করোনাকালে রাজশাহী সিটি হাসপাতাল বন্ধ পড়ে রয়েছে এক বছর

বাংলাদেশ

03 August, 2021, 02:05 pm
Last modified: 03 August, 2021, 04:10 pm
'গরিবের হাসপাতাল' নামে পরিচিত এই হাসপাতালের বহির্বিভাগে আগে মাত্র ১০ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে ওষুধসহ সেবা পেতেন রাজশাহী নগরবাসী।

করোনা সংক্রমণের হটস্পট এখন রাজশাহী। দেশের মধ্যে সংক্রমণ ও মৃত্যুহারের মধ্যে শীর্ষে থাকা কয়েকটি জেলার মধ্যে একটিও রাজশাহী। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল করোনা রোগীদের চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছে। অথচ করোনা পরিস্থিতির এই ভয়াবহ সময়ে রাজশাহীতে একটি বড় হাসপাতাল বন্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে। এই সময়ে হাসপাতালটি চালু থাকলে অনেক রোগীকেই চিকিৎসাসেবা দেওয়া সম্ভব হতো।

রাজশাহী নগরীর রাণীনগরে অবস্থিত রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন পরিচালিত সিটি হাসপাতালটি গতবছরের মার্চ থেকে বন্ধ হয়ে পড়ে আছে। 'গরিবের হাসপাতাল' নামে পরিচিত এই হাসপাতালটিতে গত একবছর ধরে কাউকে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয় না। এখন এই হাসপাতাল থেকে নগরবাসী আর কোনো সেবা পান না। ঢাকার একটি মেডিকেল যন্ত্রপাতি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে ভাড়া দেওয়ার পর একবছর এবং বন্ধ থাকার দরুন একবছর এই দুইবছর গরিব মানুষেরা হাসপাতাল থেকে আর চিকিৎসাসেবা পান নি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকার মেডিকেল যন্ত্রপাতি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান 'সেলট্রন' মাসিক এক লাখ টাকা ভাড়া চুক্তিতে সিটি কর্পোরেশনের কাছ থেকে হাসপাতালটি ইজারা নেয় ২০১৯ সালের জুলাই মাস থেকে। ভাড়া নিয়েই তারা হাসপাতালের বহির্বিভাগের টিকিটের মূল্য বাড়িয়ে দেয়। তারা বহির্বিভাগের টিকিট মূল্য করে ১০০ টাকা। অথচ তাদের ভাড়া দেওয়ার পূর্বে এই হাসপাতালের বহির্বিভাগে মাত্র ১০ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে ওষুধসহ সেবা পেতেন রাজশাহী নগরবাসী। আর ৭৫ টাকা দিয়ে নাম নিবন্ধন করিয়ে ১০ মাসব্যাপী সেবা পেতেন প্রসূতি মায়েরা। গত বছরের মার্চে তারা চলে যায়। চিকিৎসা খরচ বাড়িয়ে ও লোকসানের কথা বলে তারা হাসপাতালটিতে চিকিৎসাসেবা বন্ধ করে দেয়। তারপর থেকেই হাসপাতালটিতে সব ধরনের চিকিৎসাসেবা বন্ধ রয়েছে।

হাসপাতালটি বন্ধের ফলে চারজন মেডিকেল অফিসার, ছয়জন নার্স, ল্যাব টেকনিশিয়ান, আলট্রাসনোলজিস্ট ও ডেন্টিস্টসহ মোট ৬৫ জন চাকরি হারিয়েছেন।

সিটি কর্পোরেশন সূত্রে জানা গেছে, বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে অনেক টাকার প্রয়োজন হয়। তাই স্বল্পমূল্যে নগরবাসীকে চিকিৎসা দিতে রাজশাহী নগরের রাণীনগর এলাকায় ১৯৯৫ সালে ২৫ শয্যার এই হাসপাতালটি নির্মাণ করা হয়। প্রথমে এর নামকরণ করা হয় শ্রমজীবী হাসপাতাল। এর সংস্কারকাজ শেষ হয় ১৯৯৭ সালে। ১৯৯৯ সালে নাম পরিবর্তন করে সিটি হাসপাতাল রাখা হয়। ২০০০ সালের ১৬ মে হাসপাতালের বহির্বিভাগের কার্যক্রম উদ্বোধন করা হয়। পরের বছর থেকে প্রসবসেবা ও অন্তঃবিভাগ কার্যক্রম চালু করা হয়। সে সময় ১০ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে একজন রোগী এক সপ্তাহের ওষুধসহ চিকিৎসা নিতে পারতেন।

রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. এফ এ এম আঞ্জুমান আরা বেগম জানান, দোতলার দুইটি কক্ষে ১২টি করে হাসপাতালে মোট ২৫টি শয্যা ছিলো। গড়ে ৮ থেকে ১০ জন রোগী সবসময় হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিতেন। বহির্বিভাগে প্রতিদিন চিকিৎসা নিতেন ৬০ থেকে ৭০ জন।

সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. এ বি এম শরীফ উদ্দীন জানান, করোনা পরিস্থিতির শুরুর দিকে সেলট্রন কর্তৃপক্ষকে কয়েক মাস চিকিৎসাসেবা বন্ধ রাখতে বলা হয়। কারণ তখন পরিকল্পনায় ছিলো সিটি হাসপাতালকে কোভিড বিশেষায়িত হাসপাতাল করার। কিন্তু পরে আইডি হাসপাতাল ও মিশন হাসপাতালকে করোনা বিশেষায়িত হাসপাতাল করায় আর সিটি হাসপাতালকে প্রয়োজন হয়নি। তখন সেলট্রন কর্তৃপক্ষকে হাসপাতাল পুনরায় চালু করতে বলা হলে তারা লোকসানের কথা বলে চলে যায়। তখন থেকেই হাসপাতাল বন্ধ রয়েছে।

