করোনার প্রকোপ বাড়ায় ক্রেতার অভাবে রমজানের আগেই নিম্নমুখী ভোগ্যপণ্যের বাজার

বাংলাদেশ

04 April, 2021, 12:15 pm
Last modified: 04 April, 2021, 12:20 pm
দেশের ভোগ্যপণ্যের বৃহৎ পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে রমজানে প্রয়োজনীয় বেশির ভাগ ভোগপণ্যের দাম এখন নিম্মমুখী। তবে কিছু পণ্যের দাম এখন স্থির রয়েছে। প্রয়োজনীয় পণ্যের মধ্যে পাইকারিতে ভোজ্যতেল, চিনি ও ডাল জাতীয় পণ্য ছোলা, মটর, মসুর, খেসারি ডালের দাম কমেছে । 

করোনার প্রকোপ বৃদ্ধিতে হঠাৎ থমকে গেছে রমজানের প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের বাজার। সরবরাহ যথেষ্ট থাকলেও দেশের জেলা-উপজেলা থেকে পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা বাজারে না আসায় পণ্যের বিকিকিনি কমেছে বলে জানিয়েছেন খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা। 

এভাবে রমজানের আগ মুহুর্তে পণ্যের বিকিকিনি কমে যাওয়ায় লোকসানের শঙ্কায় রয়েছে বাজারের দ্বিতীয় সারির পাইকারি ব্যবসায়ীরা।  

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে দেশের ভোগ্যপণ্যের বৃহৎ পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে রমজানে প্রয়োজনীয় বেশির ভাগ ভোগপণ্যের দাম এখন নিম্মমুখী। তবে কিছু পণ্যের দাম এখন স্থির রয়েছে। প্রয়োজনীয় পণ্যের মধ্যে পাইকারিতে ভোজ্যতেল, চিনি ও ডাল জাতীয় পণ্য ছোলা, মটর, মসুর, খেসারি ডালের দাম কমেছে । 

খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ছৈয়দ ছগীর আহমদ বলেন, রমজানের প্রয়োজনীয় প্রায় সকল পণ্যের দাম কমে গেছে গত এক সপ্তাহে। এতে গত দেড়-দুই মাস থেকে আমদানিকারকরা পণ্য বিক্রি করে লাভবান হলেও বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ীদের বড় লোকসানের আশঙ্কা রয়েছে। কারণ করোনার প্রভাবে বাজারে ক্রেতা ও বিকিকিনি কমে যাওয়ায় কেনা দামের চেয়ে কম দামে পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ীরা। 

বর্তমানে খাতুনগঞ্জে পাইকারি পর্যায়ে মানভেদে প্রতিমণ (৩৭ দশমিক ৩২ কেজি) অস্ট্রেলিয়ার ছোলা বিক্রি হচ্ছে ২২০০-২৬০০ টাকার (কেজি ৫৯-৭০ টাকা) মধ্যে। এক সপ্তাহ-দশদিন আগেও বাজারে একই মানের ছোলা ২৩০০-২৭০০ টাকার (কেজি ৬২-৭২ টাকা) মধ্যে বিক্রি হয়েছে। 

সে হিসেবে এক সপ্তাহের ব্যবধানে ছোলার দাম মণে ১০০ টাকা পর্যন্ত কমেছে। এক সপ্তাহ আগেও বাজারে প্রতিমণ মিয়ানমারের ছোলা বিক্রি হয়েছে প্রতিমণ ২৮০০ টাকা দরে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে ১০০ টাকা কমে এখন মায়ানমারের ছোলা ২৭০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। 

এক সপ্তাহ আগেও বাজারে প্রতিমণ মটর বিক্রি হয়েছে ১৫০০ টাকার (কেজি ৪১ টাকা)। কিন্তু গত এক সপ্তাহের মধ্যে মণে ১০০ টাকা কমে বর্তমানে মটর বিক্রি হচ্ছে ১৪০০ টাকার মধ্যে (কেজি ৩৮ টাকা)। 

