ইউরোপে মানবপাচারের নতুন রুট উজবেকিস্তান

বাংলাদেশ

30 July, 2021, 11:40 am
Last modified: 30 July, 2021, 12:21 pm
উজবেকিস্তান ছাড়াও ঢাকা থেকে তুরস্ক বা লিবিয়া, ঢাকা থেকে ভারত ও শ্রীলঙ্কা হয়ে লিবিয়া কিংবা ঢাকা থেকে আরব আমিরাত হয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাচার হচ্ছে দেশের তরুণ-তরুণীরা।
  • ঢাকা থেকে কলকাতা, কলকাতা থেকে দিল্লি হয়ে উজবেকিস্তান- গন্তব্য ইউরোপীয় দেশ পোল্যান্ড  
  • এক মামলার তদন্তে ইউরোপে মানবপাচারের নতুন রুটের সন্ধান পায় সিআইডি 
  • সারাদেশে ২ বছরে মানবপাচারের ঘটনায় ৯২৯ মামলা। সবচেয়ে বেশি ২৬৪টি মামলা ডিএমপিতে। 
  • জেলাভিত্তিক সবচেয়ে বেশি মানবপাচারের ঘটনায় ৪২টি মামলা হয়েছে মাদারীপুরে
  • করোনার আঘাতে বেকার হয়ে দেশে ফেরা ৭০% প্রবাসী শ্রমিক বেকার জীবন কাটাচ্ছেন

দুই বছর আগে স্বপ্নের দেশ পোল্যান্ডে পাড়ি দিতে দেশের একটি প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরি ছেড়ে দেন মাগুরার ছেলে ফারুক হোসেন।  

নিজের চাকরিজীবনে কষ্টে জমানো টাকা, আর বাবার জমি বিক্রি করে দফায় দফায় ১২ লাখ টাকাও মানবপাচারকারী চক্রের হাতে তুলে দেন ফারুক।

বৈধপথে ওয়ার্ক-পারমিট নিয়ে পোল্যান্ডে যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর ফারুক মানবপাচারকারী চক্রের সদস্যদের কথামতো যাবতীয় প্রস্তুতি শেষ করে ২০১৯ সালের জুনে প্রথম দফায় চক্রের হোতা আহসানুল বারীকে রাজধানীর মিরপুরের বাসায় গিয়ে ২ লাখ টাকা দেন।

এরপর বিভিন্ন দফায় দেশে থেকেই আরও আড়াই লাখ টাকা দেন চক্রের সদস্যদের। দ্বিতীয় দফায় টাকা দেয়ার তিন মাস পরে ঢাকা থেকে কলকাতা নিয়ে যাওয়া হয় ফারুককে। সেখান থেকে দিল্লিতে গিয়ে উজবেকিস্থানের এম্বাসির মাধ্যমে ভিসা নিয়ে তাকে উজবেকিস্তানে নিয়ে যায়।    

সেখানে চার মাস আটক রেখে অবৈধ পথে সাগর ও সীমান্ত পাড়ি দিয়ে পোল্যান্ডে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে চক্রের সদস্যরা। ফারুক অবৈধভাবে পোল্যান্ডে না গিয়ে পালিয়ে দেশে ফিরে আসেন। দেশে ফিরে আসার আগে দফায় দফায় ফারুকের পরিবারের কাছ থেকে অন্তত ১২ লাখ টাকা তুলে নেয় চক্রের সদস্যরা। তিনি যখন পালিয়ে দেশে ফেরেন তখনও ১০ থেকে ১২ জন অবৈধভাবে ঝুঁকিপূর্ণ পথ পাড়ি দিয়ে পোল্যান্ডে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে।  

এভাবে শুধু ফারুক হোসেন নয়, ইউরোপে ভালো চাকরি আর উন্নতজীবনের স্বপ্নে বিভোর হয়ে বিভিন্ন দেশে পাচার হচ্ছে দেশের তরুণ-তরুণীরা।  

