গরিবের গরু-ছাগল ও গাছের টাকা কর্তাদের পকেটে

বাংলাদেশ

27 December, 2020, 02:50 pm
Last modified: 27 December, 2020, 02:56 pm
পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের একটি সূত্র জানায়, পরিকল্পনা কমিশনের ওই প্রতিবেদনের পর প্রকল্পটির কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

বগুড়ার সারিয়াকান্দি ও সোনাতলা উপজেলার চর এলাকায় বসবাসরত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে সরকারের নেওয়া প্রকল্পের গরু-ছাগল বিতরণ, গাছ লাগানো, প্রশিক্ষণসহ নানা কর্মসূচীরে জন্য বরাদ্দ হওয়া প্রায় ৩০ কোটি টাকার অধিকাংশ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে।

এই অভিযোগ উঠেছে প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) বগুড়া পল্লী উন্নয়ন একাডেমীর যুগ্ম পরিচালক সমীর কুমার সরকারসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে।

এই প্রকল্প মূল্যায়ন করে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে দেওয়া এক প্রতিবেদনে এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্র উঠে এসেছে। পরিকল্পনা কমিশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগ প্রকল্পটির অগ্রতির মূল্যায়ন করে সাম্প্রতিক এই প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।

জানা যায়, প্রায় ৩০ কোটি ৫৫ লাখ কোটি টাকার এই প্রকল্প ২০১৭ সালে গ্রহণ করে করে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ। সরকারি অর্থায়নে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। ওই বছরের জুন থেকে প্রকল্প বাস্তবান শুরু হয়।

সারিয়াকান্দি এবং সোনাতলা উপজেলার (সারিয়াকান্দি উপজেলার ৬টি ইউনিয়ন এবং সোনাতলা উপজেলার ২ টি ইউনিয়ন) মোট ৮টি (চর) ইউনিয়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। প্রকল্পের আওতায় চরাঞ্চলের ১৬ হাজার দরিদ্র লোকজনকে সুবিধা দেওয়ার কথা।

২০২০ সালের জুন মাসে এই প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা থাকলেও আগামী বছরের জুন পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়। এর আগেই প্রকল্পের পুরো বরাদ্দ ব্যয়ের হিসেব দেখানো হলেও পরিকল্পনা কমিশনের তদন্তে এই অনিয়মের বিষয় উঠে এসেছে।

গরু-ছাগলের টাকা

ডিপিপি অনুযায়ী এ বছরের জুন মাসের মধ্যে ৬ হাজার পরিবারের মধ্যে ৩ হাজার গরু ও ৩ হাজার ছাগল বিতরণ বাবদ  ৮ কোটি ১০ লাখ টাকার বরাদ্দ রয়েছে। সেপ্টেম্বর ২০২০ পর্যন্ত সময়ে মোট ৭ কোটি ৯৫ লাখ টাকা ব্যয়ে ২ হাজার ৯১২টি গরু ও ২ হাজার ৯৩১টি ছাগল বিতরণ করার হিসেব দেখান প্রকল্প কর্তারা।

পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ জানায়, মাঠ পর্যায়ে তদন্ত করে পরিকল্পনা কমিশনের প্রতিবেদনে জানা যায়, বাস্তবে তিন কোটি টাকার কম খরচ করা হয়েছে এই ক্যাটাগরিতে।

গাছের না লাগিয়েই

ডিপিপি'তে দুটি উপজেলায় ৩ হাজারটি ফলজ বৃক্ষ ও ৬ হাজারটি কাষ্ঠল বৃক্ষের চারা রোপনের মাধ্যমে বনায়ন করার কথা থাকলেও গত অক্টোবর পর্যন্ত মাত্র ২৩৩ জন সুফলভোগীর প্রত্যেককে গড়ে ৪টি করে মোট ৯৩২টি চারা বিতরণ করার কথা বলেছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।

ডিপিপি'তে প্রতিটি চারার মূল্য ১০০ টাকা নির্ধারিত ছিল। সে হিসেবে ব্যয় করা হয়েছে ১০ লক্ষ টাকা।

পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখার দায়িত্বরত একজন টিবিএসকে বলেন, মাঠে খবর নিয়ে জানা গেছে এই প্রকল্পের আওতায় বাস্তবে কোনো গাছ লাগানো হয়নি। কিন্তু বরাদ্দের সকল টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে।

প্রশিক্ষণ না দিয়েও বরাদ্দ শেষ

ওই প্রকল্পের আওতায় পশুপালন, দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকরণ ও পশু চিকিৎসাসহ ১৪টি ক্যাটাগরিতে মোট ১২ হাজার ২২০ জনকে প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য ৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দ ধরা হয়।
অগগ্রতির প্রতিবেদনে বলা হয়, চার বছরে মাত্র ৪৫০জনকে প্রশিক্ষণ দিয়ে বরাদ্দের পুরো টাকা ব্যয় দেখিয়েছেন প্রকল্প কর্মকর্তারা।

গাভীর কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্রের টাকা আত্মসাৎ

পরিকল্লনা কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, ডিপিপি অনুযায়ী গাভীর ২টি কৃত্রিম প্রজনন ইউনিট করার কথা রয়েছে এবং এ খাতে (৭৫০টি গাভীর কৃত্রিম প্রজনন সহায়তা ও খাদ্য সরবরাহ, ৫০ লিটারের ৫টি নাইট্রোজেন ক্যান, ১০ লিটারের ১০টি নাইট্রোজেন ক্যান, ২ লিটারের ২৫টি নাইট্রোজেন ক্যান, ২ হাজার বোভিন সিমেন, ৫০ হাজার সিমেন স্ট্র, ৩০০ ইনার লাইনার) মোট ৮৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকা টাকা বরাদ্দ রয়েছে। কিন্তু প্রকল্পটির কার্যক্রম পরিদর্শনকালে কোনো কৃত্রিম প্রজনন ইউনিট পাওয়া যায়নি।

কাগজে নলকুপ থাকলেও বাস্তবে নেই

ডিপিপি অনুযায়ী ৩০০টি সুফলভোগী পরিবারকে ৩০০টি হস্তচালিত অগভীর নলকূপ সরবরাহের জন্য ৬২ লাখ ১৩ হাজার টাকা বরাদ্দ রয়েছে। বাস্তবে এ খাতের সমুদয় টাকা ব্যয় করা হলেও কোনো নলকূপ সরবরাহ করা হয়নি বলে পরিকল্পনা কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়।

এছাড়াও ডিপিপি অনুযায়ী প্রকল্প এলাকায় সোলার অপারেটেড রুরাল পাইপড ওয়াটার সাপ্লাই সিস্টেমের মাধ্যমে পানি সরবরাহে ৪টি এলাকায় গভীর নলকূপ স্থাপন, ওভার হেড ট্যাংক জন্য বরাদ্দ হওয়া ২ কোটি ৯৮ লাখ টাকার মধ্যে ১ কোটি ৮৬ লাখ টাকা খরচ দেখিয়ে মাত্র একটি গভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে বলে পরিকল্পনা কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়।

দেড় হাজার পায়খানার জন্য বরাদ্দের টাকা দিয়ে মাত্র ৪৮৯টি

পরিকল্পনা কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, ডিপিপি অনুযায়ী ১৫০০ সুফলভোগী পরিবারকে ১৫০০টি স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা বিতরণের বিপরীতে (প্রতিটির জন্য ৯৩৯০ টাকা) মোট ১ কোটি ৪০ লাখ টাকা বরাদ্দ রয়েছে। এ খাতে পুরো টাকা ব্যয় দেখিয়ে মাত্র ৪৮৯টি সুফলভোগী পরিবারকে স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা সরবরাহ করা হয়েছে।

