কীটনাশক ব্যবহারে জমি হারাচ্ছে উর্বরতা

বাংলাদেশ

পার্থ পবিত্র হাসান, পাবনা
15 December, 2019, 03:05 pm
Last modified: 15 December, 2019, 03:19 pm
পাবনার তিনটি উপজেলার মাটি পরীক্ষা করে শতকরা ৬২ শতাংশ জমিতে পাওয়া গেছে ভয়াবহ মাত্রার আর্সেনিক, ফসফরাস ও জিংক। যা বিষাক্ত করছে মাটি ও উৎপাদিত ফসলকে।

কৃষি সমৃদ্ধ জেলা পাবনায় মাটির গুনাগুণ পরীক্ষা ছাড়াই লাগামহীনভাবে ব্যবহার হচ্ছে সার ও কীটনাশক। মাটিতে বিষাক্ত রাসায়নিক উপাদান ভয়াবহভাবে বেড়ে যাওয়ায় প্রতিবছর উর্বরতা হারাচ্ছে বিপুল পরিমান কৃষি জমি। সম্প্রতি পাবনার তিনটি উপজেলার মাটি পরীক্ষা করে শতকরা ৬২ শতাংশ জমিতে পাওয়া গেছে ভয়াবহ মাত্রার আর্সেনিক, ফসফরাস ও জিংক। যা বিষাক্ত করছে মাটি ও উৎপাদিত ফসলকে। ফলে স্বাস্থ্য ঝুঁকির পাশাপাশি হুমকিতে পড়েছে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন।

দেশে মোট উৎপাদিত পেঁয়াজের এক তৃতীয়াংশ সরবরাহ হয় ‘পেঁয়াজের রাজধানী’ হিসেবে খ্যাত পাবনা থেকে। জেলার সুজানগর, সাথিয়া, চাটমোহর, বেড়াসহ অধিকাংশ অঞ্চলে পেঁয়াজ চাষের ওপর নির্ভর করে অধিকাংশ কৃষক। পেঁয়াজের পাশাপাশি আবাদ হয় রসুন, কালোজিরা, ধান, পাটসহ বিভিন্ন ফসল। 

পাবনায় জমি থেকে ফল সংগ্রহ করছেন কৃষকরা। / ছবি : দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড

দেশে সবজি উৎপাদনে শীর্ষ জেলাগুলোর মধ্যেও অন্যতম পাবনা। পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলা সবজি চাষের জন্য দেশের অন্যতম বৃহৎ অঞ্চল। এ উপজেলার মুলাডুলি, আওতাপাড়া, সলিমপুর, পাকশীসহ আশেপাশের এলাকায় বিপুল পরিমান সবজির আবাদ হয়ে থাকে। এছারাও বাসেরবাদা, আওতাপাড়ার বিভিন্ন অঞ্চলে বছরে প্রায় ১০ কোটি পিস লেবু উৎপাদিত হয়। স্থানীয় কৃষকদের উৎপাদিত শিম, ফুলকপি, বাধাকপি, শসা, গাঁজর, টমেটো ছাড়াও বিভিন্ন সবজি পাঠানো হয় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে সবজি কিনতে পাইকারী ব্যাপারীরা ভিড় করেন এখানে। এছাড়া এই অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে আবাদ করা হয় লিচু, পেয়ারা, বরই, স্ট্রব্রেরি, তরমুজসহ দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সুস্বাদু ফল। সবজি মৌসুমে ওই এলাকা থেকে প্রতিদিন প্রায় ২০ ট্রাক সবজি ঢাকার উদ্দেশ্যে পাঠানো হয়।

কৃষি বিজ্ঞানীদের মতে, পাবনায় ৫টি শ্রেণির মাটি দ্বারা গঠিত প্রায় একলাখ ৮৬ হাজার হেক্টর বিভিন্ন বৈশিষ্ঠ্যের কৃষি জমি রয়েছে।  কৃষকরা ভালো ফলনের আশায় অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার করায় নষ্ট হচ্ছে মাটির উর্বরতা। তবে মাটির রাসায়নিক উপাদানের তারতম্যের উপর ভিত্তি করে সুষম সার ব্যবহার করে এখনো মাটির স্বাস্থ্য সুরক্ষা করা সম্ভব।

