করোনায় মৃত্যুতে এ মাসে কবর খোঁড়া হয়েছে দ্বিগুণ
সারি সারি কবর খুঁড়ে রাখা হচ্ছে রাজধানীর রায়েরবাজার কবরস্থানে। করোনায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় এমন আগাম প্রস্তুতি। কবরস্থান সংশ্লিষ্টরা বলছেন এ মাসের গত দুই সপ্তাহে গড়ে ১০-১২ টি করোনা লাশ দাফন করা হয়েছে এখানে, যা গত মার্চ মাসের তুলনায় দ্বিগুন দাফনের সংখ্যা। গোর খোঁড়ার কাজে নিয়োজিতরা বলছেন বর্তমানে করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় অতিরিক্ত দাফনের চাপ সামাল দিতেই নতুন খালি কবর খুঁড়ে রাখতে হচ্ছে।
রাজধানীর রায়েরবাজারে গোর খোঁড়ার কাজে নিয়োজিত কর্মী সাইফুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, 'এই মাসের আগেও দিনে ৫-৬ টি মতো কবর খুড়তাম। কিন্তু এখন করোনার মৃ্ত্যু বেড়ে যাওয়ায় গত ১৫ দিন গড়ে প্রায় ১০-১২ টি করে লাশ দাফন করতে হচ্ছে'।
হৃদয় হোসেন নামক আরেকজন গোরখোদক বলেন, 'আমরা মোট ৩০ জন মিলে কবরস্থান খোঁড়া থেকে শুরু থেকে সকল রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করি। ইদানিং দেখা যাচ্ছে হঠাৎ একসাথে ৫-৭ লাশও দাফনের জন্য নিয়ে আসছে। যার জন্য তাৎক্ষণিক করব খুঁড়তে আমাদের কিছুটা বেগ পেতে হচ্ছে। তাই এখন আমরা হাতে না খুড়ে মেশিন দিয়ে অতিরিক্ত অনেক খালি কবর খুঁড়ে রাখেছি। তবে আমরা নিজেরাও জানি না আসলে এগুলো কাদের কবর হবে'।
রায়েরবাজার কবরস্থান ঘুরে দেখা যায়, কবরস্থানের ৮ নম্বর ব্লকটিতে এখন সকল করোনা লাশ দাফন করা হয়। সেখানে প্রায় ১০০ টির মতো নতুন খালি কবর খুঁড়ে রাখা হয়েছে।
লাশ নিয়ে আসলেই চলছে করোনায় মৃতদের দ্রুত দাফনের কাজ। পিপিই পরিহিত কিছু লোক এম্বুলেন্স থেকে করোনার লাশ নামাচ্ছেন। পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন স্বজনরা। আত্নীয়-স্বজনদের মধ্যে করোনা মৃত্যু নিয়ে আগের মতো ভীতি-আতঙ্ক না থাকলেও খুব একটা লোকের ভীড় দেখা যাচ্ছে না। স্বাভাবিকের তুলনায় কম মানুষ আসছেন লাশের সাথে।
শুক্রবার দুপুরে রায়েরবাজার কবরস্থানে দেখা যায়, হোসনে-আরা নামক একজনের লাশ গাড়ি থেকে নামানো হয়। এ সময় তার বড় ছেলে রায়হান কিবরিয়া টিবিএসকে বলেন, 'আমার মা গতকাল রাতে নিজ বাসাতেই করোনায় মারা গেছেন। আমাদের গ্রামের বাড়ি রংপুর। কিন্তু আমরা ভাই-বোন সবাই এখন ঢাকাতেই থাকি। তাই মায়ের কবর ঢাকাতে দিতে চাই। আর করোনাতে মৃত্যু হওয়ায় গ্রামে লাশ নিয়ে গেলে কোন ঝামেলায় পড়তে হয় কিনা তাই আর গ্রামে যোগাযোগ করিনি। তাই সরকার নির্ধারিত রায়েরবাজার কবরস্থানেই দাফন করতে নিয়ে এসেছি আমার মাকে'।
