কারার ডিআইজি’র গোপন জামিনকে ‘হতাশা ও লজ্জাজনক’ বললেন হাইকোর্ট
দুর্নীতি দমন কমিশনের এক আলোচিত মামলার আসামীকে গোপনে জামিন দেওয়ার ঘটনায় বিচারিক আদালতের সংশ্লিষ্ট বিচারকের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন হাইকোর্ট।
একইসাথে বিচারিক আদালতের সকল আদেশ ও রায় প্রকাশ্যে ঘোষণা করতে বিচারিক আদালতের সকল বিচারককে নির্দেশ দিয়ে আদেশ দিয়েছেন আদালত।
৮০ লাখ টাকাসহ হাতে নাতে গ্রেপ্তার হওয়ার ঘটনার মামলায় বরখাস্ত হওয়া ডিআইজি প্রিজন্স পার্থ গোপাল বণিককে গোপনে বিচারিক আদালতের দেওয়া জামিন বাতিল করে গত ২ সেপ্টেম্বর রায় ঘোষণা করেন বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ। বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে ১১ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়ে এই নির্দেশসহ কয়েকটি পর্যবেক্ষণ দেন আদালত।
হাইকোর্ট বলেছেন, "স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নিম্ন আদালতসমূহের বিচারকের জামিনসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অন্তবর্তী আদেশ ও রায় প্রকাশ্য আদালতে সংশ্লিষ্ট পক্ষগণ বা তাদের আইনজীবীদের উপস্থিতিতে ঘোষণা করার নির্দেশ দেয়া হলো।"
পার্থ গোপাল বণিকের জামিন আদেশ গোপনে দেওয়ার ঘটনায় হাইকোর্ট বলেছেন, "জামিন দরখাস্তটি শুনার পর বিচারক তাৎক্ষণিকভাবে প্রকাশ্য আদালতে কোন আদেশ প্রদান করেননি, যা সংশ্লিষ্ট আইনজীবীগণ কর্তৃক স্বীকৃত; এবং আদেশটি অতিগোপনে কারা কর্তৃপক্ষের নিকট প্রেরণ করা হয়, যা সংশ্লিষ্ট পক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবীরাও জ্ঞাত ছিলেন না।"
আদালত বলেছেন, ''এ ধরনের ঘটনা হতাশা ও লজ্জাজনক এবং আইনের সাথে সংগতিহীন। সংশ্লিষ্ট আইনসমূহে অর্থাৎ ফৌজদারী কার্য বিধির ধারা ৩৬৬ এবং ক্রিমিনাল রুলস এ্যান্ড অর্ডার্স (প্র্যাক্টিস অ্যান্ড প্রসিকিউটর অফ্ সাব-অর্ডিনেট কোর্টস), ২০০৯ রুল ১৭৯(২)-এ সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে 'রায়' প্রকাশ্য আদালতে সংশ্লিষ্ট পক্ষদের উপস্থিতিতে প্রদান করতে হবে। যদিও আইন ও বিধিতে 'রায়' শব্দটি উল্লেখ রয়েছে, কিন্তু আইন ও বিধির মর্ম হলো গুরুত্বপূর্ণ যেকোনো বিষয়ে আদালতের আদেশ/সিদ্ধান্ত প্রকাশ্য আদালতে প্রদান করতে হবে। তর্কিত আদেশ প্রদানের প্রক্রিয়া নানান প্রশ্নের সুযোগ করে দিয়ে বিচার বিভাগকেও বিতর্কিত করেছে।"
একইসাথে পার্থ গোপাল বনিকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলাটি ঢাকার বিশেষ আদালত-৫, হতে বিশেষ আদালত-৪, এ বদলি করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বিভিন্নসময় ছয়বার জামিন আবেদন করার পর হাইকোর্ট পার্থ গোপালের আবেদন খারিজ করে। একইসাথে বিচারিক আদালতে এই মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির নির্দেশ দেওয়া হয়।