এ ঘটনায় ভুক্তভোগী ফারুক মিরপুর মডেল থানায় মানবপাচার প্রতিরোধ আইনে মামলা করেন। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) তদন্তে নেমে চক্রের হোতা আহসানুল বারীকে গ্রেপ্তার করেন। তাকে গ্রেপ্তারের পর ইউরোপে মানবপাচারের নতুন রুট সম্পর্ক চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে।  

তবে দেশে ফিরে কোন চাকরি না পেয়ে পরিবার নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে ফারুক। তার করা মামলায় পাচারকারী চক্রের মূল হোতা আহসানুল বারী গ্রেপ্তার হলেও কোন টাকা ফেরত পাননি ক্ষতিগ্রস্ত ফারুক। 

তদন্ত সূত্রে জানা গেছে, এই চক্রের সদস্যরা শুধু দেশে নয়, ভারত, উজবেকিস্তান ও পোল্যান্ডেও সক্রিয় রয়েছে। চক্রের সদস্য শাহাবুদ্দিন বর্তমানে পোল্যান্ডে অবস্থান করছে বলেও জানতে পেরেছে সিআইডি। 

সিআইডির তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অবৈধভাবে মানবপাচার করতে নতুন নতুন রুট ব্যবহার করছে মানবপাচারকারী চক্রের সদস্যরা। ইউরোপে মানবপাচারের জন্য নতুন রুট উজবেকিস্তান ছাড়াও ঢাকা থেকে তুরস্ক বা লিবিয়া, ঢাকা থেকে ভারত ও শ্রীলঙ্কা হয়ে লিবিয়া কিংবা ঢাকা থেকে আরব আমিরাত হয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাচার হচ্ছে দেশের তরুণ-তরুণীরা।

সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার সাইদুর রহমান খান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "মানবপাচার বন্ধে ভুক্তভোগীদের আইনি সহায়তা দেয়ার পাশাপাশি পুলিশ নানা সচেতনামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। মানবপাচারকারী চক্রের সদস্যরা যেসব নতুন নতুন রুট ব্যবহার করছে, সেগুলো চিহিৃত করে সংশ্লিষ্ট দেশের সহায়তা নিয়ে সেগুলো বন্ধ করা হচ্ছে"। 

"মানবপাচার প্রতিরোধে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আমরা কাজ করছি। যেসব দেশকে রুট হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে ও যেসব দেশে মানবপাচার হচ্ছে সবার সঙ্গেই মানবপাচার রোধে যৌথভাবে কাজ করছি আমরা", যোগ করেন তিনি।

পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্যানুযায়ী, গত দুই বছরে সারাদেশে মানবপাচারের ঘটনায় মোট মামলা হয়েছে ৯২৯টি। সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে ডিএমপিতে। আর জেলা ভিত্তিক মানবপাচারের ঘটনায় সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে মাদারীপুরে।

এদিকে, বুধবার (২৮ জুলাই) বিশ্ব মানবপাচার প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে আয়োজিত বহুপক্ষীয় এক ওয়েবিনারে বিশেষজ্ঞরা বলেন, নতুন নতুন রুট ব্যবহার করে ইউরোপে যাত্রা ব্যাধির মত বাড়ছে। যেকোন মূল্যে এখনই মানবপাচারের লাগাম টেনে ধরতে হবে। দেশের তরুণ-তরুণীদের মানবপাচারের ভয়াবহ কুফল সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। এই ওয়েবিনারে পরিসংখ্যান দিয়ে বলা হয়, করোনাকালে বেকার হয়ে ফেরা ৭০ শতাংশ প্রবাসী শ্রমিক বেকার জীবনযাপন করছে।

ওয়েবিনারে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেন,  "মানবপাচার মারাত্মক মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং অভিবাসীদের পাচার ও চোরাচালানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সব অংশীজনের সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রয়োজন"।

তিনি আরও জানান, এই ভয়াবহ অপরাধের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকার জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করেছে এবং সক্রিয়ভাবে পদক্ষেপ নিচ্ছে। 

 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.