চীনে কাঁকড়া রপ্তানি বন্ধ, দামও কম হওয়ায় চাষী ও ব্যবসায়ীরা দিশেহারা

বাংলাদেশ

বাগেরহাট প্রতিনিধি
21 January, 2021, 12:30 pm
Last modified: 21 January, 2021, 12:37 pm
সারাদেশে দুই লক্ষাধিক মানুষ কাঁকড়া চাষ ও ক্রয়-বিক্রয়ের সাথে জড়িত। বাগেরহাটের চাষীদের উৎপাদিত বেশিরভাগ কাঁকড়া বেশি দামে চীনে রপ্তানি করা হত। কিন্তু করোনা ভাইরাসের কারনে রপ্তানী বন্ধ হওয়ায় ক্ষতির মুখে পড়েছে চাষী ও ব্যবসায়ীরা। করোনাকালে বাগেরহাটের চাষীদের শত কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।

করোনা ভাইরাসের কারণে চীনে কাঁকড়া রপ্তানি বন্ধ ও দাম কমে যাওয়ায় লোকসানে পড়ছেন চাষীরা। লোকসানের মুখে বাগেরহাট জেলার প্রায় ৬ হাজার খামারি চাষাবাদ বন্ধ করে দিয়েছেন।দেনগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন চাষী ও কাঁকড়া ক্রয়-বিক্রয়ের সাথে জড়িত লক্ষাধিক মানুষ। ব্যা্ংক ঋণ, এনজিও এবং মহাজনদের সুদের চাপে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন সংশ্লিষ্টরা।তবে মৎস্য বিভাগ বলছেন এক হাজার ৬৩ জন কাকড়া চাষীকে সহায়তা দিবে সরকার।

বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার ভাগা গ্রামের কাঁকড়া চাষী পিনাক দাস বলেন, "১১ বিঘা জমিতে আমার ৪টি কাঁকড়ার খামার রয়েছে। ৮ লক্ষ টাকা পুজি হারিয়ে আমি নিঃস্ব হয়ে পড়েছি। বর্তমানে চাষাবাদ বন্ধ করে দিয়েছি। কিন্তু ব্যাংক ও দাদোনদারদের চাপে বাড়িতে ঘুমানোর সুযোগ নেই"।

কাঁকড়া চাষে ৪৬ লক্ষ টাকা পুঁজি হারিয়ে আরেকজন চাষী দিপঙ্কর মজুমদার এখন দুশ্চিন্তায় পড়েছেন;  কিভাবে দেনা পরিশোধ করবেন তা নিয়ে রয়েছেন শঙ্কায়। কাঁকড়া রপ্তানি বন্ধ থাকায় এবং খামারে চাষ করা কাঁকড়া মরে যাওয়ায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে জানান তিনি। দিপঙ্কর বলেন, "চিংড়ি চাষে নানা প্রকার রোগ বালাইয়ের কারণে তেমন লাভ হচ্ছিল না। পরে ২০১৮ সালে কাঁকড়া চাষ শুরু করি। লাভও ভাল হয়ে থাকে। একপর্যায়ে ২০১৯ সালের শেষের দিকে বড় আকারে কয়েকটি কাঁকড়া খামার করি। কিন্তু ২০২০ সালে প্রথম দিকে করোনার থাবায় কাঁকড়া রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়। রপ্তানি বন্ধ ও দাম কমে যাওয়ায় সব খামারের কাঁকড়া সময়মত বিক্রি করতে পারায় কাঁকড়া মরে যায়।করোনার প্রকোপ সামান্য কমতে থাকলে গেল বছরের শেষের দিকে ধারদেনা করে আবারও চাষ শুরু করি। কিন্তু উৎপাদিত কাঁকড়া সরাসরি চীনে না যাওয়ায় দাম অর্ধেকে নেমে আসছে। যার ফলে কাকড়া বিক্রি করে আমাদের উৎপাদন খরচও উঠছে না"।

