ইয়াবার প্রথম মামলা: দেড় যুগেও শেষ হয়নি বিচার

বাংলাদেশ

30 December, 2020, 06:10 pm
Last modified: 30 December, 2020, 06:17 pm
মামলার দেড়যুগ পরেও এজাহারভুক্ত দুই আসামীকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। গ্রেপ্তারকৃত প্রধান আসামীসহ তিনজন এখন জামিনে রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, অভিযুক্তরা এক প্রভাবশালী সাবেক মন্ত্রীর আত্নীয় হওয়ায় ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয়েছে মামলার বিচার কাজ।
  • ১৭ বছরেও পলাতক দুই আসামীকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ
  • সমন জারি করেও হাজির করা যায়নি ১৩ সাক্ষীকে
  • প্রধান আসামীসহ তিনজন জামিনে
  • ২০১৬ সালে পরিবেশ আদালতে  আপিল বিভাগে হস্তান্তর
  • পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণ ১১ জানুয়ারি

     

সাক্ষী হাজির করতে না পারা ও বিচারক সংকটে ১৭ বছর ধরে ঝুলে আছে দেশের প্রথম ইয়াবা মামলার বিচার। মামলার ১৫ সাক্ষীর মধ্যে মাত্র দুই জন আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছে। বাকীদের জামিন অযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেও আদালতে হাজির করা যায়নি। আদালত ও মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

এদিকে, মামলার দেড়যুগ পরেও এজাহারভুক্ত দুই আসামীকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। গ্রেপ্তারকৃত প্রধান আসামীসহ তিনজন এখন জামিনে রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, অভিযুক্তরা এক প্রভাবশালী সাবেক মন্ত্রীর আত্নীয় হওয়ায় ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয়েছে মামলার বিচার কাজ।

ইয়াবার প্রথম মামলার বিচার শেষ না হওয়া মাদকের বিরুদ্ধে সরকারের নেয়া জিরো ট্রলারেন্স নীতি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে।

২০০২ সালের ডিসেম্বর মাসে গুলশানের নিকতনে প্রথম ইয়াবা উদ্ধার করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। গ্রেপ্তার হয় মাদক ব্যবসায়ী সফিকুল ইসলাম ওরফে জুয়েল। তার দেয়া তথ্যমতে, রামপুরার বনশ্রী এলাকায় অভিযান চালিয়ে তার দুই সহযোগী শামছুল ইসলাম ও রফিকুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করা হয়।

ইয়াবা উদ্ধারের ঘটনায় ১৯ ডিসেম্বর গুলশান থানায় মামলা দায়ের করেন মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তৎকালীন পরিদর্শক এনামুল হক। মামলা নম্বর ২৯। মামলা তদন্ত শেষে ২০০৩ সালের ১৪ জানুয়ারি ৬ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দেন মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর।

অভিযোগপত্রে সফিকুল ও তার তিন সহযোগী সোমনাথ সাহা, মোশফিক ও এমরান হকের বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসার সঙ্গে সরাসরি জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। এছাড়াও সফিকুলের বাবা শামছুল ও ভাই শরিফুল মাদক ব্যবসায় সহযোগীতা করে অপরাধ করেছে বলেও চার্জশিটে বলা হয়।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বর্তমানে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের গোয়েন্দা শাখার পরিদর্শক হেলাল উদ্দিন ভূইয়া দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ডব্লিউ ওয়াই লেখা ট্যাবলেটগুলো ধরা পড়ার পর আমরা জানতাম না এগুলো ইয়াবা। পরে রাসায়নিক পরীক্ষার মাধ্যমে আমরা ইয়াবার বিষয়টি নিশ্চিত হই।

চ্যাঞ্চল্যকর এ মামলার তদন্ত নেমে দেশে ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ৬ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দেই। যেহেতু এটি ইয়াবার প্রথম মামলা। তাই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে আসামীদের সর্ব্বোচ্চ শাস্তি প্রত্যাশা করি। যোগ করেন তিনি।