গত এক সপ্তাহে মণে ১১০ টাকা পর্যন্ত কমেছে আমদানিকৃত মসুরের দাম। বর্তমানে বাজারে প্রতিমণ কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার (মোটা জাতের) মসুর বিক্রি হচ্ছে ২৩১৩ টাকা (কেজি ৬২ টাকা) দামে। যা এক সপ্তাহ আগেও মাত্র ২৪২৫ টাকার (কেজি ৬৫ টাকা) নিচে বিক্রি হয়েছে।  

সম্পূর্ণ দেশীয় উৎপাদনে দেশের খেসারি ডালের চাহিদা মেটানো হয়। কিন্তু আমদানি না হলেও আমদানি পণ্যের সাথে পাল্লা দিয়ে কমেছে খেসারি ডালের দামও। মাত্র এক সপ্তাহ আগেও বাজারে প্রতিমণ খেসারি ডাল বিক্রি হয়েছে ২৭২৫ টাকার (কেজি ৭৩ টাকা) নিচে। এক সপ্তাহে মণে প্রায় ২৬০ টাকা কমে বর্তমানে খেসারি ডাল বিক্রি হচ্ছে ২৪৬০ টাকা (কেজি ৬৬ টাকা) দামে।   

এদিকে দীর্ঘদিন অস্থির থাকার পর এক সপ্তাহ ধরে নিম্নমুখী হয়েছে নিত্য প্রয়োজনীয় আরেক ভোগ্যপণ্য চিনির বাজারও। দফায় দফায় বেড়ে গত সপ্তাহ পর্যন্ত প্রতিমণ চিনির দাম ঠেকে ২৩৮০ টাকায় (কেজি ৬৪ টাকা)। এক সপ্তাহে মণে ৮০ টাকা পর্যন্ত কমে বর্তমানে প্রতিমণ চিনি ২৩০০ টাকায় (সাড়ে ৬১ টাকা) বিক্রি হচ্ছে। 

দীর্ঘদিন উর্ধ্বমুখী থাকার পর এবার নিম্নমুখী হতে শুরু করেছে ভোজ্যতেলের বাজারও। বর্তমানে পাইকারিতে প্রতিমণ (৪০ দশমিক ৯০ লিটার) পাম তেল বিক্রি হচ্ছে ৩৮৫০ টাকা দরে। গত সপ্তাহ পর্যন্ত বাজারে পাম তেলের দাম ছিল ৩৯৫০ টাকা। 

গত সপ্তাহ পর্যন্ত বাজারে প্রতিমণ সুপার পাম তেল বিক্রি হয়েছে ৪২০০ টাকায়। যা বর্তমানে ৪১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। 

তাছাড়া গত সপ্তাহে প্রতিমণ সয়াবিন বিক্রি হয়েছে ৪৬ টাকার ওপরে। বর্তমানে একই সয়াবিন ৪৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বাজার দর অনুযায়ী, গত এক মাসে প্রতিমণ ভোজ্যতেলের দাম ১০০ টাকা পর্যন্ত কমেছে।

এই সময়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে চিড়ার দামও। বর্তমানে বাজারে মানভেদে প্রতিবস্তা (৫০ কেজি) চিড়া বিক্রি হচ্ছে ২৩৫০-২৬৫০ টাকা দরে। যা গত এক সপ্তাহ আগ পর্যন্ত ২৫০০-৩০০০ টাকা দামে বিক্রি হয়েছে। সেই হিসেবে এক সপ্তাহে প্রতিবস্তা চিড়ার দাম ৩৫০ টাকা পর্যন্ত কমেছে। 

খাতুনগঞ্জের পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, শবে বরাতের পর ও রমজানের আগ মুহুর্তে খাতুনগঞ্জের বাজার থাকে সরগরম। এই সময় দেশের জেলা-উপজেলার পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা বাজারে এসে রমজানের প্রয়োজনীয় পণ্য সওদা করে। কিন্তু এবারের চিত্র ভিন্ন। গত এক সপ্তাহে থেকে বাজারে জেলা-উপজেলার ব্যবসায়ী আসছে খুবই কম। যার প্রভাবে রমজানের প্রয়োজনীয় প্রায় প্রতিটি পণ্যের দাম কমে গেছে। 

