চমেক হাসপাতালের ভুল, ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ না করেই ফিরে যাচ্ছে চীন

বাংলাদেশ

সিফায়াত উল্লাহ
31 January, 2020, 09:45 am
Last modified: 31 January, 2020, 10:13 am
ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, 'চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ চীনের চাহিদা অনুযায়ী জায়গা দিতে পারছে না। এজন্য তারা বিনিয়োগ না করে ফিরে যাচ্ছে।'

ঢাকার পরে চট্টগ্রামে হওয়ার কথা ছিল ১০০ শয্যার বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট। সে অনুযায়ী ২০১৬ সালে অর্থায়নে এগিয়ে আসে চীন সরকার। চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়। এই বার্ন ইউনিট গড়ে তুলতে ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের পরিকল্পনা করে চীন। এজন্য কয়েক দফা চট্টগ্রাম পরিদর্শন করে চীনা প্রতিনিধিদল। তবে শেষ পর্যন্ত চাহিদা অনুযায়ী জায়গা না মেলায় ফিরে যাচ্ছে চীন।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক দেশের বার্ন ইউনিট সম্প্রসারণ কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, "চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ চীনের চাহিদা অনুযায়ী জায়গা দিতে পারছে না। এজন্য তারা বিনিয়োগ না করে ফিরে যাচ্ছে।"

দীর্ঘদিন ধরে চট্টগ্রামে একটি বার্ন ইউনিট গড়ে তোলার চেষ্টা করছি। চীনা প্রতিনিধিদল ২০১৬ সালে চট্টগ্রাম সফর করে চমেক হাসপাতালের ২০ কাঠার একটি জায়গা পছন্দ করে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও জায়গাটি বার্ন ইউনিটের জন্য বরাদ্দ দিতেও রাজী হয়। সেই অনুযায়ী কাজ অনেকদূর এগিয়েছিল।

কিন্তু ২০১৯ সালে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, ওই জায়গাতে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) রেডিওলজি ইউনিট গড়ে তুলবে। তৎকালীন হাসপাতাল প্রশাসন জায়গাটি ২০১৪ সালে জাইকাকে বরাদ্দ দেয় বলে জানান হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। বলেন ডা. সামন্ত লাল সেন।

তিনি আরও বলেন, "এরই মধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে চমেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, জাইকার প্রকল্প সমন্বয়ক ও চীনা প্রতিনিধিদলের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক হয়েছে। কিন্তু তারা কোনো সমাধানে পৌঁছাতে পারেননি। এটা খুবই দুঃখজনক ঘটনা। জায়গার অভাবে চট্টগ্রামে বার্ন ইউনিট গড়া সম্ভব হচ্ছে না।"

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ একই জায়গা চীন ও জাইকাকে বরাদ্দ দেওয়ায় মূলত জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। এটি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ভুলের কারণে হয়েছে বলে স্বীকার করেছেন চমেক হাসপাতালের বর্তমান উপ-পরিচালক ডা. আখতারুল ইসলাম।

যে কারণে ফিরে যাচ্ছে চীন

চমেক হাসপাতাল সূত্র জানায়, ২০১৪ সালে হাসপাতালে রেডিওলজি ইউনিট নির্মাণ করার প্রস্তাব দেয় জাইকা। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাতে সম্মত হয়ে প্রশাসনিক ভবন সংলগ্ন খালি জায়গাটি রেডিওলজি ইউনিট করার জন্য জাইকাকে বরাদ্দ দেয়। জাইকা সেই অনুযায়ী কাজ করছে।

একই জায়গাটি ২০১৬ সালে বার্ন ইউনিট গড়ার জন্য চীনকে বরাদ্দ দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। চীনও বার্ন ইউনিট নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু করে। ২০১৬ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর ৯ সদস্যের একটি চীনা প্রতিনিধি দল চমেক হাসপাতাল পরিদর্শন করে। এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় প্রায় ১০০ কোটি টাকা।