হাইকোর্র্টের আদেশ অমান্য করে গত ১৯ জুন জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের পার্থ গোপাল বণিকে জামিন দেন ঢাকার বিশেষ জজ আদালতের বিচারক মো. ইকবাল হোসেন। জামিন আদেশটি গোপনে দেওয়া হয় বলে একটি বেসরকারি টেলিভিশনে সংবাদ প্রকাশিত হয়।
বিষয়টি হাইকোর্র্টের নজরে আসলে পার্থ গোপল বনিকের জামিন কেন বাতিল করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। একইসাথে গোপনে জামিন দেওয়ার বিষয়ে ঢাকার বিশেষ জজ আদালতের বিচারক ইকবাল হোসেনের কাছে ব্যাখ্যা চান আদালত।
পরবর্তীতে বিচারক ইকবাল হোসেন অস্বাভাবিক জামিন আদেশ দেওয়ায় হাইকোর্র্টের নিশর্ত ক্ষমা চেয়ে আবেদন করেন।
গত ২ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট বিষয়টি নিষ্পত্তি করে রায় ঘোষণা করেন। রায়ে পার্থ গোপল বনিকের জামিন বাতিল করে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন।
পূর্ণাঙ্গ রায়ে হাইকোর্ট আরও বলেন, "আমাদের বলতে দ্বিধা নেই যে, জেলা জজ পর্যায়ের একজন বিচারকের কাছ থেকে এধরনের আচরণ ও কর্ম প্রত্যাশিত নয়। তার এ ধরনের আদেশ উচ্চ আদালতের প্রতি অবজ্ঞা এবং যা আদালত অবমাননার সামিল। হাইকোর্ট বিভাগ ইতিপূর্বে আসামীর জামিন নাকোচ করে দ্রুত মামলার নিষ্পত্তির নির্দেশ দিয়েছিল। বিজ্ঞ বিচারক আসামীকে জামিন প্রদান করে হাইকোর্টের আদেশ-কে অবজ্ঞা করেছেন।"
"বিচারক মোঃ ইকবাল হোসেনকে সর্ব্বোচ্চ সতর্ক করা হলো যেন ভবিষ্যতে মামলা পরিচালনা ও উচ্চতর আদালতের আদেশ প্রতিপালনে আরো সতর্ক ও যথাযথ ভাবে দায়িত্ব পালন করেন। উপরোক্ত সতর্কতার বিষয়টি রেজিষ্ট্রার, হাইকোর্ট বিভাগ-কে তার ডিসিআরে সংরক্ষণের নির্দেশ দেয়া হলো।"
হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, "এই রায় ও আদেশের কপি প্রয়োজনীয় অবগতি ও ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট বিশেষ জজ আদালত-৫, ঢাকা, বিশেষ জজ আদালত-৪, ঢাকাসহ সচিব, ১.আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, ২. রেজিষ্টার, হাইকোর্ট বিভাগ, বাংলাদেশ (নিম্ন আদালতের বিজ্ঞ বিচারকদের অবহিত করবেন)-এর নিকট অবিলম্বে প্রেরণ করা হোক।"
২০১৯ সালের ২৭ জুলাই ডিআইজি পার্থ গোপাল বণিক চট্টগ্রামে দায়িত্ব পালন করছিলেন। তখন তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত ৮০ লাখ টাকা অর্জন করেন। সেই টাকা তিনি তার নিজ বাসার ক্যাবিনেটে লুকিয়ে রাখেন। অনুসন্ধানকালে অভিযান পরিচালনা করে তার বাসা থেকে ওই টাকা জব্দ করা হয়।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, আসামি পার্থ গোপাল বণিক গত বছরের ২৮ জুলাই দুদকে হাজির হয়ে অনুসন্ধান টিমের কাছে বক্তব্য দেন। জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে পার্থ গোপাল বণিক জানান, রাজধানীর কাঠালবাগান এলাকায় তার বাসায় ৩০ লাখ টাকা নগদ আছে। এই টাকার বৈধ উৎস তিনি দেখাতে পারেননি। পরে অভিযান চালিয়ে তার বাসা থেকে ৮০ লাখ টাকা জব্দ করা হয়।