দাম কমে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে মেসার্স আর এম স্টোরের স্বত্বাধিকারী শেখ সেলিম উদ্দিন জানান, রমজানের দুই মাস আগে থেকেই পাইকারি পর্যায়ে পণ্য বিকিকিনি শুরু হয়েছে। ওই সময় মূলত আমদানিকারক ও বড় পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে পণ্য কিনে রেখেছে দ্বিতীয় সারির পাইকারি ব্যবসায়ীরা। এখন  দ্বিতীয় সারির পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে জেলা-উপজেলা থেকে আগত ব্যবসায়ীদের পণ্য কেনার সময়। 

"কিন্তু এই অবস্থায় গত সপ্তাহ-দশদিন ধরে যেভাবে করোনা প্রকোপ বাড়ছে এতে জেলা-উপজেলার ব্যবসায়ীরা বাজারে আসছে খুবই কম। কিছু ব্যবসায়ী বাজারে আসলে তারা পণ্য কিনছে খুবই সীমিত আকারে। এরফলে আমদানিকারক ও বড় পাইকারি ব্যবসায়ী থেকে বেশি দামে পণ্য কিনলেও এখন ক্রেতা কমে যাওয়ায় কেনা দামের চেয়ে কম দামে পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা," বলেন তিনি। 

এতে বাজারের হাজার হাজার পাইকারি ব্যবসায়ীর লোকসানের শঙ্কা রয়েছে বলে মন্তব্য করেন এই ব্যবসায়ী। 

সাতকানিয়া উপজেলার চরতি এলাকার মুদি দোকানদার শফিক আহমেদ। প্রতি সপ্তাহে দুই বার খাতুনগঞ্জ থেকে পণ্য কিনে গ্রামে সওদা করেন এই ব্যবসায়ী। গতকাল শনিবার তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যার্ন্ডাডকে বলেন, "গত বছর করোনা এবং রমজানকে ঘিরে খাতুনগঞ্জ থেকে প্রচুর পণ্য কিনে গ্রামে সওদা করেছি। কিন্তু এবারের অবস্থা গতবারের মতো নয়। গত বছর বেসরকারি ভাবে বহু প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি করোনা ও রমজানকে ঘিরে ত্রাণ বিতরণ করেছে,"

"এবার করোনার প্রভাব বৃদ্ধি পেলেও আগের মতো ত্রাণ বিতরণের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। তাই হিসেব করে পণ্য কিনতে হচ্ছে। তাছাড়া গত এক বছর ধরে করোণার প্রভাবে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে গেছে। তাই আগের চেয়ে অনেক কম পণ্য কেনা হচ্ছে এবার," যোগ করেন তিনি।  

পরিস্থিতির কারণে এবার বাজারে ক্রেতা ও পণ্যের বিকিকিনি কম বলে জানান তিনি। 

এদিকে খাতুনগঞ্জ থেকে পাইকারিতে ভোগ্যপণ্য ক্রেতা ও খাদ্য পক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান 'স্টার লাইন গ্রুপের পরিচালক মো. মাঈন উদ্দিন বলেন, "আমদানিকারকরা ইতোমধ্যে পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে পণ্য বিক্রি করে তাদের মুনাফা তুলে নিয়েছে। এই অবস্থায় করোনার প্রভাবে পণ্যের দাম কমলে মূলত ক্ষতিগ্রস্থ হবে বাজারের দ্বিতীয় সারির পাইকার ও আমাদের মতো জেলার পাইকারী ব্যবসায়ীরা," 

খাতুনগঞ্জসহ দেশের বড় আমদানিকারকরা ইতোমধ্যে তাদের আমদানিকৃত পণ্যের বেশিরভাগই পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করার কারণেই এমনটা হতে পারে বলে জানান  তিনি। 
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.