করোনায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দর্জিদের কাজ কমেছে ৬০ শতাংশ

বাংলাদেশ

07 May, 2021, 10:55 am
Last modified: 07 May, 2021, 05:14 pm
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হেফাজতে ইসলামের চালানো তাণ্ডব এবং করোনার সংক্রমণ রোধে লকডাউনের কারণে দোকানপাট বন্ধ থাকায় ঈদের কাজের অর্ডার নিতে পারেননি দর্জিরা।
  • ১০ রোজা পর্যন্ত কাজের অর্ডার নেওয়া হয়, কিন্তু এবার হেফাজত তাণ্ডব ও লকডাউনের  কারণে অর্ডার নিতে পারেননি।
  • করোনায় কর্মহীন হয়ে অনেক কারিগর পেশা বদল করে দিনমজুরি করছেন।

সারাবছরই কাজে ব্যস্ত সময় কাটে দর্জিদের। প্রতিবছর ঈদুল ফিতরের আগে সেই ব্যস্ততা আরও বেড়ে যায়। রাত-দিন মিলিয়ে গ্রাহকদের কাপড় সেলাই করেন কারিগররা। কিন্তু এবারের প্রেক্ষাপট একেবারেই উল্টো। কাজের আশায় অলস সময় পার করতে হচ্ছে তাদের। মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দর্জিদের কাজ কমেছে অন্তত ৬০ শতাংশ। এতে করে অনেক দর্জি কর্মহীন হয়ে পড়েছেন।

এছাড়াও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের বিরোধিতা করে গত ২৬ থেকে ২৮ মার্চ পর্যন্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হেফাজতে ইসলামের চালানো তাণ্ডব এবং করোনার সংক্রমণ রোধে লকডাউনের কারণে দোকানপাট বন্ধ থাকায় ঈদের কাজের অর্ডার নিতে পারেননি দর্জিরা।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় নারী ও পুরুষের পোষাক এবং পাঞ্জাবী সেলাই করা হয়- এমন অন্তত দুই হাজার দর্জি দোকান আছে। এসব দোকানে কর্মসংস্থান হয়েছে অন্তত ১০ হাজার কারিগরের। এই কারিগরদের হাতে সারাবছরই কাজ থাকে। তবে রোজার মাস শুরু হওয়ার অন্তত ১০দিন আগে থেকে দর্জিদের কাজের চাপ দ্বিগুণ বেড়ে যায়।

এমনিতে বছরের অন্য সময়গুলোতে ছোট দোকানগুলোতে গড়ে প্রতি মাসে ৫০ হাজার টাকার কাজের অর্ডার আসে, মাঝারি দোকানগুলো গড়ে ১ লাখ এবং বড় দোকানগুলোতে প্রায় ২ লাখ টাকার কাজের অর্ডার পাওয়া যায়। সব খরচ মিটিয়ে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ লাভ হয় বলে জানিয়েছেন দর্জি দোকানিরা।

তবে রোজার মাসে ছোট দোকানগুলোতে প্রায় ১ লাখ টাকা, মাঝারি দোকানগুলোতে ২ লাখ এবং বড় দোকানগুলোতে প্রায় ৪ লাখ টাকার কাজের অর্ডার আসে। কারিগররা তখন রাত-দিন মিলিয়ে কাজ করে অর্ডার ডেলিভারি দেন। অবশ্য বাড়তি কাজের জন্য বাড়তি পারিশ্রমিকও দেওয়া হয় কারিগরদের। কাজের চাপের কারণে ১০ রোজার পর থেকেই কোনো দর্জি দোকানে নতুন করে কাজের অর্ডার নেওয়া হয়না।

কিন্ত এখন করোনাভাইরাসের কারণে কাজ কমে যাওয়ায় অনেকটা অলস সময় কাটছে কারিগরদের। কাজ কমে যাওয়ায় অনেক কারিগর কর্মহীন হয়ে পেশা বদল করে এখন দিনমজুরি করছেন। এ অবস্থা চলতে থাকলে আরও অনেক কারিগর বেকার হয়ে পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

