খুচরা বাজারে চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে তরমুজ, সন্তুষ্ট কৃষক
- ঢাকার বিভিন্ন পাইকারি বাজারগুলো থেকে প্রতিদিন বিক্রি হয় ৫ কোটি টাকার তরমুজ
- বাদামতলীর ওয়াইজঘাটে প্রায় ৬০টি আড়ৎ, প্রতিদিন বিক্রি প্রায় ২ লাখ পিস
- কারওয়ান বাজারে প্রায় ৪০টি আড়ৎ, প্রতিদিন বিক্রি লক্ষাধিক পিস
- পাইকারি বিক্রি পিস হিসেবে হলেও কেজি দরে খুচরা বিক্রি
- কোথাও কোথাও তরমুজ কেটেও বিক্রি হয় কেজি দরে
- এ বছর ১৫ লক্ষ মে. টনের উপরে উৎপাদনের লক্ষ্য
- প্রতি একরে উৎপাদন হয় প্রায় ৫ হাজার তরমুজ
- শুধু বরিশাল বিভাগেই উৎপাদন হয় প্রায় ৬৫ শতাংশ তরমুজ
আনিসুর রহমান, পটুয়াখালীর গলাচিপার হরিদেবপুরের একজন কৃষক। বেশ কয়েকবছর ধরেই নিজের জমিতে তরমুজের চাষ করছেন। এবছর অর্ধ-একর জমিতে তরমুজের চাষ করে ফলন হয়েছে আশানুরূপ। তার এ জমিতে তরমুজ চাষে খরচ হয়েছে প্রায় ৪৫ হাজার টাকা। তিনি বর্তমান বাজার অনুযায়ী প্রায় ৯০ হাজার টাকা লাভ করতে পারবেন বলে আশা করছেন।
আনিসুর রহমান টিবিএসকে বলেন, এক একর জমিতে প্রায় ৫ হাজার তরমুজ ফলে আর এক একরের ক্ষেতের তরমুজ বিক্রি হয় ৩.৫-৪ লাখ টাকায়। গড়ে প্রতিটি তরমুজ ৮০ টাকা দরে বিক্রি হয়। যেখানে ১৫কেজির ওপরে প্রতিটি তরমুজ ২০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করতে পারি।
তিনি আরও বলেন, 'এ বছর ভালো ফলনের সাথে আমরা ভালো দামও পাচ্ছি। সাধারণত কৃষকরা ক্ষেত থেকে তরমুজ পুরো ক্ষেতসহই বিক্রি করে দেয়। তরমুজের সাইজ অনুযায়ী দাম পাওয়া যায়। যাদের ক্ষেতের তরমুজের সাইজ বড় তারা ভালো দাম পায়। আমার ক্ষেতে এবার মাঝারি আকারের তরমুজই বেশি।
শুধু আনিসুর রহমানই নয় তার মতো যারা এ বছর তরমুজের চাষ করেছে সবারই ফলন ভালো হয়েছে বলে জানান কৃষকরা। অন্যান্য বছরের মতো এ বছর বৃষ্টি না হওয়ায় তরমুজ ক্ষেতের তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি।
তবে কৃষকরা বিগত বছরের দামে তরমুজ বিক্রি করলেও খুচরা বিক্রেতারা ২ থেকে ৩ গুণ দামে তা ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করছে।
কারওয়ান বাজার, বাদামতলী, বেরিবাঁধের তরমুজের পাইকারি বিক্রির আড়তগুলো ঘুরে দেখা যায়, ভোররাত থেকেই আড়তগুলোতে বরিশাল, পটুয়াখালী, ভোলা থেকে তরমুজ ট্রলার কিংবা ট্রাকে করে আসতে থাকে। ভোর থেকেই চলে বিকিকিনি। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা যায় অন্য বছরের তুলনায় এ বছর তরমুজের ফলন এবং বাজার দুটোই ভালো। কৃষকরাও দাম পাচ্ছে তাদের চাহিদা অনুযায়ী এবং খুচরা বিক্রেতারা আড়ৎ থেকে নিয়মিতই তরমুজ কিনে নিচ্ছেন।
তবে পাইকারি বাজারের সাথে খুচরা বাজারের দামের বেশ পার্থক্য লক্ষ্য করা গিয়েছে। খুচরা বিক্রেতারা আড়তগুলো থেকে পিস হিসেবে তরমুজ কিনলেও তা বাজারে উচ্চ দামে কেজি হিসেবে বিক্রি করছে। তারা প্রতি কেজি ১২-১৫ টাকা দরে কিনে খুচরা বাজারে ক্রেতাদের কাছে প্রতি কেজি ৩৫-৫০ টাকা দরে বিক্রি করছেন।