শুধু দিপঙ্কর মজুমদার ও পিনাক নয় রামপাল, মোংলা বাগেরহাট সদরসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলার কাঁকড়াচাষীদের একই অবস্থা। কাঁকড়া চাষ বন্ধ করেও স্বাভাবিক থাকতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা। আর যারা লোকসানের মুখেও কাঁকড়া চাষের সাথে রয়েছে, তারাও বিপুল পরিমান লোকসানে পড়ছেন। কারণ কাকড়া উৎপাদনের খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে, কমেছে দাম। এই অবস্থায় চায়নায় কাঁকড়া  রপ্তানি চালু করতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও বিনাসুদে ঋণ দিয়ে এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখার দাবি জানিয়েছেন চাষীরা।

বর্তমান বাজার দর বিষয়ে বাগেরহাটের কাঁকড়া ব্যবসায়ী সাধন কুমার সাহা বলেন, "রপ্তানিযোগ্য কাঁকড়া সাধারণত ৫টি গ্রেডে বিক্রয় হয়। যা প্রত্যেক গ্রেডে ৬ থেকে ৭শ টাকা কেজিতে কমেছে। ২শ গ্রাম (ফিমেল) ওজনের কাঁকড়ার কেজি ছিল ২২শ টাকা সেই কাঁকড়া বর্তমানে ৮শ টাকা, একশ ৮০ গ্রামের কাঁকড়া ছিল ১ হাজার টাকা তা বর্তমানে ৬শ টাকা,  ১শ ৫০ গ্রামের কাঁকড়া ছিল ৮শ টাকা এখন তা ৪শ টাকা, একশ গ্রামের কাঁকড়া ছিল ৬শ বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৩শ টাকায়। এই দামে কাঁকড়া বিক্রি করে চাষীদের যেমন খরচ ওঠে না। তেমনি ব্যবসায়ীদেরও পড়তে হয় লোকসানে"।

বাংলাদেশ কাঁকড়া সরবরাহ সমিতির সাধারণ সম্পাদক অজয় দাস বলেন, সারাদেশে দুই লক্ষাধিক মানুষ কাঁকড়া চাষ ও ক্রয়-বিক্রয়ের সাথে জড়িত। বাগেরহাটের চাষীদের উৎপাদিত বেশিরভাগ কাঁকড়া বেশি দামে চীনে রপ্তানি করা হত। কিন্তু করোনা ভাইরাসের কারনে রপ্তানী বন্ধ হওয়ায় ক্ষতির মুখে পড়েছে চাষী ও ব্যবসায়ীরা। করোনাকালে বাগেরহাটের চাষীদের শত কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। বন্ধ হয়ে গেছে প্রায় ৬ হাজার কাঁকড়ার খামার। চীনে কাঁকড়া রপ্তানিসহ সরকারিভাবে সহযোগিতা না পেলে এসব চাষীরা নিস্ব হয়ে যাবে বলে দাবি করেন তিনি।

বাগেরহাট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ড. খালেদ কনক জানান, "বাগেরহাটে উৎপাদিত কাঁকড়া চীন, জাপান, মালয়েশিয়া, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড, কোরিয়ায় রপ্তানি হত। এর মধ্যে চীনেই রপ্তানি হয় ৮০ শতাংশ। হঠাৎ করে চীনে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়। যার ফলে চাষী ও ব্যবসায়ীরা যেমন বিপাকে পড়েছে। সরকারও রাজস্ব হারাচ্ছে। এ অবস্থায় আমরা চাষীদের ধৈর্য্য ধারণের পরামর্শ দিচ্ছি। সরকারিভাবে বাগেরহাটের এক হাজার ৬৩ জন খামারিকে প্রনোদোনা দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। বর্তমানে সরাসরি চীনে কাঁকড়া না গেলেও থাইল্যান্ড হয়ে চীনে কাঁকড়া রপ্তানি হওয়ায় দাম কমে যাওয়ায় চাষীরা দুশ্চিন্তায় পড়েছেন"।

মৎস্য বিভাগ জানিয়েছে,  জেলার বিভিন্ন উপজেলায় সরকারি হিসেবে  ১ হাজার ৮৫৯টি কাঁকড়া খামার রয়েছে। এসব খামারের চাষীর সংখ্যা ১ হাজার ৬৭০ জন।  তবে  বেসরকারি হিসেবে জেলায় কাঁকড়া খামারের সংখ্যা আট হাজারের অধিক । ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২ হাজার ৬২৯ টন কাঁকড়া রফতানি করা হয়। কিন্তু করোনা প্রাদুর্ভাবের পর থেকেই বদলে যেতে থাকে সে চিত্র।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.