আমের কেজি দেড় টাকা

বাংলাদেশ

বুলবুল হাবিব, রাজশাহী
23 May, 2020, 12:30 pm
Last modified: 23 May, 2020, 12:58 pm
আম্পানির তাণ্ডবে রাজশাহীর আম বাগানের ১৫ শতাংশ আম ঝরে গেছে। ঝরে পড়া আমের বেশিরভাগ গাছের নিচে পড়ে নষ্ট হচ্ছে। তবে কিছু আম বাজারে বিক্রি হচ্ছে খুচরা ৪ থেকে ৫ টাকা কেজি দরে। পাইকারিভাবে যা বিক্রি হয়েছে কেজিতে দেড় থেকে দুই টাকা দরে।

সুপার সাইক্লোন আম্পানের তাণ্ডবে রাজশাহীতে প্রায় ১১০ কোটি টাকার আমের ক্ষতি হয়েছে। ঝরে পড়া আমগুলোর বেশিরভাগ পচে নষ্ট হচ্ছে আমবাগানে, গাছের নিচে। তবে কিছু আম সস্তা দরে বিক্রি হচ্ছে হাটে-বাজারে। তাতে ঠিকই লোকসান গুনতে হচ্ছে আমচাষী ও বাগান মালিকদের।

অথচ এই ঝরে পড়া কাচা আমই প্রক্রিয়াজাত করে লোভনীয় উপাদেয় খাদ্য তৈরি করে বিক্রি করা সম্ভব বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এতে লোকসানের শঙ্কা কাটিয়ে আমচাষীদের ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়াও সম্ভব হতো।

বুধবার রাতে বয়ে যায় সুপার সাইক্লোন 'আম্পান'। এর ফলে সরকারি হিসাবে রাজশাহীর আমবাগানের ১৫ শতাংশ আম ঝরে গেছে। ঝরে পড়া আমের বেশিরভাগ গাছের নিচে পড়ে নষ্ট হচ্ছে। তবে কিছু আম বাজারে বিক্রি হচ্ছে খুচরা ৪ থেকে ৫ টাকা কেজি দরে। পাইকারিভাবে যা বিক্রি হয়েছে কেজিতে দেড় টাকা থেকে দুই টাকা দরে। অবশ্য এই ঝরে পড়া আম বিক্রি হওয়াতে কোনো অর্থই পকেটে ঢুকেনি আমচাষী ও বাগান মালিকদের।

রাজশাহীর কাটাখালীর সমসাদিপুর গ্রামের আম ব্যবসায়ী আব্দুর রাজ্জাকের ৫০টি আম বাগান ইজারা নেওয়া আছে। সেখানে ছোট-বড় বিভিন্ন জাত মিলিয়ে গাছ রয়েছে ১২০০টির মতো। ঝড়ে তার ব্যাপক আম ঝরে গেছে।

শুক্রবার তার গ্রামে কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি বলেন, 'ঘূর্ণিঝড়ে ৫০টি বাগান থেকে ২০০ থেকে ৩০০ মণ আম ঝরে পড়ে গেছে। অথচ একটা আমও আমি পাইনি। অবশ্য আমি  কোনো বাগান থেকে আম কুড়ানোর চেষ্টাও করিনি। বেশিরভাগ আমই গাছের নিচে পড়ে নষ্ট হয়েছে। আর কিছু আম বাগান দেখাশোনার কাজে নিয়োজিত লোক, পাড়াপ্রতিবেশী কুড়িয়ে নিয়ে বিক্রি করেছেন।'

তিনি আরও বলেন, 'এমনিতেই করোনাভাইরাসের কারণে আম পরিবহন ও বাজারজাত করা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছি। এর মধ্যে মড়ার ওপর খাড়ার ঘার মতো এই ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবলীলা। আমার বাগানের ৫০ শতাংশ আমই ঝরে গেছে। তা-ও যদি করোনাভাইরাস না থাকত, এই ঝরে পড়া আমই বিক্রি হতো ১৫ থেকে ২০ টাকা কেজি দরে; বাগানে এসে আম কিনে নিয়ে যেত। এখন বিক্রি করতে চাইলেও নেওয়ার লোক নাই। পাইকারি এক টাকা কেজি দরেও কেউ আম কিনছেন না। আবার ট্রাকভর্তি আম পাঠাতে গেলেও চাঁদা দিতে হয়। এখন ট্রাক ভাড়া ও চাঁদা দিতে যদি বিক্রির টাকা চলে যায়, তাহলে আম ঢাকায় নিয়ে গিয়ে লাভ কি?'

আরেক বাগান মালিক কুদ্দুস আলী বলেন, 'ঝড়ে আম পড়ার সময় বাগান মালিকরা বাগানে যেতে পারেন না। তাদের বুকের মধ্যে কী হয়, তারাই জানেন। কষ্টে তাদের বুক ভেঙে যায়। ঝড়ে আম পড়ার সময় স্ট্রোক করে আমাদের এক বাগান মালিক মারা গেছেন। তাই বাগানেই বেশিরভাগ আম পচে নষ্ট হয়। আর কিছু আম বাগানের আশেপাশের লোকজন, পাহারাদাররা নিয়ে গিয়ে বিক্রি করেন। ঝড়ে পড়া আম বিক্রি থেকে এক টাকাও পকেটে আসে না। ফলে লোকসান যা হওয়ার বাগান মালিক ও আমচাষীদেরই হয়।'

শুক্রবার কাটাখালীর কয়েকটি বাগান ঘুরে দেখা যায়, ঘূর্ণিঝড় হওয়ার দুই দিন পার হয়ে গেলেও গাছের নিচে পড়ে রয়েছে আম।

