টিসিবির পণ্য: অপ্রতুল বরাদ্দে হতাশ নিম্নআয়ের মানুষেরা 

বাংলাদেশ

11 July, 2021, 01:25 pm
Last modified: 11 July, 2021, 03:24 pm
ক্রেতারা বলছেন, দিনদিন এসব পণ্য কিনতে মানুষের লাইন দীর্ঘ হচ্ছে, কিন্তু পণ্যের পরিমাণ অনেক কম। সরকারের কাছে এসব পণ্যের বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি জানান তারা।  

রাজধানীতে ভর্তুকি মূল্যে বিক্রি হওয়া চাল, তেল, ডাল কিনতে মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়লেও বরাদ্দ কম থাকায় অনেককেই খালি হাতে ফিরতে হচ্ছে। এতে করে কঠোর লকডাউনে আয় বন্ধ হয়ে যাওয়া মানুষগুলোর কষ্ট আরও বাড়ছে।

সরেজমিন দেখা গেছে, রাজধানীর বেশ কিছু জায়গায় ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) সয়াবিন তেল, ডাল ও চিনি এবং খাদ্য অধিদপ্তর পরিচালিত ওএমএসের কর্মসূচির আওতায় চাল ও আটা বিক্রি করছে। কিন্তু চাহিদার তুলনায় বরাদ্দ কম হওয়ায় মানুষ ভর্তুকি মূল্যে সরকারের দেওয়া এ সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অনেক মানুষকেই খালি হাতে ফিরতে দেখা গেছে।

গত বৃহস্পতিবারের কথা, দুপুর দুইটা বাজতে তখনো কিছু সময় বাকি। মধ্যবাড্ডায় মেইন রোডের একধারে প্রায় শ'দুয়েক নারী পুরুষ পৃথক দুটি লাইনে দাঁড়িয়ে। কেউ কেউ আবার চোখে মুখে ক্লান্তি নিয়ে ফুটপাতের ধারে কিংবা বন্ধ থাকা দোকানের সিঁড়িতে উৎসুক চোখ নিয়ে অপেক্ষায়।

অপেক্ষারতদের মধ্যে একজনকে জিজ্ঞেস করতেই বললেন, টিসিবির গাড়ি আসবে, সেজন্য সবাই অপেক্ষায় আছে। সকাল থেকে অপেক্ষা করলেও দুপুর দুইটার মধ্যে কোন গাড়ি আসেনি।

পুরুষ লাইনের সামনে একটি চেয়ার নিয়ে বসেছিলেন সত্তর পেরনো এক বৃদ্ধ। আজিজুল মিয়া নামের এই বৃদ্ধ জানান, ১০টার পর থেকেই তারা লাইন ধরে অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু টিসিবির কোন গাড়ি আসেনি।

জানতে চাইলে টিসিবির মুখপাত্র মো. হুমায়ুন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, 'মধ্যবাড্ডায় বৃহস্পতিবার কোন গাড়ি দেয়া হয় নাই। আগের দিন ছিল বলে মানুষ হয়তো ভেবেছে আজও আসবে'।

কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে সরকার ঘোষিত কঠোর লকডাউনে এবং ঈদ-উল-আযহা উপলক্ষে জরুরি সেবা হিসেবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন টিসিবি ভর্তুকি মূল্যে ৫৫ টাকা কেজি দরে চিনি ও মশুর ডাল এবং ১০০ টাকা লিটারে সয়াবিন তেল বিক্রি করছে। 

একই দিনে উত্তর বাড্ডায় টিসিবির আরেকটি বিক্রয়কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, গাড়ির সামনে প্রায় শ'দুয়েক মানুষের দুটি লাইন। কিন্তু মানুষ থাকলেও দুপুর নাগাদ সয়াবিন তেল ফুরিয়ে গেছে। অগত্যা কেউ কেউ চিনি ও ডাল কিনছে, আবার কেউ কেউ খালি হাতেও ফিরে যাচ্ছে। তখনো লাইনে যারা দাঁড়ানো ছিল তারা চিনি ও ডাল কিনতে পারবে কিনা তারও নিশ্চয়তা ছিল না। কারণ সেখানে পণ্যের পরিমাণের চেয়ে মানুষের সংখ্যা ছিল অনেক বেশি।

