করোনায় পর্যটকের ভিড় নেই সুসং দুর্গাপুরে 

বাংলাদেশ

সঞ্জয় সরকার, নেত্রকোনা
12 January, 2021, 11:40 am
Last modified: 12 January, 2021, 12:03 pm
সুসং দুর্গাপুরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে আরও মনোমুগ্ধকর করে তুলেছে সোমেশ্বরী ও আত্রাইখালি নামের দুই পাহাড়ি নদী। গারোপাহাড় থেকে ঝরনা ধারার মতো নেমে আসা এ দুই নদীও যেন বিচিত্র দুই জলধারা। বর্ষা মৌসুমে নদীগুলো বিপুল পরিমাণ প্রাকৃতিক কয়লা, পাথর ও সিলিকা বালি বয়ে আনে। এ কারণে নদীর বুকে মাইলের পরম মাইল চর জমে। নির্মাণশিল্পের কাঁচামাল হিসেবে এখান থেকে প্রতিদিন নানা উপায়ে হাজার হাজার মেট্রিকটন সিলিকাবালি সংগ্রহ করা হয়।

ভরা শীত মৌসুম চলছে। কিন্তু বরাবরের মতো এবার পর্যটকদের দেখা মিলছে না নেত্রকোনার প্রাকৃতিক  ও ঐতিহাসিক সৌন্দর্যের জনপদ সুসং দুর্গাপুরে। মূলত কোভিড-১৯ পরিস্থিতির কারণেই চলছে এমন অবস্থা। ফলে এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে স্থানীয় পর্যটনকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর।

জানা গেছে, ভারতের মেঘালয় রাজ্যের কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা এক রত্নগর্ভা উপজেলা দুর্গাপুর। ঐতিহাসিক কারণে এ এলাকাটি 'সুসং দুর্গাপুর' নামে পরিচিত। দুর্গাপুরের কুল্লাগড়া ও সদর ইউনিয়নের উত্তরদিকে রয়েছে ঘন সবুজ অরণ্যবেষ্টিত গারোপাহাড়। দূর থেকে দেখলে মনে হয় এক খন্ড ঘনকালো মেঘ যেন সেই কবে থেকে আকাশ-মাটির সঙ্গে মিতালী করে আছে। আইনি বাঁধার কারণে ভারতের সীমানায় অবস্থিত এসব পাহাড়ে আরোহন করা সম্ভব না হলেও বাংলাদেশের সীমানার ভিতরে দাঁড়িয়ে খুব কাছে থেকে এর সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। অন্যদিকে দুর্গাপুরের অভ্যন্তরে পাহাড় না থাকলেও আছে বেশকিছু পাহাড়সদৃশ বড় বড় টিলা। একটু সাহস করলেই অনায়াসে উঠা যায় এসব টিলার চূড়ায়। এদিকে বিজয়পুর এলাকায় টিলাগুলোর পরতে পরতে রয়েছে চিনামাটির খনি। মাটির গহিন স্তর থেকে সংগৃহীত এসব চিনামাটি সিরামিক শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়।      

সোমেশ্বরী নদীর ধারে গারো পাহাড়; ছবি: দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড

সুসং দুর্গাপুরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে আরও মনোমুগ্ধকর করে তুলেছে সোমেশ্বরী ও আত্রাইখালি নামের দুই পাহাড়ি নদী। গারোপাহাড় থেকে ঝরনা ধারার মতো নেমে আসা এ দুই নদীও যেন বিচিত্র দুই জলধারা। বর্ষা মৌসুমে নদীগুলো বিপুল পরিমাণ প্রাকৃতিক কয়লা, পাথর ও সিলিকা বালি বয়ে আনে। এ কারণে নদীর বুকে মাইলের পরম মাইল চর জমে। নির্মাণশিল্পের কাঁচামাল হিসেবে এখান থেকে প্রতিদিন নানা উপায়ে হাজার হাজার মেট্রিকটন সিলিকাবালি সংগ্রহ করা হয়। মরুভূমির মতো জেগে ওঠা সিলিকাবালির এসব চরকে অনেকটা সমূদ্র সৈকতের মতো মনে হয়। তাই শীত মৌসুমে মিষ্টি রোদের নিচে সৈকতসদৃশ এসব চরে হাঁটার প্রবল ইচ্ছে জাগে পর্যটকমনে।  