২০১৮ সালে চীনের আরেকটি প্রতিনিধিদল হাসপাতাল পরিদর্শন করে। একই বছরের ২৮ মার্চ নিজেদের অর্থায়নে চট্টগ্রামে বার্ন ইউনিট স্থাপন করে দেওয়ার চূড়ান্ত সম্মতির পাশাপাশি চুক্তি স্বাক্ষরের লক্ষে লেটার অব এক্সচেঞ্জের ড্রাফট চূড়ান্তকরণের অনুরোধ জানিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীন অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) অতিরিক্ত সচিব বরাবর চিঠি প্রদান করে চীনা দূতাবাস। পরবর্তী সময়ে এ প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষে চমেক হাসপাতালের তৎকালীন পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জালাল উদ্দিনকে প্রধান করে ৫ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। পাশাপাশি বার্ন ইউনিট তৈরির জন্য নকশার কাজ শেষ করে চীন।

২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে আবারও হাসপাতাল পরিদর্শনে আসে চীনের একটি প্রতিনিধি দল। তখন ওই দলকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, জায়গাটিতে রেডিওলজি ইউনিট করবে জাইকা। এরপর রেডিওলজি ও বার্ন ইউনিট নির্মাণে জটিলতা সৃষ্টি হয়।

ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, ‘চীনা প্রতিনিধিদল জানিয়েছে, বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট নির্মাণে জায়গা নির্ধারণ হওয়ায় তাদের সরকার অবকাঠামোর নির্মাণের অনুমোদন দিয়েছে। ইতোমধ্যে ভবনের নকশা তৈরির কাজ শেষ। নতুন কোনো জায়গায় বার্ন ইউনিট নির্মাণ করতে চাইলে আবারও অনুমোদন নিতে কয়েক বছর সময় লাগবে।

অন্যদিকে রেডিওলজি ও ইমেজিং ইউনিট প্রকল্পের ডিপিপি ইতোমধ্যে একনেকে অনুমোদন হয়েছে। ফলে জায়গা পরিবর্তন করতে হলে আবারও ডিপিপি তৈরি নতুনভাবে অনুমোদন নিতে হবে। এরই মধ্যে এ কাজটি করতে পাঁচ বছর সময় লেগেছে।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বিকল্প জায়গা দেওয়ার প্রস্তাব দিলেও দুই পক্ষ তাতে রাজি হয়নি।

ইতোমধ্যে রেডিওলজি ইউনিটের অবকাঠামো নির্মাণের জন্য ভৌত কাজ শুরু করেছে জাইকা। অন্যদিকে চীন বিনিয়োগ না করে ফিরে যাচ্ছে।

হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. আখতারুল ইসলাম বলেন, ‘‘প্রশাসনকি ভবনের পাশে খালি জায়গার পরিমাণ প্রায় ২০ কাঠা। ইতোমধ্যে কিছু অংশ জাইকাকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সেখানে এখন প্রায় ১২ কাঠা জায়গা খালি রয়েছে। আমরা চীনকে সেই জায়গায় ১০ তলা ভবন করে বার্ন ইউনিট গড়ে তোলার জন্য প্রস্তাব দিয়ে চিঠি দিয়েছি। কিন্তু সেই প্রস্তাবে তারা রাজী হয়নি।’’

শিল্প এলাকা হওয়ায় চট্টগ্রামে প্রায়ই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। বিশেষ করে পুরাতন জাহাজ ভাঙার কারখানাগুলোতে প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের তথ্যমতে, চট্টগ্রাম জেলায় ২০১৯ সালে ৭২৬টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।

কিন্তু চট্টগ্রামে আগুনে পোড়া রোগীদের চিকিৎসা হয় শুধু চমেক হাসপাতালে। এখানে ২৬ শয্যার বার্ন ইউনিট থাকলেও নেই পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা। প্রতিদিন গড়ে ৪০ থেকে ৫০ রোগী থাকলেও ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (আইসিইউ) ছাড়া চলছে ইউনিটটি। চিকিৎসকসহ নার্স-কর্মচারী সংকটতো রয়েছে। এজন্য প্রায়ই দগ্ধ রোগীকে ঢাকায় প্রেরণ করতে হয়।

চমেক বার্ন ইউনিটের প্রধান ডা. রফিক উদ্দিন আহমেদ বলেন, "আইসিইউ, এইচডিইউ না থাকায় মুমূর্ষু রোগীদের প্রায়ই ঢাকায় পাঠাতে হয়। পোড়া রোগীদের চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রামে একটি আলাদা বার্ন হাসপাতাল খুবই প্রয়োজন।"

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.