টাইডাল রেগুলেটরে চট্টগ্রামের প্রাচীন নৌ বাণিজ্য সংকোচনের আশঙ্কা

বাংলাদেশ

20 March, 2021, 11:25 am
Last modified: 20 March, 2021, 11:41 am
খাতুনগঞ্জ থেকে যেসব নৌযান দিয়ে পণ্য পরিবহন হয় তার বেশিরভাগই বড় নৌযান। সেসব নৌযানের প্রস্থ ২০-৩০ ফুটের মধ্যে। কিন্তু রেগুলেটর দুটিতে নৌ চলাচলের যে পথ রাখা হচ্ছে তার প্রস্থ মাত্র ২০ ফুট।   

চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের অধীনে ৪০টি খালের মুখে বসানো হচ্ছে টাইডাল রেগুলেটর (স্রোত নিয়ন্ত্রক)। এর মধ্যে দুটি বসানো হচ্ছে ভোগ্যপণ্যের প্রধান পাইকারি বাজার বৃহত্তর খাতুনগঞ্জের নৌপথে পণ্য পরিবহনের খাল রাজাখালী ও চাক্তাই খালে।   

রেগুলেটর দুটিতে নৌ চলাচলের জন্য যে পথ রাখা হচ্ছে তা অত্যন্ত সরু। যা দিয়ে ছোট নৌযান চলাচল করতে পারলেও বাধাগ্রস্ত হবে পণ্যবাহী বড় নৌযান চলাচল। পর্যাপ্ত নৌপথ না থাকায় নৌ চলাচল বাধাগ্রস্ত হলে নৌ বাণিজ্য সংকোচনের আশঙ্কা রয়েছে। 

খাতুনগঞ্জ থেকে যেসব নৌযান দিয়ে পণ্য পরিবহন হয় তার বেশিরভাগই বড় নৌযান। সেসব নৌযানের প্রস্থ ২০-৩০ ফুটের মধ্যে। কিন্তু রেগুলেটর দুটিতে নৌ চলাচলের যে পথ রাখা হচ্ছে তার প্রস্থ মাত্র ২০ ফুট।   

নৌযান মালিক ও শ্রমিকরা জানিয়েছেন, খাতুনগঞ্জ থেকে দূর-দূরান্তে পণ্য পরিবহনকারী নৌযানগুলোর (বোট ও ট্রলার) প্রস্ত ২৫-৩০ ফুটের মধ্যে। সেক্ষেত্রে টাইডাল রেগুলেটরে ২০ ফুটের পথ রাখা হলে তা দিয়ে পণ্য পরিবাহী নৌযানগুলো ঢুকতে পারবে না। এমনকি ছোট ২০ ফুটের নৌযানও এই পথ দিয়ে চলাচল করতে পারবে না। কারণ কাঠের তৈরি ২০ ফুট প্রস্থের একটি নৌযান প্রবেশ করতে কমপক্ষে পাশে আরো দুই ফুট বাড়তি জায়গা প্রয়োজন হয়।

''স্ট্যাডি অন ইকোনোমিক ইমপ্যাক্ট অব ওয়াটারলগিং অন লোকাল ট্রেড; দ্য কেস অব খাতুনগঞ্জ" বিষয়ে গবেষণা পরিচালনা করে ন্যাশনাল রেজিলিয়েন্স প্রোগ্রাম (এনআরপি)| গবেষণার টিম লিডার ও নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আবু তালিব মোহাম্মাদ শাহজাহান বলেন, 'নৌপথ রক্ষাসহ ব্যবসাবান্ধব খাতুনগঞ্জ ফিরিয়ে আনতে টাইডাল রেগুলেটর নয়, কর্ণফুলী নদী ও চাক্তাই-রাজাখালী খালসহ সংশ্লিষ্ট খালগুলোর নিয়মিত ড্রেজিং প্রয়োজন। একই সাথে খাল ভরাট ও দূষণ রোধ করতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। একটি পুরোনো মডেল হিসেবে টাইডাল রেগুলেটর থেকে সরে আসছে সারা বিশ্ব'। টাইডাল রেগুলেটরের সরু নৌপথ ও যথাযথ তদারকির অভাবে খাতুনগঞ্জের নৌপথের বাণিজ্য বন্ধের আশঙ্কা করেন এই বিশেষজ্ঞ। 

পরিবেশবাদী সংগঠন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতিও (বেলা) এই টাইডাল রেগুলেটরের বিরোধিতা করছে। বেলা'র হেড অব প্রোগ্রাম এডভোকেট খোরশেদ আলম বলেন, 'চট্টগ্রাম নগরীর জলবদ্ধতা নিরসনের জন্য এসব টাইডাল রেগুলেটর কোন কাজে আসবেনা। বরং টাইডাল রেগুলেটর নির্মাণের মাধ্যমে জলাবদ্ধতা নিরসনের বিপরীতে এই এলাকার সাথে সারা দেশের নৌ বাণিজ্যের পথকে আরো সংকুচিত করে তুলবে'। 