অফিস না নিয়েও ভাড়া ও বিদ্যুৎ বিল

প্রকল্পটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সোনাতলা ও সারিয়াকান্দি উপজেলা কমপ্লেক্সে অফিস নেওয়া হয় এবং‌ ওই অফিস ভাড়া বাবদ মোট ৪৬ হাজার ৫০০ টাকা ব্যয় করা হয়। আরডিএ, বগুড়া'তে প্রকল্পের কোনো আলাদা অফিস নেই। কিন্তু আরডিএ, বগুড়া'র কৃত্রিম প্রজনন ল্যাব, বুল স্টেশন ও ডেইরি খামারের ভাড়া বাবদ ৩ লাখ ৭৩ হাজার টাকা এবং বিদ্যুৎ বিল বাবদ ৭ লাখ ১৫ হাজার টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে।

এছাড়াও ডিপিপি অনুযায়ী প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কাজের ভ্রমণ ব্যয় বাবদ ৫ লক্ষ টাকা বরাদ্দের শতভাগ ব্যয় করা রয়েছে। কিন্তু প্রকল্প অফিসের সংশ্লিষ্ট নথি ও ডকুমেন্ট পর্যালোচনায় দেখা যায়, এ খাতে মোট ১ লাখ ৪৭ হাজার ৯৩১ টাকা ব্যয় করা হয়েছে বলে পরিকল্পনা কমিশনের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

বন্যা  ও কৃষি পুনর্বাসনের বরাদ্দ ১০ শতাংশ ব্যয় করে দেখানো হয়েছে শতভাগ

 ডিপিপিতে কৃষি পুনর্বাসন খাতে ৪০০টি পরিবারকে (পরিবার প্রতি ২ হাজার টাকা) ৩ বছরে ৫০ লাখ টাকা এবং বন্যা পুনর্বাসন খাতে ৪০০টি পরিবারকে (পরিবার প্রতি ৫ হাজার টাকা) ৩ বছরে ৫০ লাখ টাকা মঞ্জুরি প্রদানের বিধান রয়েছে। কিন্তু প্রকল্প অফিসের সংশ্লিষ্ট নথি ও ডকুমেন্ট পর্যালোচনায় দেখা যায়, কৃষি ও বন্যা পুনর্বাসন বাবদ ২৫০ জনকে (প্রত্যেককে ৪ হাজার টাকা করে) মোট ১০ লক্ষ টাকা প্রদান করা হয়েছে। বাকি টাকার হদিস নেই।

পরিকল্পনা কমিশনের অগ্রগতির প্রতিবেদনে বলা হয়, স্যাটেলাইট স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র স্থাপন; গো-খাদ্য তৈরি সহায়তা, গরু মোটাতাজাকরণ ও উদ্যোক্তা তৈরি; দুগ্ধ বাজারজাতকরণ ও উদ্যোক্তা সৃষ্টির জন্য বরাদ্দ হওয়া প্রায় ৫ কোটি টাকা পুরোটাই খরচ না করে এবং ৩০ শতাংশ কাজ করে অর্থ নয়-ছয় করা হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্পটির পরিচালক (পিডি) বগুড়া পল্লী উন্নয়ন একাডেমির যুগ্ম পরিচালক সমীর কুমার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, পরিকল্পনা কমিশন যে অগ্রগতির প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে তা সঠিক  নয়।

টিআইর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান টিবিএসকে বলেন, শুধু এই প্রকল্প নয়, এ রকম যত প্রকল্প নেওয়া হয়, সবগুলোর ক্ষেত্রেই এ রকম অনিয়ম দুর্নীতি ও আত্মসাতের ঘটনা ঘটে।

তিনি বলেন, এসবের বিরুদ্ধে যারা ব্যবস্থা নেওয়ার কথা, তারাই রহস্যজনক কারণে চুপ থাকেন। ফলে থামানো যাচ্ছে না এসব অনিয়ম।

পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের সচিব রেজাউল আহসান টিবিএসকে বলেন, 'এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের প্রতিবেদনটি আমাদের নজরে এসেছে।  বিষয়টি তদন্ত করার জন্য একটি কমিটি করা হবে। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'

পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের একটি সূত্র জানায়, পরিকল্পনা কমিশনের ওই প্রতিবেদনের পর প্রকল্পটির কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.