নকৃত রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন উন্নয়নমূলক স্কীমে অংগ্রহণের ক্ষেত্রে সুবিধাভোগীদের মাঝে বাস্তবায়ন নীতিমালা সম্পর্কে অনেক সময় পরিষ্কার ধারণা থাকে না। এছাড়াও পর্যাপ্ত সঞ্চয়ের অভাবে যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও অনেকে এতে অংশগ্রহণ করতে পারে না। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় প্রদেয় দৈনিক মজুরি বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক কম হওয়ায় এটি মানুষের জীবন জীবিকায় আশানুরূপ প্রভাব ফেলার ক্ষেত্রে অকার্যকর।

টেকসই জীবিকার সাথে সম্পর্কিত সরকারি সেবা প্রদানকারী কর্তৃপক্ষের মধ্যে সমন্বয়হীনতা এবং নীতি ও কাঠামোগত জটিলতা, বিভিন্ন প্রশিক্ষণ এবং ঋণ সেবা প্রদানকারী কর্তৃপক্ষের মাঠপর্যায়ের জনবল ঘাটতি বড় কারণ।

সিপিডি ঋণ গ্রহণের এক চিত্র তুলে ধরে জানায়, ২০১৮ সালে অ-কৃষি খাতে ঋণ বিতরণের পরিমাণ কমেছে ৪.৫ শতাংশ এবং কৃষিতে কমেছে ২২.৬ শতাংশ। ঋণ কার্যক্রমেও নারীদের অংশগ্রহণ পুরুষদের তুলনায় এক তৃতীয়াংশেরও কম। যদিও তফসিলি সরকারী ব্যাংকসমূহ কৃষকদের স্বল্পসুদে ২-৪ শতাংশ ঋণ দিয়ে থাকে। তারপরও বেশিরভাগ মানুষ ঋণ গ্রহণ করে মহাজনের নিকট থেকে।   

এজন্য অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, হাওর মাস্টারপ্ল্যান এবং অন্যান্য নীতিমালার আলোকে ও স্থানীয় প্রেক্ষাপট বিবেচনায় সুনামগঞ্জে টেকসই জীবিকা নিশ্চিত করতে বেশকিছু সুপারিশ তুলে ধরে সিপিডি।

সিপিডির সুপারিশে বলা হয়, কৃষকেরা যাতে সঠিক মূল্যে তাদের ধান এবং চাল সরকারের কাছে বিক্রয় করতে পারেন তা নিশ্চিত করতে একটি কার্যকর ব্যবস্থা চালু করতে হবে। এর জন্য জেলা প্রশাসক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, জেলা কৃষি বিপণন অফিসের প্রতিনিধি, এনজিও প্রতিনিধি এবং প্রকৃত কৃষকদের দ্বারা গঠিত সিবিও সদস্যদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং গুণগতমানের ধান দেয়ার সক্ষমতা অর্জনে কৃষকদের জন্য প্রশিক্ষণের আয়োজন করা যেতে পারে। 

বৈশ্বিকভাবে ক্রমবর্ধমান সারের দামের কথা মাথায় রেখে নির্ধারিত মূল্যে অধিক সংখ্যক কৃষকের কাছে সার পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। একইসঙ্গে কৃষি যন্ত্র বিতরণে সরকার নির্দিষ্ট প্রণোদনাসমূহ যেন প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের কাছে পৌঁছায় তা নিশ্চিত করতে হবে। 

এক্ষেত্রে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, জেলা কৃষি বিপণন অফিসের প্রতিনিধি, এনজিও প্রতিনিধি এবং সিবিও সদস্যদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা যেতে পারে যারা বিষয়গুলো নিয়মিত তদারক করবে।  

এছাড়া কৃষি ব্যাংকসহ বিভিন্ন তফসিলি ব্যাংকের ঋণ গ্রহণ এবং পরিশোধ প্রক্রিয়ার জটিলতা কমানো, মাছ ধরা নিষিদ্ধের সময়ে মৎস অধিদপ্তরের মাধ্যমে স্বল্প সুদে ঋণ, বিকল্প আয় কার্যক্রমের ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি জলমহালের ইজারা প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা বৃদ্ধিসহ এটির কার্যকারিতা বৃদ্ধির জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। কারণ বছর বছর জলমহালের খাজনা না বাড়িয়ে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধিমূলক জলমহাল ব্যবস্থাপনার দিকে গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। 

সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ জাহাঙ্গীর হোসেন টিবিএসকে বলেন, 'সুনামগঞ্জের মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরির জন্য যোগাযোগ অবকাঠামোতে গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। সবগুলো উপজেলার সঙ্গে আন্তঃসড়ক যোগাযোগ তৈরি করা হচ্ছে যা এতদিন ছিল না। রেল সংযোগের মাধ্যমে সুনামগঞ্জকে নেত্রকোনার সঙ্গে সংযোগের কাজ চলছে'।  

তিনি বলেন, 'এখানে কৃষকের জীবনমান উন্নয়নে বিকল্প ফসল উদ্ভাবনের কাজ করা হচ্ছে। যেহেতু ছয় থেকে সাত মাস পানির নীচেই জেলার বেশিরভাগ জমি তলিয়ে থাকে, সুতরাং বিকল্প কর্মসংস্থান একটি বড় চ্যালেঞ্জ'। 

উল্লেখ্য, বন্যা এবং অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের কারণে হাওড়ে জাতীয়ভাবে ফসলের ক্ষেত্রে যে ক্ষতি হয় তার ৫০ শতাংশই হয় সুনামগঞ্জে। এখানে ফসল ফলানোর প্রবণতা জাতীয় গড়ের তুলনায় বেশ কম। এখানে মোট ফসলি জমির ৭৩.৫% মাত্র এক মৌসুমে আবাদযোগ্য, সেখানে কেবল বোরো ধান আবাদ হয়। ফলনও হয় বেশ কম।  

সুনামগঞ্জ, সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া মিলে দেশে মোট ৪২৩টি হাওর রয়েছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ১৩৩টি (৩১.৪%) হাওড় রয়েছে সুনামগঞ্জে যা মোট হাওর এলাকার ১৮.৪%।

২০১৮ সালের কৃষি পরিসংখ্যান বর্ষগ্রন্থ-২০১৮ থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা গেছে, সুনামগঞ্জে মোট আবাদি জমি ৫০%, পতিত জমি ১১%, চাষের অনুপযোগী জমি ৩২%, বনভূমি ২% এবং চাষযোগ্য পতিত জমি ৫%।

জেলাটিতে পারিবারিক আয়ের ৬৮% আসে কৃষি খাতে আত্ম-কর্মসংস্থানের মাধ্যমে।

সুনামগঞ্জে বর্তমানে মোট জেলে আছে ১.২ লাখ। এর মধ্যে ৯২ হাজার জন জেলে নিবন্ধিত এবং প্রায় ৭৬ হাজার জন কার্ডধারী জেলে। 


এই প্রতিবেদনটি অক্সফামের সহযোগিতায় তৈরি করা হয়েছে। 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.