কারওয়ান বাজারে খুচরা বাজার থেকে তরমুজ কিনতে আসা তাহমিনা খানম টিবিএসকে বলেন, 'এতো বছর যাবত তরমুজ কিনে আসছি কিন্তু কখনও কেজি দরে কিনিনি। গত বছর থেকে তরমুজ কিনতে গেলেই বলে কেজি হিসেবে নিতে হবে। যে কারণে কেজি প্রতি তারা ২/৩ টাকা কমিয়ে দিলেও দাম আগের থেকে অনেক বেশি পড়ে যায়। অন্যান্য বছরের তুলনায় এবছর দাম একটু বেশিই নিচ্ছে'।
এদিকে বড় সাইজের তরমুজগুলো বিভিন্ন বিপনিবিতানগুলোতে কেটে ছোট ছোট খন্ড করেও বিক্রি করা হয়।
নোয়াখালীর সুবর্নচরের তরমুজ চাষী এনায়েত উল্লাহ্ টিবিএসকে বলেন, আমি এবছর ২ একর জমিতে তরমুজের চাষ করেছিলাম এবং তা ৪ লাখ টাকায় বিক্রি করেছি। এ বছর বৃষ্টি না হওয়ায় অধিকাংশ তরমুজের সাইজ ৪ থেকে ৬ কেজি হওয়ায় দাম কম পেয়েছি তবে ফলন ভালো। এখানে প্রায় ৫ হাজার তরমুজ হয়েছে। দুই একরে তরমুজ চায়ে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে।
বরিশালের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কৃষকদের থেকে তরমুজ কিনে সংগ্রহ করে ট্রাকে করে ঢাকায় এনে পাইকারি বিক্রি করে মো. ইদ্রিস বেপারী। তাদের ১৫ জনের একটা টিম এ ব্যবসার সাথে যুক্ত। তার ৮ বছরের তরমুজের ব্যবসায় এ বছর তরমুজের ফলন বেশি দেখছেন। বিক্রিও হচ্ছে ভালো।
ইদ্রিস বেপারী টিবিএসকে বলেন, 'বর্তমানে তরমুজের বাজার ভালো। আমরা প্রতি একর ক্ষেত (তরমুজসহ) ক্রয় করি ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা দরে। প্রতি একরে প্রায় ৬ হাজার তরমুজ হয়। আমরা ঢাকায় এনে ১২-১৫ কেজির তরমুজ ১৫০ টাকা, ৮-১২ কেজির ১০০ টাকা, ৬-৮ কেজি ৬০ টাকা এবং ৩-৪ কেজির তরমুজ ৪০ টাকা দরে বিক্রি করি'।
'আমরা প্রতি ট্রাকে প্রায় ৩০০০ পিস তরমুজ নিয়ে আসি এবং ট্রাক ভাড়া দিতে হয় ৩৫ হাজার টাকা। এক ট্রাক তরমুজ ৩ লাখ টাকার উপরে বিক্রি করতে পারি। অনেক সময় বেশি দামে কিনে কম দামেও বিক্রি করতে হয়। তবে এবছর এখনও লস হয়নি, বাজার ভালো'।
কারওয়ান বাজারের এক আড়তদার মো. আব্দুর রাজ্জাক টিবিএসকে বলেন, 'সিজনের প্রথম দিকে আমরা কালো তরমুজগুলো কেজি হিসেবে বিক্রি করতাম যখন দাম বেশি ছিল কিন্তু এখন কোথাও কেজি হিসেবে পাইকারি বিক্রি হয় না। আমরা প্রতিটি তরমুজ ৬০ থেকে ২০০ টাকা দরে পাইকারি বিক্রি করছি'।
খুচরা বিক্রেতারা তাদের ক্রয় হিসেবে প্রতি কেজি তরমুজ ১০ থেকে ১৫ টাকা দরে কিনলেও সেগুলো বাজারে ৩০ থেকে ৪০ টাকা দরে বিক্রি করছে। আবার কোথাও কোথাও ৫০ টাকা দরেও বিক্রি করছে।
পুরান ঢাকার বাদামতলীর এক আড়তদার মো. হান্নান শেখ টিবিএসকে বলেন, 'আমরা পাইকারি বিক্রিতে বড় সাইজের (১০-১৫ কেজি) তরমুজ ১২০-১৮০ টাকা দরে বিক্রি করি। সে হিসেবে কেজি প্রতি ১২-১৪ টাকা পরে'।