এ বি এম শরীফ উদ্দীন জানান, নতুনভাবে মেয়র মহোদয় আবার হাসপাতালটিকে চালু করার জন্য কাউন্সিলরদের সাথে ইতিমধ্যে কথাও বলেছেন। নতুনভাবে সিটি কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপনায় কিংবা ভাড়া দিয়ে হাসপাতালটি চালু করা হবে। এইজন্য মেয়র মহোদয় হাসপাতালে নতুনভাবে আরো দুইটি ভবন নির্মাণ করবেন। এছাড়া হাসপাতালে যাওয়ার জন্য ভালো কোনো সড়ক নেই। এইজন্য জিরোপয়েন্ট-তালাইমারী প্রধান সড়কের সাথে একটি সংযোগ সড়কও নির্মাণ করার পরিকল্পনা রয়েছে। করোনার কারণেই কাজ শুরু করা যাচ্ছে না। হাসপাতালকে কেন্দ্র করে মেয়র মহোদয় বড় প্রকল্প নিবেন।

গত কয়েকদিন আগে হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতালের প্রধান গেটটি খোলা রয়েছে। গেটে কেউ নেই। গেট পার হয়ে কিছুদূর এগোলে প্রধান ভবনের নিচে ভবনে ঢোকার করিডোরে পাড়ার কয়েকজন কিশোর ক্যারম বোর্ড খেলছিলো। পাশেই মাঠটিতে ঘাস বড় বড় হয়ে গেছে। মাঠের এক কোনায় কয়েকজন যুবক বসে তাস খেলছিলেন। প্রধান গেটের ডানদিকে গাছপালার বেড়ায় কাপড় শুকাতে দেখা গেছে। তবে হাসপাতালটি বেশ পরিচ্ছন্ন রয়েছে বলা যায়। সব কক্ষই তালাবন্ধ। শুধু নিচতলার ভেতরের একটি কক্ষ থেকে নারীকণ্ঠের আওয়াজ পেয়ে গিয়ে দেখা যায়, কয়েকজন নারী বসে আছেন। তারা সিটি কর্পোরেশন পরিচালিত ইপিআইয়ের কর্মী। তারা জানান, একটি কক্ষে তারা শিশু ও ১৫ বছর বয়স থেকে শুরু করে সন্তানসম্ভবনা নারীদের টিকা প্রদান করে থাকেন। ইপিআই সেন্টারের ইনচার্জ রওশন আরা জানান, ছুটির দিন ব্যতীত প্রতিদিন শিশু ও নারীদের টিকা দেওয়া হয়।

সেলট্রনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ মোহাম্মদ ফাউজুল মুবিন বলেন, করোনার প্রকোপ শুরু হলে তিন মাস তাদের হাসপাতালটিকে বন্ধ রাখতে বলা হয়। এই তিন মাসে আমাদের ৩৬ লাখ টাকা লোকসান হয়। এছাড়া হাসপাতালের সামনের সড়কটি ভালো না হওয়ায় রাজশাহীর সিনিয়র চিকিৎসকদেরও হাসপাতালে পাওয়া যাচ্ছিলো না। তারা হাসপাতালে আসছিলেন না। হাসপাতালের প্রধান রোগী হচ্ছে গর্ভবতী নারীরা। হাসপাতালে আসার রাস্তাটি খারাপ হওয়ায় সেসব রোগীও কমতে থাকে। অথচ সিটি কর্পোরেশন থেকে সড়কটি কার্পেটিং করার কথা থাকলেও করে দেননি । এসব কারণে আর হাসপাতালটি আর চালু করা সম্ভব হয়নি।

তবে ইজারা নেওয়ার প্রথম বছর তারা হাসপাতালটি ভালো চালিয়েছেন বলে জানান ফাউজুল মুবিন। 

তিনি জানান, সিটি কর্পোরেশন থেকে হাসপাতালটি তিন বছরের জন্য ইজারা নেওয়া হয়েছিলো। ইজারা নেওয়ার পর তারা পুরো হাসপাতাল সংস্কার করেছেন। আধুনিক যন্ত্রপাতি ক্রয় করে বসিয়েছেন। এজন্য তাদের তিন কোটি টাকা খরচ হয়েছে। হাসপাতালে ২০টি আধুনিক শয্যা, এসিসহ কেবিন, একটি পূর্ণাঙ্গ অপারেশন থিয়েটার ব্যবস্থাপনাসহ সব তৈরি করা হয়েছিলো। কিন্তু সংযোগ সড়কটির কারণে সেখানে চিকিৎসক ও রোগী পাওয়া যায়নি। অথচ প্রথম বছর তারা ভালোভাবে প্রতিষ্ঠানটি চালিয়েছেন। শুরুতে বহির্বিভাগে ১০০ টাকা ফি নেওয়া হলেও তিন মাস পর বহির্বিভাগের ফি বন্ধ করে বিনামূল্যে বহির্বিভাগে রোগী দেখা হচ্ছিলো। শুধুমাত্র ইনডোর বিভাগের মানোন্নয়ন করে সেখান থেকে সেবা দিয়ে আয় করার পরিকল্পনা করা হয়েছিলো। কিন্তু রোগী কমে যাওয়ায় পরে আর বিনিয়োগের অর্থ তোলা সম্ভব হয়নি। হাসপাতালে সব যন্ত্রপাতি পড়ে রয়েছে। তারা আবেদন করেছেন যন্ত্রপাতিগুলো ফেরত নেওয়ার। সিটি কর্পোরেশন থেকে এখনো কিছু জানানো হয়নি।   

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.