ছোট কাঠের দোকান থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে হাতিল

বাংলাদেশ

25 January, 2020, 04:00 pm
Last modified: 04 January, 2021, 05:04 pm
এ প্রতিষ্ঠানে কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় ৪ হাজার। রয়েছে ৭০টির বেশি নিজস্ব শোরুম। বছরে বিক্রি হচ্ছে ৫০০ কোটি টাকার কাছাকাছি। রফতানি হচ্ছে আমেরিকা, ইউরোপের বিভিন্ন দেশসহ অন্তত ২০টি দেশে।

দেশে ফার্নিচার উৎপাদন ও রফতানির শীর্ষ প্রতিষ্ঠান হাতিল। ভারতে বিশাল বাজার দখলের পাশাপাশি ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশি ফার্নিচারে অগ্রগামী প্রতিষ্ঠানটি। অথচ ১৯৮৯ সালে ছোট কাঠের দোকান থেকে যাত্রা একক মালিকাধীন এ প্রতিষ্ঠানটির। 

দেশের উদীয়মান মধ্যবিত্তকে টার্গেট করে পণ্য উৎপাদন, গুণগত মান ও ব্যতিক্রম মার্কেটিং ব্যবস্থা কোম্পানিটিকে শীর্ষে নিয়ে এসেছে বলে জানিয়েছেন এর কর্মকর্তারা। 

হাতিল ফার্নিচারের প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম এইচ রহমান দ্য বিজনেস স্টান্ডার্ডকে বলেন, "দেশের নিম্নবিত্ত মানুষ সাধারণত কাঠ দিয়ে তৈরি করে নন ব্র্যান্ডেড ফার্নিচার ব্যবহারে অভ্যস্ত। অন্যদিকে উচ্চবিত্তের সংখ্যা খুবই কম। এ বিষয়টি মাথায় রেখেই হাতিল মিডল ক্লাসকে তাদের ক্রেতা হিসেবে চয়েজ করেছে।"

তিনি বলেন, আমাদের প্রতিষ্ঠানের যাত্রার পর থেকেই সহনীয় মূল্যের ফার্নিচার তৈরি করছে। ফলে মধ্যবিত্তের হার বৃদ্ধির সঙ্গে ফার্নিচার বিক্রি বেড়েছে। 

জানা গেছে, বর্তমানে দেশে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার ফার্নিচারের বাজারে হাতিলের অংশীদারিত্ব ৫ শতাংশ। ২০০৮ সালে ১৭৫ কোটি টাকা বিক্রি হলেও কোম্পানিটির বর্তমানে বার্ষিক বিক্রি হয় প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। বছরে প্রবৃদ্ধিও ১৫ শতাংশের কাছাকাছি। সারা দেশে বর্তমানে ৭০টির বেশি নিজস্ব শোরুমের পাশাপাশি ৩০০ বেশি ডিলারশিপ আউটলেটের মাধ্যমে পণ্য বিক্রি করছে হাতিল। ওডেন, মেলামাইন লেমিনেটেড চিড় বোর্ড, এমডিএফ, কেন ও মেটাল ফার্নিচারসহ হোম ও অফিসের প্রায় সব আইটেমের ফার্নিচার রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। 

নতুন নতুন ডিজাইন ও পণ্যের গুণগত মানের কারণে নিজেদের বাজার বাড়ছে বলে মনে করছেন সেলিম এইচ রহমান। 

তিনি বলেন, "জার্মানি ও আমেরিকা থেকে আমদানি করা রেড ওক এবং বিচ কাঠ দিয়ে দেশের কারিগররা তৈরি করেছেন অত্যাধুনিক ডিজাইনের ফার্নিচার। 'স্লিম ইজ স্মার্ট' স্লোগানে নানা ডিজাইনের ফার্নিচার বাজারজাত করার কারণে ক্রেতারাও সহজে নিচ্ছে আমাদের ফার্নিচার।"

সেলিম এইচ রহমান আরও বলেন, "প্রতি বছরই নিত্য-নতুন একাধিক ডিজাইনের আসবাবপত্র বাজারে আনে হাতিল। নতুনত্ব আর আধুনিকতার সংমিশ্রণে হাতিলে নজর কাড়ে ক্রেতাদের।"

হাতিলের উত্থানে একটি বড় ভূমিকা ছিল এর বিপণন ব্যবস্থার। অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপ ডেভলপ করে পণ্য পছন্দের পদ্ধতি চালু করেছে কোম্পানিটি। ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরিয়ে যেকোনো ফার্নিচার দেখার ব্যবস্থা রয়েছে এতে। অনলাইনে অর্ডার দেওয়ার সিস্টেমও চালু করেছে কোম্পানিটি। একই সঙ্গে হাতিল থেকে পুরানো ফার্নিচার বদলে নতুন ফার্নিচারও কেনা যায়।  

সেলিম এইচ রহমান বলেন, পুরনো গাড়ি বদলে নতুন গাড়ি বা পুরনো গহনা বদলে নতুন গহনার মতো একটি বিষয় হলো বাসা বা অফিসের পুরনো ফার্নিচার বদলে ফেলে নতুন ফার্নিচার দেওয়া।

মার্কেটিংয়ের পাশাপাশি দাম মধ্যবিত্তের হাতের নাগালে থাকায় হাতিল জনপ্রিয়তা বেড়েছে বলেও দাবি করেন সেলিম এইচ রহমান।

তিনি বলেন, "পণ্য কনজিউমের সঙ্গে দামের সম্পর্ক রয়েছে। আমরা একটি খাট তৈরি করেছি, যার দাম ১৬ হাজার টাকা। সে ক্ষেত্রে পণ্যের নকশা ও মান দারুণ দেওয়া হচ্ছে। ফলে মানুষ সাধারণ ফার্নিচার ছেড়ে আমাদেরটা অনেকেই পছন্দ করছেন।"