কারওয়ান বাজারে খুচরা বিক্রেতা রফিকুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, 'আমাদের প্রতি কেজি তরমুজ কিনতে এবং নিয়ে আসা পর্যন্ত খরচসহ ২৫ টাকা পড়ে যায় আর আমরা এগুলো ৩৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছি'।
বাদামতলী, ওয়াইজঘাট থেকে তরমুজ এনে ৪ জনে দোকানে বিক্রি করে এবং প্রতিদিন প্রায় ৪০ হাজার টাকার তরমুজ বিক্রি করেন বলেও জানান তিনি।
পিস হিসেবে কিনে কেজি হিসেবে কেন বিক্রি করছেন এবং দামও বেশি নিচ্ছেন এমন প্রশ্নের জবাবে মিরপুর তালতলা এলাকায় খুচরা বিক্রেতা নাদিম খান টিবিএসকে বলেন, 'সব যায়গায়তেই এখন তরমুজ কেজি হিসেবে বিক্রি হয়। আর তরমুজের দাম দোকান পর্যন্ত নিয়ে আসতে বেশ খরচ পরে যাই তাই সামান্য লাভ রেখেই ৩২ থেকে ৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করি'।
কারওয়ান বাজার আদর্শ ফল ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি আলহাজ্ব মাহবুবুল আলম বাবুল টিবিএসকে বলেন, 'যখন তরমুজের প্রথম সিজন থাকে তখন কেজি দরে বিক্রি হয়। তবে এখন পাইকারি ক্রয় বিক্রয় পিস হিসেবেই হয়। কারওয়ান বাজারে ৪০ টির মতো আড়ত রয়েছে। প্রতিদিন এ আড়তগুলো থেকে লক্ষাধিক পিস তরমুজ বিক্রি হয়'।
এ বছর তরমুজের বাজার ভালো উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'অন্য বছরের তুলনায় এ বছর তরমুজ বেশি বিক্রি হচ্ছে। দামও পাওয়া যাচ্ছে মোটামুটি। তরমুজের সিজন থাকে মার্চ মাসের শুরু থেকে মে মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত'।
তবে আড়তদার হিসেবে তরমুজ বিক্রির টাকার উপর ৬% হারে টাকাটাই তারা সংগ্রহ করেন।
ঢাকা মহানগর ফল আমদানি ও রপ্তানিকারক এবং আড়তদার ও ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি লিমিটেড এর সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বলেন, 'পুরান ঢাকার বাদামতলীর ওয়াইজঘাটে প্রায় ৬০ টি আড়ৎ আছে। অন্য বছরের তুলনায় এ বছর তরমুজের উৎপাদন ও বিক্রি ভালো। তরমুজের ক্ষেত্রে মধ্যস্বত্বভোগী বলতে খুচরা বিক্রেতারাই বেশি লাভ করছে। তবে এবার কৃষক ভালো দাম পাচ্ছে'।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, সর্বশেষ ২০২০ সালে সারাদেশে ৩৮,৮২৪ হেক্টর জমিতে ১,৪৫২,৫৯২ মে. টন তরমুজ উৎপাদন হয়েছে। এ বছর উৎপাদন ১৫ লাখ মে. টনেরও বেশি তরমুজ উৎপাদন হবে বলে তারা ধারণা করছেন।
এছাড়া ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সারাদেশে ৩৪,৬০৭ হেক্টর জমিতে ১,৩৬৭,৩৫৬ মে. টন তরমুজ উৎপাদন হয়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হর্টিকালচার উইং এর সহকারী উদ্যানতত্ত্ববিদ সাবিনা ইয়াসমিন টিবিএসকে বলেন, 'গত বছর তরমুজের ফলন ভালো ছিল এবং এ বছরও তার থেকে বেশি উৎপাদন হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। জুলাই মাসে আমরা নতুন বছরের হালনাগাদ তথ্য দিতে পারবো। সিজন শেষ না হলে কতটুকু জমিতে চাষ হলো এবং কি পরিমাণ উৎপাদন হবে সেটা বলা কষ্টকর'।