কোভিড-১৯: মোবাইল কোম্পানিগুলোর জন্য আশীর্বাদ হলেও গ্রাহকের জন্য নয়

বাংলাদেশ

12 January, 2021, 02:50 pm
Last modified: 12 March, 2021, 01:09 pm
টেলিযোগাযোগ সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো উল্লেখযোগ্য হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করলেও, গ্রাহকরা কল ড্রপ, সিগন্যাল না পাওয়া ও ধীর গতির ইন্টারনেটের মতো সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন।

২০২০ সালে দেশের টেলিযোগাযোগ সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায় ৪৫ লাখ নতুন গ্রাহক পায়। এরমধ্যে শীর্ষ দুটি মোবাইল ফোন অপারেটরই পেয়েছে ৪৪ লাখ গ্রাহক, যা নতুন গ্রাহকের ৯৭ শতাংশ।

একই সময়ে ইন্টারনেট গ্রাহকের সংখ্যা বেড়েছে ১ কোটি ২৪ লাখ। এদিকে গত বছরের প্রথম নয় মাসে গ্রামীণফোন লাভ করেছে ২ হাজার ৫৮৫ কোটি টাকা; যা ২০১৯ সালের চেয়ে ৫৪ কোটি টাকা বেশি। 

অন্যদিকে, দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মোবাইল অপারেটর রবি গত বছরের প্রথম নয় মাসে ১১৫ কোটি টাকা লাভ করেছে, যদিও ২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠানটি ১৭ কোটি টাকার বেশি লাভ করতে পারেনি। 

মানুষের জীবন ও অর্থনীতিতে কোভিড-১৯-এর বিরূপ প্রভাব পড়লেও, মহামারিটি যেন টেলিযোগাযোগ সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য আশীর্বাদ হয়েই এসেছে। তা সত্ত্বেও প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমবর্ধমান চাহিদার সঙ্গে তাদের নেটওয়ার্ক সক্ষমতা বৃদ্ধি করেনি বলেই মত বিশেষজ্ঞদের। 

কলড্রপ, সিগন্যাল না পাওয়া, স্বল্প গতির ইন্টারনেট ইত্যাদি সমস্যার মুখোমুখি গ্রাহকরা নিয়মিতই হচ্ছেন। গত বছরের প্রথম আট মাসেই রবির গ্রাহকরা ৪৮ কোটি ১৭ লাখ, গ্রামীণফোন ও বাংলালিংকের গ্রাহকরা যথাক্রমে ৪৬ কোটি ১ লাখ ও ১৪ কোটি ৬৫ লাখ কলড্রপের শিকার হয়েছেন।

সদ্য বিবাহিত সুইটি বেগম থাকেন চট্টগ্রামে, স্বামীর কর্মস্থল ঢাকা। তারা যোগাযোগের জন্য মেসেঞ্জার, ইমো ও হোয়াটঅ্যাপের মতো অ্যাপগুলোর ওপর নির্ভরশীল। তবে ইন্টারনেটের স্বল্প গতি ও নেটওয়ার্ক সমস্যার কারণে প্রায়ই তাদের যোগাযোগ বিঘ্নিত হয়। 'ইন্টারনেটের গতির কারণে আমাদের কথাবার্তার স্বাভাবিক গতিই ব্যাহত হয়, নিজেদের অনুভূতিও বুঝে উঠতে পারি না,' বলেন সুইটি বেগম।

টেলিযোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, মোবাইল অপারেটররা নেটওয়ার্ক পরিসর বৃদ্ধি না করার কারণেই কলড্রপ ও দুর্বল সংযোগের মতো সমস্যাগুলো দেখা দিচ্ছে। প্রতিষ্ঠানগুলো দুই বছর আগের অবকাঠামো নিয়েই বর্তমানে বেশি মুনাফা করছে।

টেলিযোগাযোগ ও আইটি বিশেষজ্ঞ সুমন আহমেদ সাবির জানান, বেশ কিছু কারণে গ্রাহকরা বর্তমানে সবচেয়ে বাজে সেবা পাচ্ছে। 'প্রথমত, সরকার ফাইভজি নেটওয়ার্কের পরিকল্পনা করছে, এদিকে অপারেটরগুলো নেটওয়ার্ক পরিসর বৃদ্ধি করতে গত দুই বছরে কোনো বিনিয়োগ করেনি। শীর্ষ দুটি মোবাইল অপারেটর নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ঝামেলার কারণে নতুন বিনিয়োগও করতে পারেনি,' বলেন তিনি।

সুমন আহমেদ সাবির বলেন, টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষকেই টেলিযোগাযোগ সেবার উন্নতিতে পদক্ষেপ নিতে হবে। 

২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ স্পেকট্রাম নিলামের পর, গ্রামীণফোনের রয়েছে ৩৭ মেগাহার্জ স্পেকট্রাম, রবির ৩৬.৪ মেগাহার্জ, বাংলালিংকের ৩০.৬ মেগাহার্জ ও টেলিটকের ২৫.২ মেগাহার্জ। 

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (বিটিআরসি) মুখপাত্র জাকির হোসেন খান জানিয়েছেন, দুর্বল নেটওয়ার্ক পরিষেবার প্রধান কারণ মূলত অপারেটরগুলোর স্পেকট্রামের অভাব। 'দীর্ঘদিন ধরেই নতুন স্পেকট্রাম বরাদ্দ দেওয়ার আলোচনা চলছে। আমরা আশা করছি, মোবাইল অপারেটরগুলো শিগগিরই এ ব্যাপারে ঐক্যমতে পৌঁছাবে। 