ক্রেতাদের একজন আরিফা সুলতানা বলেন, 'দুই ঘন্টা ধরে লাইনে দাঁড়িয়েও তেল কিনতে পারিনি। আগেই শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু তেলটাই বেশি দরকার ছিল'।

বেশ কয়েকজন ক্রেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, করোনায় আয় বন্ধ হওয়া এবং বাজারে নিত্যপণ্যের বাড়তি দামের কারণেই নিম্ন ও মধ্যম আয়ের অনেক মানুষ টিসিবির পণ্য কিনতে আসছে। একটা সময়ে নিম্ন আয়ের মানুষগুলোকে এই লাইনে দেখা গেলেও এখন অনেক মধ্যবিত্তকেও লাইনে দাঁড়িয়ে পণ্য কিনতে দেখা যায়।

ক্রেতারা বলছেন, দিনদিন এসব পণ্য কিনতে মানুষের লাইন দীর্ঘ হচ্ছে, কিন্তু পণ্যের পরিমাণ অনেক কম। ক্রেতারা সরকারের কাছে এসব পণ্যের বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি জানান।  

টিসিবির ডিলারদের কাছ থেকে জানা গেছে, প্রতিটি বিক্রয়কেন্দ্রে ২১শ কেজি করে পণ্য দেয়া হচ্ছে। যেখানে ৪০০ কেজি ডাল, ১ হাজার কেজি তেল ও ৭০০ কেজি চিনি। অর্থাৎ একটি বিক্রয়কেন্দ্র থেকে মাত্র দুইশ মানুষ ২ কেজি করে ডাল ও ৫০০ মানুষ ২ লিটার করে তেল কিনতে পারছে। বিক্রেতারা অবশ্য প্রথমে প্যাকেজ হিসেবে তেল, চিনি ও ডাল দুই কেজি/লিটার করে বিক্রি করেন। কোন আইটেম শেষ হলে বাকিগুলো নিতে হয়। কিন্তু ডাল ও তেলেই মানুষের আগ্রহ বেশি। কারণ বাজার থেকে এক লিটার তেল কিনতে ১৫০ টাকা খরচ করতে হয়। ডালের দামও ১০০ টাকার আশেপাশে।

রামপুরা বাংলাদেশ টেলিভিশনের উল্টোপাশের টিসিবির এক বিক্রয়কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, ইউলুপের নীচ থেকে শুরু করে হাতিরঝিলের রাস্তা ধরে বেশ খানিকটা জুড়ে মানুষের লাইন। দ্রুত টিসিবির পণ্য ফুরোতে থাকলেও মানুষের লাইন যেন আরও বড় হচ্ছিল।

এই বিক্রয়কেন্দ্রের ডিলার মো. স্বপন টিবিএসকে বলেন, 'প্রচুর মানুষ টিসিবির পণ্য কিনছে। পণ্য শেষ হয়ে যায় কিন্তু লাইন শেষ হয় না। প্রতিদিনই ক্রেতা থাকতেই পণ্য শেষ হয়ে যায়'।

ঘন্টা দেড়েক লাইনে দাঁড়ানোর পর তেল-চিনি হাতে পান আব্দুল করিম। তিনি বলেন, 'দেড় ঘন্টা আগে যখন লাইনে দাঁড়াই তখন যে পরিমাণ মানুষ ছিল, এখন আরো বেড়েছে'।

তিনি বলেন, 'ফুটপাতে কাপড়ের দোকান করতাম। লকডাউনে ব্যবসা বন্ধ থাকায় কয়দিন ধরে কোন আয় নেই। স্ত্রী, দুই সন্তান ও বৃদ্ধ বাবার সংসার টানতে গিয়ে জমানো টাকা শেষ। এখন ধার করে চলতে হচ্ছে। টিসিবির পণ্যের পরিমাণ আরও বাড়ানো হলে আমার মত হাজার হাজার মানুষের অনেক উপকার হবে'।   