৩৫ বছর ধরে দর্জির কাজ করছেন মো. মুসা মিয়া। কাপড় সেলাইয়ের জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের নামকরা প্রতিষ্ঠান সেঞ্চুরি টেইলার্স অ্যান্ড ফেব্রিকসের মাস্টার তিনি। বাড়িতে তার স্ত্রীও সেলাইয়ে কাজ করেন। এই কাজ করেই তাদের ৭ সদস্যের পরিবার চলে। 

মুসা মিয়া বলেন, 'আমার ওস্তাদ বলেছিলেন- দর্জিদের পেছনে ফিরে তাকতে হয়না। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে গতবছর থেকে কষ্ট করছি। আগে কাজের এত চাপ ছিল, যে ১৬-১৭ ঘণ্টা কাজ করতে হয়েছে। এখন ৫-৭ ঘণ্টাও কাজ করতে হয়না। আমাদের হাতে কাজ নেই বললেই চলে। আমাদের অনেক কারিগর বেকার হয়ে পড়েছে। যেহেতু হাত দিয়ে স্পর্শ করে মাপ নিতে হয়, সেজন্য অনেকেই করোনাভাইরাসের ভয়ে কাপড় সেলাই করতে চাননা। আমার এক সহকর্মী কর্মহীন হয়ে সংসার চালানোর জন্য তার একটি গরু বিক্রি করে দিয়েছেন। দর্জিদের এমন দুর্দিন আমার জীবনে আগে কখনও দেখিনি'।

কাপড় কাটছেন সেঞ্চুরি টেইলার্স অ্যান্ড ফেব্রিকসের মাস্টার মো. মুসা মিয়া

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কারিগর জানান, তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদরে ছোট একটি দর্জি দোকানে কাজ করতেন। গত বছর থেকেই করোনাভাইরাসের কারণে দোকানে আয় কমে যায়। এবার দ্বিতীয় ঢেউ শুরুর পর কাজ না থাকায় দোকানটি বন্ধ করে দেন মালিক। এর ফলে সংসার চালাতে এখন কৃষকের জমির ধান কাটছেন তিনি।

সেঞ্চুরি টেইলার্স অ্যান্ড ফেব্রিকসের স্বত্বাধিকারী মো. মোশারফ হোসেন বলেন, 'কাজ না থাকলেও দোকান ও কারখানা ভাড়া, বিদ্যুৎ বিলসহ অন্যান্য ব্যয় ঠিকই মেটাতে হচ্ছে। মানবিক দিক বিবেচনা করে কারিগরদের খরচের টাকাও দিতে হচ্ছে। অথচ গত বছর থেকেই দোকানের কাজ ৬০ শতাংশ কমে গেছে। ঈদের কিছু কাজের অর্ডার পাওয়ার আশা করলেও হেফাজতের তাণ্ডবের কারণে সেটিও আর হয়নি। আমাদের অর্ডার নেওয়ার সময়টাতেই হেফাজতের তাণ্ডব চলেছে। এখন শহরের পরিস্থিতি শান্ত হলেও মানুষজন আসছে না'।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের টি. এ. রোডের দি স্বপন টেইলার্সের স্বত্বাধিকারী আশরাফুল ইসলাম স্বপন বলেন, 'স্বাভাবিক সময়ে মাসে লাখ টাকার কাজের অর্ডার আসে। রোজার সময় এটি দ্বিগুণ হয়। এ সময় কারিগররাও বাড়তি টাকায় আয় করেন। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে হাতে কাজ একেবারেই কম। ১০-১২ রোজা পর্যন্ত কাজের অর্ডার নেই। কিন্তু এবার অর্ডার নেওয়ার সময়টাতেই তাণ্ডব চলেছে হেফাজতের। সেজন্য গ্রাহকরাও দোকানে আসতে পারেননি। এ অবস্থায় করোনাভাইরাস পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে আমাদের আরও অনেক কারিগর বেকার হয়ে পড়বে'।

 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.