এদিকে বৈচিত্র্যময় জনবসতি এবং তাদের বিচিত্র জীবনধারাও সুসং দুর্গাপুরের প্রতি ভ্রমণপিপাসুদের আকৃষ্ট করে। কারণ বাঙালি ছাড়াও সেখানে রয়েছে গারো, হাজং, হদি, কোচ প্রভৃতি ক্ষুদ্র ও নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর বাস। এদের কেউ পাহাড় বা টিলার ওপর আবার কেউ পাহাড়-টিলার নিচে সমতলে বাস করে। যুগ যুগ ধরে বিরূপ প্রকৃতির সঙ্গে বিরামহীন সংগ্রাম করে টিকে আছেন এসব আদিবাসীরা। দুর্গাপুরে পা রাখলেই চোখে পড়ে ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরা খেটেখাওয়া আদিবাসী নারীদের কর্মচাঞ্চল্য। তারা কেউ পাহাড়ে কাঠ কুড়াচ্ছেন। আবার কেউ কেউ কাদামাটিতে দাঁড়িয়ে লাগাচ্ছেন ধানের চারা। কেউ আবার পাহাড়ি ছড়ায় (ঝরনার মতো ছোট্ট জলধারা) গর্ত করে বালির নিচ থেকে সংগ্রহ করছেন খাবার পানি। কখনও দেখা মেলে হাজং নারীরা জাখা দিয়ে শিকার করছেন মাছ। এদের ব্যতিক্রম জীবনধারা এবং নিজস্ব ভাষা-সংস্কৃতি পর্যটকমনে বাড়তি আনন্দ জোগায়।  

বনে কাঠ সংগ্রহ করতে যাচ্ছেন একজন গারো নারী; ছবি: দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড

দুর্গাপুরে বিভিন্ন জায়গায় অবস্থিত ক্ষুদ্র ও নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর কিছু প্রতিষ্ঠানও দর্শনার্থীদের নজর কাড়ে। এর মধ্যে রানীখং গ্রামের একটি টিলায় ১৯১২ সালে প্রতিষ্ঠিত সাধু জোসেফের ধর্মপল্লী উল্লেখযোগ্য। 'রানীখং মিশন' নামে খ্যাত এ ধর্মপল্লীটি স্থানীয় ক্যাথলিক খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী গারোদের একটি ঐতিহ্যবাহী প্রার্থনালয়। সেখানে রয়েছে বেশকিছু ঐতিহাসিক স্থাপনা, গীর্জা, ভাস্কর্য ও বাগান।  এছাড়াও বিরিশিরিসহ আরও কয়েকটি স্থানে গারোদের আরও বেশকিছু গীর্জা ও ধর্মীয় স্থাপনা রয়েছে। দুর্গাপুরের প্রবেশমুখ বিরিশিরিতে আছে 'ক্ষুদ্র ও নৃ-গোষ্ঠীর কালচারাল একাডেমি'। এটিও একটি পর্যটন স্পট। স্থানীয় গারো, হাজংসহ অন্যান্য আদিবাসী সম্প্রদায়ের নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষা, সংরক্ষণ ও চর্চার লক্ষ্যে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ১৯৭৭ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। একাডেমিতে রয়েছে: প্রশিক্ষণ কক্ষ, লাইব্রেরি, সংগ্রহশালা ও প্রদর্শনীকেন্দ্র, অডিটোরিয়াম, সুদৃশ্য বাগান এবং রেস্ট হাউজ। আদিবাসীরা ব্যবহার করেন এমন অনেক জিনিসপত্রের দেখা মেলে সংগ্রহশালায়। 
 
এদিকে ঐতিহাসিক কারণেও দুর্গাপুরের রয়েছে আলাদা পরিচিতি। কুল্লাগড়া ইউনিয়নের বহেরাতলি গ্রামে রয়েছে ঐতিহাসিক টঙ্ক আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত 'তীর-ধনুক' আকৃতির রাশিমণি স্মৃতিসৌধ। এছাড়া দুর্গাপুর সদরের বাগিচাপাড়ায় আছে 'টঙ্ক শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ' এবং কমরেড মণিসিংহের বাড়ি। সাধুপাড়ায় আছে সুসং মহারাজার সুদৃশ্য বাড়ি। দোর্দন্ড প্রতাপশালী সুসং রাজাদের নির্মিত ঘর, কাচারী, পুকুর ও মন্দিরসহ অনেক স্মৃতিচিহ্নের দেখা মেলে ওই রাজবাড়িটিতে গেলে। 

এছাড়াও বিরিশিরি গ্রামে অবস্থিত কমলরানীর দিঘি, চন্ডীগড় গ্রামের মানবকল্যাণকামী অনাথালয়, কুল্লাগড়ার রামকৃষ্ণ মঠ, দুর্গাপুর সদরের দশভূজা মন্দির, বিজয়পুরের স্থলশুল্ক  বন্দর, বিরিশিরি বধ্যভূমিসহ আরও অনেক দর্শনীয় স্থান রয়েছে সুসং দুর্গাপুরে। 