সমসাদিপুরের জলিল নামের আরেকজন আমচাষী বলেন, গাছের নিচে প্রচুর আম পড়ে ছিল। পাড়াপ্রতিবেশীরা কিছু কুড়িয়ে নিয়ে গেছেন, কিছু আম গবাদি পশু খেয়ে ফেলেছে। তবে গাছেই পড়ে রয়েছে বেশিরভাগ আম।

আমচাষী ইয়াকুব আলী বলেন, 'আমাদের গাছের আম ঝরে পড়ায় আমরা নিঃস্ব, আমরা দিশেহারা। এই আম ঝরে পড়াতে শুধু যে আমার ক্ষতি হয়েছে, তা না, দেশেরও ক্ষতি হয়েছে, জাতির ক্ষতি হয়েছে। এই ক্ষতি সরকারের পুষিয়ে দেওয়া উচিত। সরকারিভাবে প্রণোদনা দিয়ে এই খাতের আর্থিক ক্ষতি কাটিয়ে তোলা সম্ভব।'

শুক্রবার রাজশাহী মহানগরীর সাহেব বাজারে গিয়ে দেখা যায়, বাজারে খুচরা কেজি প্রতি আম বিক্রি হচ্ছে ৪ থেকে ৫ টাকা কেজি দরে। রুবেল নামের এক খুচরা বিক্রেতা বলেন, 'জেলার বাঘা ও চারঘাট থেকে ৪০ মণ আম ক্রয় করেছি। পাইকারি ক্রয় করেছি ২ টাকা কেজি দরে। নিয়ে আসার খরচ ধরলে ৪ টাকা কেজি পড়ে যাচ্ছে। কেজিপ্রতি এক টাকা লাভে আম বিক্রি করছি।'

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো.শামসুল হক বলেন, 'যেসব গাছ বড়, প্রধানত সেইসব গাছ থেকেই ঝড়ে আম পড়েছে। ছোট গাছ থেকে আম ঝরে পড়েনি। জেলায় ১৫ শতাংশ আম ঝরে গেছে। পরিপক্ক অবস্থায় বিক্রি করলে যার বাজারমূল্য ১১০ কোটি টাকা দাঁড়াত। আমরা ঝরে পড়া আম বিক্রির জন্য আচার ও জেলি উৎপাদনকারী কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। তারা ঝরে পড়া আম কিনেন না বলে জানিয়েছেন।'

তিনি আরও বলেন, 'এছাড়া জেলা প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে ত্রাণ হিসেবে দেওয়ার কথাও ভেবেছিলাম; কিন্তু জেলায় যেহেতু প্রায় সবার বাড়িতেই আম গাছ আছে, তাই ত্রাণ হিসেবে এটি দিলে মানুষের মনে বিরূপ প্রভাব পড়ত। তবে সরকারি উদ্যোগে আম ক্রয় করে অন্য জেলায় ত্রাণ হিসিবে দিলে আমচাষী ও বাগান মালিকরা উপকার হতো।'

মো.শামসুল হক আরও বলেন, ' পাইকারিভাবে দেড় টাকা কেজি দরে আম বিক্রি হচ্ছে। ত্রাণ হিসেবে দেওয়ার পাশাপাশি আচার, জেলিসহ উপাদেয় নানা খাদ্য তৈরি করতে এই আম ক্রয় করলে চাষীরা লাভবান হতেন।'

বাগানে পড়ে নষ্ট হচ্ছে আম

রাজশাহী জেলা প্রশাসক হামিদুল হক বলেন, 'ইতিমধ্যে বাঘা ও চারঘাট থেকে ১০ ট্রাক আম ঢাকায় বিক্রির জন্য পাইকাররা নিয়ে গেছেন। আমরা আম ক্রয় করার জন্য সব পাইকারকে উদ্বুদ্ধ করছি। পরিবহনের সব ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া চাষীদের আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়ার জন্য সরকারি উদ্যোগে আম ক্রয়ের চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে। তারপরও ক্ষতি হলে আর্থিক প্রণোদনার মাধ্যমে ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করা হবে। এজন্য সরকারিভাবে চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে।'

রাজশাহী, নাটোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁয় মোট ৪ হাজার ৪১৬ হেক্টর জমির আম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যার পরিমাণ ৫৩ হাজার ৫১৪ মেট্রিক টন। টাকার হিসেবে ক্ষতির পরিমাণ ১৮৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে রাজশাহীতে ২ হাজার ৬৫২ হেক্টর জমির ১৮ হাজার মেট্রিক টন আম ক্ষতি হয়েছে। আম ঝরে গেছে ১৫ শতাংশ। টাকার হিসেবে ক্ষতির পরিমাণ ১১০ কোটি টাকা। এছাড়া রাজশাহীতে ভুট্টা ৭০ হেক্টর, কলা ২৭ হেক্টর, পানের বরজ ১০ হেক্টর, পেঁপে ১০ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতি হয়েছে।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক সুধেন্দ্রনাথ রায় বলেন, 'ঘূর্ণিঝড়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সবচেয়ে বেশি রাজশাহী। এরপর নাটোর। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আম। তবে অন্যান্য ফসল খুব বেশি ক্ষতি হয়নি।'

রাজশাহী জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আমিনুল হক বলেন, 'জেলায় ৫০টির মতো কাঁচাঘর ভেঙে গেছে। এছাড়া অন্য তেমন ক্ষতি হয়নি। তবে ফসলের মধ্যে আমের ক্ষতি বেশি হয়েছে।'
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.