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত ৫,৬,৭ জুলাই ৭৬৪ মেট্রিক টন চিনি, ৪৭৫ মেট্রিক টন মশুর ডাল এবং ১১,৮৩,৩৭৮ লিটার সয়াবিন তেল ভর্তুকি মূল্যে বিক্রয় করা হয়েছে। ঢাকাসহ সারাদেশে ৪৫০টি বিক্রয়কেন্দ্রে এসব পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে। 

শুধু তেল চিনি নয়, মানুষের দীর্ঘ লাইন দেখা গেছে, খাদ্য অধিদপ্তর পরিচালিত ওএমএস এর খোলা বাজারে চালের বিক্রয়কেন্দ্রেও। ৩০ টাকা কেজি দরে মোটা ৫ কেজি করে মোটা চাল বিক্রি করছে সরকার। রামপুরা বাজারের পাশের এক বিক্রয়কেন্দ্রে খোঁজ নিয়ে জানা গেল সেখানে ৩ টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।

এখানেও দেখা যায়, হাতে ব্যগ নিয়ে শত শত নারী পুরুষ লাইনে দাঁড়ানো। সকাল ১১ টাকা থেকে শুরু করে দুপুরের দিকে চালের পরিমাণ প্রায় শেষ হয়ে আসলেও দুপুরবেলায় প্রায় তিনশ লোককে লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে দেখা যায়।  

এই বিক্রয়কেন্দ্রের ডিলার এনামুল হক বলেন, '৩ টন করে চাল দেয়া হয় আমাদের। যা দুপুর গড়াতেই শেষ হয়ে যায়। অনেক মানুষ শেষদিকে চাল কিনতে পারে না'।

খাদ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ঢাকায় ১০টি ট্রাকে প্রতিদিন ৩ টন করে চাল এবং ঢাকা ও শ্রমঘন ৪টি মহানগরের ২৭৬টি কেন্দ্রে প্রতিদিন ২ টন আটা ও ১ টন চাল এবং অন্যান্য বিভাগীয় ও জেলা শহরের ৪২৯ স্থানে প্রতিদিন এক টন করে চাল ও আটা বিক্রি করার কথা। কিন্তু খাদ্য মন্ত্রণালয়ের এ নির্দেশনা খাদ্য অধিদপ্তর এখনো বাস্তবায়ন করতে পারেনি।

খাদ্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, রাজধানীতে ১৪৭টি ওএমএস বিক্রয়কেন্দ্র পরিচালনার কথা থাকলেও চালু থাকছে ৯৭-৯৯টি। সঙ্গে ১০টি ট্রাকসেল রয়েছে।  

কিন্তু এসব কেন্দ্র চালু থাকলেও সেখানে পর্যাপ্ত বরাদ্দ দিতে ব্যর্থ হচ্ছে অধিদপ্তর। বিক্রয়কেন্দ্রগুলোতে দুই টন আটা ও ১ টন করে চাল দেয়ার কথা থাকলেও শুধুমাত্র ১ টন করে চাল দেওয়া হচ্ছে। যে কারণে মানুষের বাড়তি চাপ সামাল দেয়া যাচ্ছে না। 

খাদ্য অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে বলেন, 'লকডাউনে প্রচুর মানুষ বেকার হয়ে পড়েছে। কিন্তু সে অনুযায়ী বরাদ্দ বাড়ানো যাচ্ছে না। এতে মানুষের কষ্ট বাড়ছে। তবে আরও ৫০০ কেজি করে চালের বরাদ্দ বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়া হয়েছে যা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে'।

সামগ্রিক বিষয়ে জানতে চাইলে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর  বলেন, 'লকডাউনে যাদের কাজ বন্ধ রয়েছে তারা যেন কম দামে পণ্য কিনতে পারে সেটা নিশ্চিত করা খুবই জরুরি। অঞ্চলভেদে বিনামূল্যেও এসব খাদ্যদ্রব্য বিতরণ করা যেতে পারে। মানুষের পেটে ক্ষুধা থাকলে লকডাউন বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হবে, মানুষকে চাইলেও ঘরে আটকানো যাবে না'।

উল্লেখ্য, পিপিআরসি এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অফ গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) এক গবেষণায় জানায়, করোনার কারণে বাংলাদেশে নতুন করে ২৪.৫ মিলিয়ন মানুষ নতুন করে দরিদ্রের কবলে পড়েছে। 
 

 
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.