পাবনা মৃত্তিকা সম্পদ ইনস্টিটিউটের উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কমকর্তা ড. ফারুক হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ঈশ্বরদী এবং গাজনার বিল বিধৌত সুজানগর আর আটঘড়িয়া উপজেলার বিভিন্ন শ্রেণির মাটি পরীক্ষা করে অধিকাংশ মাটিতেই পাওয়া গেছে উদ্বেগজনক মাত্রার ফসফরাস, জিংক ও আর্সেনিক। যা বিষাক্ত করে তুলছে মাটি এবং উৎপাদিত শাক সবজীসহ ফসলকেও। 

তিনি আরও বলেন, সম্প্রতি মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট পাবনার বিভিন্ন অঞ্চলেরর মাটির শ্রেণি এবং বৈশিষ্ঠ অনুসারে ৩৮৬ টি নমুনা পরীক্ষা করে দেখতে পায়, শতকরা ৯০ শতাংশ জমিই দ্রুত হারিয়ে ফেলছে উর্বরতা শক্তি। প্রায় শতভাগ বাণিজ্যিক জমিতেই পাওয়া যায়নি পরিমিত মাত্রার জৈব পদার্থ। অতি নিম্ন এবং নিম্ন মাত্রার জৈব পদার্থ পাওয়া গেছে ৫০ শতাংশ জমিতে। এ ছাড়া অধিকাংশ মাটিতেই হাইড্রোজের সক্রিয়তা, ফসফরাস, নাইট্রোজেন, দস্তাসহ সব উপাদানই ভারসাম্যহীন।

পাবনায় ক্ষেতে ঝুলছে তরমুজ। / ছবি : দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ডা. ইফতেখার মাহমুদ বলেন, ‘‘খাবারের মধ্য দিয়ে এসব বিষাক্ত রাসায়নিক উপাদান মানুষের দেহে প্রবেশ করছে। অনেকেই এসব বিষাক্ত রাসায়নিকের প্রভাবে অকালেই আক্রান্ত হচ্ছেন হাই ব্লাড প্রেসার, ডায়াবেটিকস, হৃদরোগ, মস্তিস্কে রক্ত ক্ষরনসহ নানা মরনঘাতি নানা ব্যধিতে।’’

পাবনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আজাহার আলী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ‘‘শুধু জনস্বাস্থ্যই নয়, সুষম সার ব্যবহার না করার কারণে উৎপাদিত ফসলও নানা রোগ বালাইয়ে আক্রান্ত হচ্ছে। অনুমান নির্ভর রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে এ সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। মাটি পরীক্ষার মাধ্যমে সঠিক মাত্রায় সুষম সার ব্যবহার করা হলে বৃদ্ধি পাবে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন।’’

তিনি আরও বলেন, ‘‘নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের উপর সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে কৃষকদের মাটির স্বাস্থ্য পরীক্ষার মাধ্যমে সুষম সার গ্রহণের উপর ব্যবহারিক ধারণা দেয়া হচ্ছে। অবশ্য পাবনার কিছু এলাকায় কৃষকেরা নিজ উদ্যোগে কম্পোজড সার তৈরি করছে। এ সার ব্যবহার করে ইতিবাচক ফলাফলও পাওয়া গেছে।’’

পাবনা কৃষি গবেষনা ইন্সটিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. রবিউল আলম মনে করেন, জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারনে অধিকাংশ কৃষকই মাটির স্বাস্থ্য পরীক্ষা ছাড়াই যত্রতত্র সার এবং কীটনাশক ব্যবহার করছে। লাগামহীন এন্টিবায়োটিক ব্যবহারের কারণে মানুষ যেমন স্বাস্থ্য ঝুকিতে পড়েছে অনুরুপভাবে কৃষিতে কোনো রকম পরীক্ষা নীরিক্ষা ছাড়াই সার এবং কীটনাশক ব্যবহারের ফলে মাটিও স্থায়ীভাবে হারিয়ে ফেলছে উর্বরতা শক্তি।

অচিরেই জমির উর্বরতা শক্তি রক্ষার জন্য সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহন না করলে কৃষি উৎপাদনে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসতে পারে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.