তবে দুর্বল নেটওয়ার্ক সেবার ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করেনি গ্রামীণফোন। 

বাংলালিংকের চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স অফিসার তৈমুর রহমান এ ব্যাপারে বলেন, 'টাওয়ার সম্পর্কিত কিছু অমীমাংসিত বিষয়ের জন্য, এক বছরের বেশি সময় ধরে আমরা নতুন টাওয়ার বসাতে পারিনি।'

'দেশজুড়ে আমাদের নেটওয়ার্ক পরিসর বৃদ্ধি প্রয়োজন। কয়েক মাস আগেই এ সংক্রান্ত বিষয় সমাধান করেছি। নেটওয়ার্ক পরিসর বৃদ্ধি করতে আমরাই প্রথম প্রতিষ্ঠান হিসেবে টাওয়ার কোম্পানিগুলোর সঙ্গে চুক্তি করেছি,' বলেন তিনি। 

'আমাদের সেবার মানের প্রশংসা করেছে বৈশ্বিক সংস্থাগুলোও। ওকলা বাংলালিংককে দেশের সবচেয়ে দ্রুত গতির মোবাইল নেটওয়ার্ক আখ্যা দিয়েছে,' যোগ করেন তিনি।

শুধু মোবাইল ডেটা সার্ভিসই নয়, ব্যবহারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়েনি ব্যান্ডউইথ সক্ষমতাও। নতুন ইন্টারনেট গ্রাহকদের কারণে গত বছরের তুলনায় ইন্টারনেট ব্যবহার বেড়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ, গত বছর ১১৯২ জিবিপিএস থেকে ডেটা ব্যবহার বেড়ে হয়েছে ১৮২৬ জিবিপিএস।

এদিকে ২০১৯ সালের তুলনায় গত বছর ইন্টারনেট সেবা প্রদানের সক্ষমতা বেড়েছে মাত্র ২০ শতাংশ, ১৯৯৫ জিবিপিএস থেকে বেড়ে এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৪০১ জিবিপিএস। এ কারণেই মোবাইল নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট গ্রাহকরা কল ড্রপ, ধীর গতির ইন্টারনেট ও ভিডিও স্ট্রিমিংয়ের সময় বাফারিংয়ের মতো সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন।

ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারস অ্যাসোসিয়েশোন অব বাংলাদেশের মহাসচিব মো. ইমদাদুল হক বলেন, গুণগত পরিষেবা দেওয়ার জন্য যথেষ্ট অবকাঠামোগত সক্ষমতা রয়েছে তাদের। 'তবে, কিছু সময় সিটি করপোরেশন ও অন্যান্য সংস্থার কাজে কেবল কাটার কারণে পরিষেবার গুণগত মান বাধাগ্রস্ত হয়,' বলেন তিনি।

সর্বাধিক গ্রাহক সংখ্যা গ্রামীণফোনের 

বিটিআরসি জানিয়েছে, গত বছরই নতুন ৪৫ লাখ গ্রাহক পাওয়ার পর ডিসেম্বরের হিসাব অনুযায়ী দেশের মোবাইল অপারেটরগুলোর মোট গ্রাহক ১৭.০১৩ কোটি। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের মোট মোবাইল সিম গ্রাহক সংখ্যা ছিল ১৬.৫৫ কোটি।

দেশের চারটি মোবাইল অপারেটরের মধ্যে গ্রাহজ সংখ্যা সবচেয়ে বেশি গ্রামীণফোনের। অপারেটরটির বর্তমান গ্রাহক সংখ্যা ৭.৯০ কোটি। গত বছরের একই সময়ে এ সংখ্যা ছিল ৭.৬৪ কোটি। 

গ্রামীণফোন লিমিটেডের প্রধান জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. হাসান বলেন, 'গ্রামীণফোন প্রতিনিয়ত উদ্ভাবন, বিস্তৃত থ্রিজি ও ফোরজি নেটওয়ার্ক ও প্রতিযোগিতামূলক বাজারে ডিজিটাল সমাধান নিয়ে আসার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে।'

'কোভিড-১৯ মহামারির সময়ে জিপির নেটওয়ার্ক নিউ-নরমাল পরিস্থিতি অনুযায়ী গ্রাহকদের চাহিদা মিটিয়েছে,' বলেন তিনি। 

সবচেয়ে কম নতুন গ্রাহক ছিল বাংলালিংকের। গত বছর অপারেটরটির মাত্র ৩০ হাজার নতুন গ্রাহক পায়। বাংলালিংকের চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স অফিসার তৈমুর রহমান এ ব্যাপারে বলেন, 'মহামারির কারণে ২০২০ সাল আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জিং সময় ছিল। এ সময়ে আমাদের গ্রাহক সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও, অন্য অপারেটরগুলোর তুলনায় এ হার খুবই কম।'

স্বল্প সংখ্যক নতুন গ্রাহকের ব্যাপারে তিনি বলেন, 'এসএমপি অপারেটরগুলোর প্রভাবে এ বাজারে ছোট অপারেটরগুলোর টিকে থাকা বেশ কঠিন বলে প্রতীয়মান হয়।'

'এ কারণেই এসএমপি অপারেটরগুলোর বাধ্যবাধকতা পালনে নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। তবে এ রকম কোনো পদক্ষেপই দেখতে পাইনি আমরা।'

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.