রাজধানীর হাতিলের একটি শোরুম। ছবি: সালাহউদ্দিন আহমেদ

পণ্য ডেলিভারি ও ভাল সার্ভিসের নিশ্চয়তা হাতিলের বিকাশে ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করেন সেলিম এইচ রহমান। 

তিনি বলেন, "হাতিল ফার্নিচারের সব শাখায় পণ্য ডেলিভারির ব্যবস্থা রয়েছে। নিজস্ব পরিবহনের মাধ্যমে সারা ঢাকা শহরে এই সার্ভিস প্রদান করা হয়। এ জন্য আলাদা কোনো ডেলিভারি চার্জ প্রদান করতে হয় না।"

ওয়ারেন্টি ও সার্ভিসিং সেন্টারে বিষয়ে তিনি বলেন, "হাতিলের সব ফার্নিচারে ১ বছরের ওয়ারেন্টি দেওয়া হয়। এক বছরের পরও সার্ভিস চার্জসহ সব ধরনের সেবা দেওয়া হয়। এছাড়া হাতিলের সব কাঠে রয়েছে ৫ বছর ঘুনমুক্ত থাকার ওয়ারেন্টি।" 

দেশের বাজারে বড় হওয়ার পাশাপাশি বিদেশের মার্কেটেও পাইওনিয়ার হাতিল। বর্তমানে দেশের মোট ফার্নিচার রফতানির প্রায় অর্ধেকই হাতিলের দখলে।

প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলছেন," অস্ট্রেলিয়া ও কানাডায় নিজস্ব শো রুম করে ফার্নিচার বিক্রি করা হাতিলই বাংলাদেশের প্রথম ফার্নিচার প্রস্তুতকারি প্রতিষ্ঠান। ভারতে হাতিলের ১৮টি ফ্র্যাঞ্চাইজি আছে। নেপালে দু'টি, ভুটানে একটি ও কানাডায় একটি ফ্র্যাঞ্চাইজি আছে। এ ছাড়া, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, সৌদি আরব, কুয়েত, আরব আমিরাত, থাইল্যান্ড, মিসর, রাশিয়া ও নেপালসহ অত্যন্ত ২০টি দেশে হাতিলের ফার্নিচার বিক্রি হচ্ছে। খুব শিগগিরই এটি ইউরোপের সব দেশের বাজারে প্রবেশের পরিকল্পনা রয়েছে।" 

হাতিলে উত্থানের গল্প তুলে ধরে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স শেষ করে আমার প্রয়াত বাবা হাবিবুর রহমানের টিম্বার দোকান থেকে ব্যবসা শুরু করি। ১৯৮৯ সালে প্রথম হাতিল নামে একটি কাঠের দোকান দেই। ১৯৯০ সালের দিকে একটি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির কয়েকটি দরজার অর্ডার পাই। তারা কাঠ কিনে নেওয়ার পরিবর্তে কারিগর দিয়ে ফার্নিচার বানিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। এরপরই শুরু হয় নিজস্ব ফার্নিচার ব্যবসা। 

ওই ঘটনার পরই কয়েকজন কারিগর রেখে অর্ডারের ভিত্তিতে বাসায় গিয়ে ডিজাইন করা ও ফার্নিচার বানানো শুরু হয় হাতিলের। এভাবেই ধীরে ধীরে ব্যবসা শুরু হয় আমাদের। ১৯৯৫ সালে দরজার বাইরে গিয়ে প্রথম আলমারি ও খাট বানানো শুরু করে হাতিল। এরপরই ধীরে ধীরে হোম ফার্নিচারের সব আইটেমে প্রবেশ করে হাতিল। প্রথমে নিজস্ব কাঠ দিয়ে ফার্নিচার বানানো হলেও এখন শতভাগ বিদেশি কাঠ ব্যবহার করা হচ্ছে। বর্তমানে হোম, অফিস ও হাসপাতাল আইটেম মিলে ১০০০ এর বেশি ডিজাইনের ফার্নিচার উৎপাদন করছে হাতিল। 
 
দুইবার আধুনিকায়নের পর বর্তমানে হাতিলের কারখানাটি দেশের সর্ববৃহৎ ফার্নিচার কারখানা উল্লেখ করে সেলিম এইচ রহমান বলেন, আমাদের গাজীপুরের কারখানাটিতে একসঙ্গে তিন হাজার শ্রমিক কাজ করতে পারে। কারখানাটি সম্পূণরূপে পরিবেশবান্ধব। পুরো কারখানা ধুলিমুক্ত। হাতিলের পণ্যের ফিনিশিং লেকার পরিবেশ সহায়ক। তাই পরিবেশের কোনো ক্ষতি হয় না। এ ছাড়া আসবাব তৈরির সময় বের হওয়া টুকরা কাঠসহ অন্যান্য উপকরণ পুনরায় ব্যবহার করা হচ্ছে। 

হাতিলের সফলতা তুলে ধরে সেলিম এইচ রহমান বলেন, ধৈর্য ও ব্যবসার স্বাভাবিক গতি হাতিলকে শীর্ষস্থানে এনেছে। ফার্নিচার ক্যাটাগরিতে গত তিন বছর টানা শীর্ষ ভ্যাট প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে পুরস্কৃত হয়েছে। বাণিজ্য মেলায় সেরা প্যাভিলিয়নের পুরস্কার জিতেছে সর্বশেষ বছরসহ বেশ কয়েকবার। এ ছাড়া এইচএসবিসি গ্রিন অপারেশন ক্ল্যাইকেট অ্যাওয়ার্ডসহ অনেক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। 

(https://tbsnews.net/companies/timber-shop-going-global-39087)

 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.