চিনামাটির খনি; ছবি: দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড

পর্যটন শিল্প বিকাশের উপযোগী রাস্তা, হোটেল ও মোটেলসহ অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ না হলেও প্রাকৃতিক, ঐতিহাসিক ও নৃ-তাত্ত্বিক সৌন্দর্যের টানে দুর্গাপুরে প্রায় সারা বছরই দেশি-বিদেশী পর্যটকদের আনাগোনা থাকে। তবে শীত মৌসুমে পর্যটকদের রীতিমোতা ঢল নামে। তখন স্পটগুলোতে তিল ধারনের জায়গা থাকে না। রমরমা হয়ে ওঠে পর্যটনকেন্দ্রিক নানা ব্যবসা। কিন্তু এবারই যেন ব্যতিক্রম। করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে অন্যান্যবারের তুলনায় চার ভাগের এক ভাগ পর্যটকও আসছে না এবার। বিজয়পুর, বিপিনগঞ্জ, রানীখং, বহেরাতলি, বিরিশিরি প্রভৃতি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, এসব জায়গার পর্যটন স্পটগুলো যেন খা খা করছে। খুব কম সংখ্যক পর্যটকের দেখা মিলছে সেখানে।

বিপিনগঞ্জে চিনামাটির খনির কাছে গিয়ে কথা হয় আব্দুল গফুর নামে এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে। প্রায় আটবছর ধরে সেখানে একটি ছোট টং দোকান পরিচালনা করেন তিনি। দূর-দূরান্ত থেকে আসা ভ্রমণপিপাসুদের জন্য চা, পান, সিগারেট, কোমল পানীয়, ডাব, বিস্কিট, চকলেট, আচার, টিস্যু পেপার প্রভৃতি বিক্রি করেন। স্বাভাবিক সময়ে ওই দোকান থেকে দিনে অন্তত ৫-৬শ টাকা আয় হতো তাঁর। শীত মৌসুমে আয় বেড়ে হতো প্রায় দ্বিগুন। কিন্তু এবার পর্যটকদের আনাগোনা না থাকায় দিনে দু-তিনশ টাকাও আয় হচ্ছে না তার। আব্দুল গফুরের মতো এমন অবস্থা সাহেব আলী, ফরিদ মিয়া, দিলুরা বেগমসহ আরও অনেকের। তারা বলেন, মানুষের আনাগোনা না থাকায় বন্ধ রয়েছে বহু দোকান।  

সোমেশ্বরী নদীর চর; ছবি: দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দুর্গাপুর সদরে ১২টি রেস্টুরেন্ট (খাবার হোটেল) এবং ১১টি গেস্ট হাউজ (আবাসিক হোটেল) রয়েছে। পর্যটকরাই এদের মূল গ্রাহক। কিন্তু অতিমারির কারণে রেস্টুরেন্ট এবং গেস্ট হাউজের ব্যবসা রীতিমতো লাটে ওঠেছে বলে জানিয়েছে এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকরা। নিরালা রেস্টুরেন্টের মালিক বিপ্লব মজুমদার বলেন, প্রতি বছর শীত মৌসুমে আমার খাবার হোটেলে দিন ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকার বেচাকেনা হতো। এবার ৪-৫ হাজার টাকাও হচ্ছে না। বাইরের মানুষের আনাগোনা নেই বললেই চলে। একই ধরনের প্রভাব পড়েছে পরিবহন ব্যবসায়ও। সেখানকার প্রায় পাঁচ শতাধিক যুবক ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালান। পর্যটকদের অল্প সময়ে বিভিন্ন স্পটে নিয়ে যায়। বলতে গেলে ওই যুবকরাও এখন প্রায় বেকার। অনেক সময় সারা দিনেও মিলে না একটি ভাড়া।

স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফারজানা খানম বলেছেন, করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের শুরুতে মার্চ মাসে দুর্গাপুরে পর্যটকদের আগমন নিষিদ্ধ করে একটি নির্দেশ জারি করা হয়েছিল। পরবর্তীতে সারা দেশের পর্যটন স্পটগুলো যখন খুলে দেয়া হয় তখন দুর্গাপুরের নিষেধাজ্ঞাও প্রত্যাহার করা হয়। কিন্তু সংক্রমণ না কমায় সচেতনতা থেকেই মানুষ বেড়াতে আসছে না। পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে কিছু উদ্যোগ নেয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, "আমরা হোম বেসড ট্যুরিজমের জন্য কিছু আদিবাসী বাড়ি নির্ধারণ করে দিচ্ছি যেখানে পর্যটকরা এসে স্বল্প খরচে থাকা-খাওয়ার সুবিধা পাবেন। তাছাড়া বিভিন্ন স্পটের ছবি, বর্ণনা এবং যাতায়াত সুবিধা উল্লেখ করে একটি এ্যাপস চালু করতে যাচ্ছি।"

 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.