রায়েরবাজার কবরস্থানের সিনিয়র কর্মকর্তা (মোহরার) আবদুল আজিজ টিবিএসকে বলেন, 'এ মাসের শুরু থেকেই দাফনের চাপ বেড়ে গেছে। এপ্রিলের প্রথম ১৫ দিনেই ১৭০ টির মতো করোনা লাশ দাফন করা হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। যা গত মার্চ মাসের ১৫ দিনে ছিল মাত্র ৮৮টি'।
তিনি আর বলেন, 'গত বছরের ২৭ এপ্রিল থেকে ১৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গড়ে ৩-৫ টি করে মোট ৮৪২ করোনার লাশ দাফন হয়েছে এখানে। তারপর নভেম্বর থেকে এ বছরের ফ্রেব্রুয়ারি পর্যন্ত গড়ে ১ টি করে লাশ দাফন করতে হয়েছে। কিন্ত এ বছরের মার্চ মাসের শেষ দুই সপ্তাহে আবারও চাপ বেড়ে যায়, গড়ে ৫-৬ টি করে করোনা লাশ দাফন করতে হয়। এবং এ মাসে অর্থাৎ ১ এপ্রিলের পর থেকে এখন পর্যন্ত দিনে গড়ে ১০-১২টির মতো লাশ দাফন করতে হচ্ছে। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত এখানে সর্বমোট ১১ শতাধিক করোনায় মৃতদের লাশ দাফন করা হয়েছে'।
তিনি আরও বলেন, কারো ব্যক্তিগত কবর ছাড়া ঢাকার দুই সিটির সকল করোনায় মৃতদের এখানেই দাফন করা হচ্ছে। খিলগাঁও কবরস্থানে ১৬০টি এবং আজিমপুর কবরস্থানে ৩-৫টি লাশ দাফন করার পর এলাকাবাসীর প্রতিবাদে সেসব জায়গায় আর এখন দাফন হয় না।
তবে তিনি বলেন, 'রায়েরবাজারে যে পরিমাণ কবর দেয়ায় জায়গা খালি আছে তাতে যদি দৈনিক ৫০ জনকেও দাফন করতে হয় আশা করি আগামী ২০-৩০ বছরেও এখানে কবরের জায়গার সংকট হবে না'।
এদিকে ঢাকার দুই সিটির বাইরে ডেমরা-মাতুয়াইল কবরস্থান ঘুরে দেখা যায়, সেখানেও করোনার মৃত্যুতে দাফনে চাপ বেড়েছে।
মাতুয়াইল কবরস্থানের গোর খোঁড়ার কর্মী শাহজাহান টিবিএসকে বলেন, 'আগে দৈনিক ২-৩ টি কবর খোঁড়ার প্রয়োজন হতো। এ এপ্রিল মাসে এসে এখন দৈনিক ৫-৬টি কবর খোঁড়া লাগতেছে। ৭ জন গোর খোঁড়ার লোকবল দিয়ে দাফন কাজ সামলানো এখন বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। কবরস্থান কমিটিকে বলেছি আরও লোকবল বাড়ানোর জন্য'।
মাতুয়াইল কবরস্থানের অফিস সহকারি আবদুল কাদের বলেন, ' এ এপ্রিল মাসের গত ১০ দিনে এখানেও বেশ দাফনের চাপ বেড়েছে। গত মার্চ মাস পযন্ত এখানে গড়ে ৩-৪ টি লাশ দাফন হতো, এখন সেখানে দৈনিক ৫-৬টির অধিক লাশ দাফন করা হচ্ছে'।
তিনি আর বলেন, 'এখানে আসলে কে করোনায় মৃত আর কে স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেছে সে হিসেব রাখা হয় না। তবে করোনা আসার আগের বছর ২০১৯ সালে এখানে দাফন হয়েছে মাত্র ১১০১ জন। করোনার পর গত বছর ২০২০ এই কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে সবমিলিয়ে ১৮২৫ জনকে'।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তারের তথ্যমতে, এ বছরের ১ এপ্রিল থেকে গতকাল বুধবার পর্যন্ত সারাদেশে করোনায় মারা গেছেন ১১৩৬ জন। এবং এ পর্যন্ত দেশে ১০ হাজার ৬৮৩ জনের মৃত্যু হয়েছে কোভিডজনিত কারণে।