আদালত সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে বিচারাধীন থাকা এই মামলাটি ২০১৬ সালে পরিবেশ আদালতের আপিল বিভাগে হস্তান্তর করা হয়। তবে ২৯ জুন ২০০১৭ সাল থেকে এই আদালতে বিচারক না থাকায় মামলাটি বিচারহীন অবস্থায় পড়ে আছে।

পরিবেশ আদালতের আপিল বিভাগের পাবলিক প্রসিকিউটর এ এফ এম রেজাউল করিম হিরণ বলেন, সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ না হওয়ায় মামলার বিচার কাজ বিলম্বিত হচ্ছে। এছাড়া পরিবেশ আদালতের আপিল বিভাগে বিচারক না থাকাও বিচার বিলম্বিত হওয়ার অন্যতম কারণ বলেও তিনি উল্লেখ করে।

পরিবেশ আদালতের আপিল বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, পরিবেশ সংক্রান্ত মামলার বাইরে যে মামলাগুলো দীর্ঘদিন বিচার আটককে আছে। সাক্ষী হাজির করতে পারছে না সেসব পুরানো মামলা এখানে হস্তান্তর করা হচ্ছে।

পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণ ১১ জানুয়ারি

বারবার সমন জারি করেও আদালতে সাক্ষী হাজির করা যাচ্ছে না। ১৫ জন সাক্ষীর মধ্যে মাত্র দুই জন আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছে। তারা হলেন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপ ফজলুর রহমান ও পরিদর্শক মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হেলাল উদ্দিন। বাকী ১৩ জনের বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে আদালত। আদালত পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য ১১ জানুয়ারি দিন ধার্য করেছেন।

আসামীরা কে কোথায়

আদালত সূত্রে জানা গেছে, ইয়াবার প্রথম মামলায় এজহারভুক্ত ২ আসামী এখনো পলাতক রয়েছে। পলাতক আসামীরা হলো, সোমনাথ সাহা ও এমরান হক। গ্রেপ্তারকৃত তিন আসামী বর্তমানে জামিনে রয়েছে।

যাদের বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে আদালত

ইয়াবার প্রথম মামলায় ১৫ জন সাক্ষীর মধ্যে মাত্র চারজন সাধারণ জনগণ। বাকী ১১ জনই মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা। যাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন চাকরির মেদ শেষে অবসরেও গেছেন।

আদালত থেকে বারবার সমন জারির পরও সাক্ষী দিতে না আসায় ১৩ জনের বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন। তারা হলেন, পরিদর্শক এনামুল হক, উপ-পরিচালক ড. আমিনুল ইসলাম, হাফিজুর রহমান, সহকারি পরিচালক আমজাত হোসেন, এ এএম হাফিজুর রহমান, জাহিদ হোসেন মোল্লা, প্রধান রাসায়নিক কর্মকর্তা দুলাল কৃষ্ণ সাহা, এসআই আহসান হাবিব ও সানোয়ার হোসেন।

এছাড়াও সাধারণ মানুষ আরও চারজনকে সাক্ষী করা হয়েছে। তারা হলেন, আবু কাজী, নুরুজ্জামান, ফাহিম হাসান ও হেমায়েত।

সুপ্রিম কোর্টের পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, সারাদেশে প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার মাদকের মামলা বিচারাধীন রয়েছে। যার মধ্যে ৩৫ হাজার মামলা পাঁচ বছরের অধিক সময় ধরে বিচারধীন রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবি ব্যারিস্টার জ্যোতিময় বড়ুয়া দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, শুধু মুখে মুখে মাদকের বিরুদ্ধে জিরো ট্রলারেন্স নীতির কথা বললে কাজ হবে না। ১৭ বছরেও যদি ইয়াবার প্রথম মামলার বিচার নিস্পত্তি না হয় তাহলে মাদক কীভাবে নির্মূল হবে।

বিচার না হওয়া বিষয়টি শুধু আদালতের দায় না। এরজন্য মামলার তদন্তকারী সংস্থা ও সাক্ষীদের আদালতে হাজির করার দায়িত্বে থাকা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীরও অবহেলা রয়েছে বলেও জানান তিনি।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.