এটিকে একটি 'আত্নঘাতী পরিকল্পনা' অ্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, '১৯৬৯ সালের ফ্লাড ডিটেইল প্ল্যান (এফডিপি) অনুযায়ী নগরীর ৭১টি খাল দখলদার থেকে উদ্ধার না করে, শুধু স্লুইস গেট নির্মাণ করে চট্টগ্রাম মহানগরীর জলাবদ্ধতা দূর করা সম্ভব নয়। নদীতে জোয়ারের সময় স্লুইস গেট বন্ধ থাকলে এবং ওই সময় নগরীতে ১০০ মিলি লিটারের অধিক বৃষ্টিপাত হলে অধিকাংশ এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। এরমধ্যে স্লুইস গেট নির্মাণ করা মানেই হচ্ছে খালগুলোকে চিরতরে হত্যা করা'। 

টাইডাল রেগুলেটর নির্মাণ বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান সিডিএ বলছে, 'নৌপথে খাতুনগঞ্জের ব্যবসাকে বিবেচনায় নিয়ে সংশ্লিষ্ট খালগুলোতে রেগুলেটরে নৌযান চলাচলের জন্য পথ রাখা হচ্ছে। চাক্তাই ও রাজাখালী খালের রেগুলেটর দুটিতে নৌযান চলাচলের জন্য ৬ দশমিক ৫ মিটার বা ২০ ফুটের পথ রাখা হয়েছে। যা ম্যানুয়ালি পরিচালনা করা হবে। এই পথ নৌকা আসলে খুলে দেয়া হবে এবং নৌকা চলে গেলে বন্ধ করা হবে'।  

খাতুনগঞ্জ থেকে সন্দ্বীপ নৌপথে নৌকা দিয়ে পণ্য আনা-নেয়া করেন নোয়াব সেরাং (মাঝি) ও বাহার সেরাং। তারা বলেন, ছোট বোটের প্রস্থ ১৫-২০ ফুট। এসব নৌকা দিয়ে কাছের এলাকাগুলোতে পণ্য আনা-নেয়া হয়। বড় বোটের প্রস্থ ২৫-৩০ ফুট। খাতুনগঞ্জ থেকে পণ্য পরিবহনকারী নৌযানের মধ্যে ৬০-৭০ ভাগই হলো বড় বোট বা ট্রলার। সেসব নৌযান দিয়ে দূরের জেলা উপজেলাগুলো পণ্য আনা-নেয়া হয়। টাইডাল রেগুলেটরে নৌযান চলাচলের যেই পথ রাখা হচ্ছে তা দিয়ে ছোট বোট চলাচল করতে পারবে। বড় বোট চলাচল করতে পারবে না। 

সিডিএ'র প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, 'প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন বন্যা, অতিবৃষ্টি, জোয়ার বেড়ে গেলে রেগুলেটরের কপাটগুলো বন্ধ রাখা হবে। তখন নৌযান চলাচল বন্ধ থাকবে। এক কথায় রেগুলেটরের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিতভাবে নৌযান চলাচল করবে'। 

সিডিএ'র নির্বাহী প্রকৌশলী ও আউটার রিং রোডের প্রকল্প পরিচালক রাজীব দাশ বলেন, 'চাক্তাই ও রাজাখালী খালের রেগুলেটর দুটিতে নৌযান প্রবেশের জন্য ৬ দশমিক ৫ মিটারের পথ রাখা হচ্ছে। ২০ ফুটের চেয়ে বড় নৌযানে পণ্য পরিবহন করতে হলে এক্ষেত্রে নৌযানগুলো রেগুলেটরের বাইরে রেখে ছোট নৌযান কিংবা ঠেলাগাড়ি-ভ্যান দিয়ে বাজার থেকে পণ্য নিয়ে নৌযানে বোঝাই করতে হবে। জলাবদ্ধতামুক্ত নগরী করতে ব্যবসায়ীদের কিছুটা ছাড় দিতে হবে'। 

খাতুনগঞ্জ ট্রেড এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ এসোসিয়েশনের তথ্যমতে, খাতুনগঞ্জ দেশের সর্ববৃহৎ ভোগ্যপন্যের পাইকারি বাজার। মূলত নৌপথকে কেন্দ্র করেই বৃহত্তর খাতুনগঞ্জের (চাক্তাই-আসাদগঞ্জ-খাতুনগঞ্জ) ব্যবসা গড়ে উঠেছিল। খাতুনগঞ্জে বর্তমানে প্রতিদিন দুই-আড়াই হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়। এখনো প্রতিদিনের এই বিকিকিনির প্রায় ৩০ শতাংশ ব্যবসা হয় নৌপথকে ঘিরে। কিন্তু অপরিকল্পিত উন্নয়নের মাধ্যমে রাজাখালী ও চাক্তাই খালে টাইডাল রেগুলেটর বসানো হলে খাতুনগঞ্জের ব্যবসায় আরো ধস নামবে। 

চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, 'শত বছরের ঐতিহ্যবাহী চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ থেকে এখনো ভোগ্যপণ্যের বড় অংশ সারা দেশে সরবরাহ করা হয়। দেশের প্রাচীন পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে এখনো প্রতিদিন দুই থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়। এ বাণিজ্যকেন্দ্র রক্ষা করতে হলে স্লুইস গেইট নির্মাণে নৌপথের বাণিজ্য যাতে বাধাগ্রস্ত না হয় সেদিক বিবেচনায় রাখতে হবে। এছাড়া নিয়মিত রাজাখালী-চাক্তাই খাল খনন, শাখা খাল সংস্কার ও নতুন খাল খননের উদ্যোগ নিতে হবে'। 

রেগুলেটর দিয়ে নৌ চলাচলের জন্য ২০ ফুট যথেষ্ট নয় বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, এই পথ দিয়ে ছোট নৌকাগুলো যাতায়াত করতে পারবে। পণ্যবাহী বড় বোটগুলো যাওয়া-আসা করতে পারবে না।  

চট্টগ্রাম নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসন ও আউটার রিং রোড প্রকল্পের কাজ করছে সিডিএ। যেখানে সিডিএ'র প্রকল্পে বিভিন্ন খালের মুখে ১২টি রেগুলেটর বসানো হচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড বসাবে আরো ২৩ টি রেগুলেটর। জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের আওতায় সিডিএ বসাচ্ছে আরো ৫টি। এসব প্রকল্পের আওতায় চট্টগ্রামের বাণিজ্যিক খাল হিসেবে খ্যাত চাক্তাই ও রাজাখালী খালে বসবে দুটি রেগুলেটর। 

খাতুনগঞ্জ ট্রেড এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ এসোসিয়েশনের তথ্যমতে, চট্টগ্রামের আশপাশের ১১টি জেলার প্রায় অর্ধশত উপজেলার পণ্য আনা-নেয়ার প্রধান মাধ্যম নৌপথ। প্রতিদিন প্রায় পাঁচ শতাধিক নৌযান এই পণ্য আনা নেয়ার কাজে নিয়োজিত থাকে। তবে হরতাল-অবরোধসহ সড়ক পথে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার সময় নৌ পথই পণ্য পরিবহনের একমাত্র মাধ্যম হয়ে উঠে। 

খাতুনগঞ্জের সঙ্গে এখনো কক্সবাজারের কুতুবদিয়া, মহেশখালী, টেকনাফ, রামু, চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ, আনোয়ারা, বাঁশখালী, সাতকানিয়া, চন্দনাইশ, বরিশাল, ভোলা, হাতিয়া, পটুয়াখালী, নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, ও কুমিল্লাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে পণ্য আনা-নেয়া হয় নৌ পথে।  

সাতকানিয়া এলাকার মুদি ব্যবসায়ী সাব্বির আহমদ বলেন, 'সড়ক পথের চেয়ে নৌপথে পণ্য পরিবহন খরচ অর্ধেক কম। খাতুনগঞ্জ থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরত্বে সাতকানিয়ার চরতি অঞ্চলে নৌপথে বস্তাপ্রতি পরিবহন খরচ মাত্র ১০ টাকা। যা সড়কপথে ২০-২৫ টাকা'।

বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পণ্য বোঝাই করে আসা নৌযানগুলো কর্ণফুলী নদী হয়ে রাজাখালী ও চাক্তাই খালে প্রবেশ করে। এরপর নৌযানে থাকা পণ্যগুলো বাজারের চাক্তাই-আছাদগঞ্জ-খাতুনগঞ্জের বিভিন্ন দোকান ও আড়তে খালাস করে। একইভাবে বাজারের এসব আড়ত ও দোকান থেকে ওইসব অঞ্চলের জন্য প্রয়োজনীয় পণ্য বোঝাই করে নিয়ে যায়। কিন্তু খাল দুটির প্রবেশ মুখে টাইডাল রেগুলেটর নির্মাণ হলে খাতুনগঞ্জের সাথে সারা দেশের নৌ পথে পণ্য পরিবহন বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এতে পণ্য পরিবহন খরচ বেড়ে যাবে। বিশেষ করে নৌপথ নির্ভর এলাকাগুলোতে পণ্য পরিবহন বিপাকে পড়বে।  

চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও আঞ্চলিক পরিকল্পনা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মো. রিয়াজ আক্তার মল্লিক বলেন, 'সড়ক ও রেলপথের তুলনায় নৌপথে পণ্য পরিবহন অনেক সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব। কারণ সড়ক ও রেলপথে পণ্য পরিবহন করতে যেই পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ হয় নৌযানে তা হয় না। তাছাড়া সড়ক ও রেলপথ তৈরিতে পরিবেশ ধ্বংস হয়। কিন্তু নৌযান চলাচল করে প্রাকৃতিকভাবে অবস্থিত নৌপথের মাধ্যমে। তাই জলাবদ্ধতা নিরসনে খালের মুখে এমনভাবে রেগুলেটর বসাতে হবে যাতে নৌপথের বাণিজ্যে কোন বাধা সৃষ্টি না হয়।  

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.