আমরা অসহায় আতঙ্ক নিয়ে একটা ভয়ংকর ভঙ্গুর পরিস্থিতির দিকে তাকিয়ে আছি: ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য

বাংলাদেশ

টিবিএস রিপোর্ট
22 February, 2020, 01:05 pm
Last modified: 23 February, 2020, 04:59 pm
ব্যাংকিং কমিশন গঠন প্রস্তাবের প্রতিক্রিয়ায় আজ এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন তিনি।

ব্র্যাক সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে দেশের ব্যাংকিং খাত নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) ডিস্টিংগুইস ফেলো ও প্রথম নির্বাহী পরিচালক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। প্রস্তাবিত ব্যাংকিং কমিশন গঠনে সরকারি উদ্যোগের প্রেক্ষিতে আজ শনিবার এই সংবাদ সম্মেলন করেছে সিপিডি।

ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, 'আমরা নাগরিকরা অসহায় আতঙ্ক নিয়ে একটা ভয়ংকর ভঙ্গুর পরিস্থিতির দিকে তাকিয়ে আছি।

'এই পরিস্থিতির বিভিন্ন সূচক আপনারা ইতোমধ্যেই জানেন। এটা শুধু মন্দঋণের বিষয় নয়। শত প্রতিশ্রুতির পরেও মন্দঋণ অব্যাহত রয়েছে। এর নিচে লুকিয়ে রয়েছে আরও গল্প। প্রতিটি ব্যাংকের এখন পুঁজির ঘাটতি, সঞ্চিতির ঘাটতি, তাদের প্রকৃত বাণিজ্যিক লাভজনকতার ঘাটতি।

'এখন ব্যাংকে মানুষের টাকা রাখার পরিমাণ ক্রমাণ্বয়ে কমে যাচ্ছে। এর সাথে সুদের সমস্যা আছে, জমার ক্ষেত্রে সুদের সমস্যা আছে। কী হারে, কোন সুদে টাকা বিনিয়োগ করব, তাতে সমস্যা আছে।'

তিনি আরও বলেন, 'কেন্দ্রীয়ভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে যে সমস্ত সুবিবেচিত নীতিমালা দেওয়া হয়েছে, তার প্রকাশ্য বরখেলাপ ঘটছে। এই বরখেলাপগুলি কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেআইনি কার্যকলাপে পরিণত হচ্ছে। যার ফলে দুদকের মতো প্রতিষ্ঠানকেও এখানে যুক্ত হতে হচ্ছে।'

ড. দেবপ্রিয় আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, 'এই যে ব্যাপারগুলো আমরা দেখছি, শুনছি এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের কাগজ থেকে দেখছি- গুটিকয় ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের হাতে ব্যাংকিং সেক্টর জিম্মি হয়ে গেছে। এই পরিস্থতি যখন বিকাশ লাভ করছিল, তখন, আজ থেকে ৮ বছর আগে হলমার্ক কেলেংকারির সময় থেকে আমরা এ কথা বলে আসছি।'

তিনি বলেন, 'এখন এ ব্যাপারে যখন কিছু অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে, তখন আমরা এতে অত্যন্ত খুশি, প্রীত এবং সন্তুষ্ট। আমরা জেনে উৎসাহিত বোধ করেছি, এই ব্যাংকিং কমিশন গঠনের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক পর্যায় থেকে আশীর্বাদ এসেছে, সম্মতি এসেছে।  এবং আমরা মনে করি অত্যন্ত বিচক্ষণ একটি সিদ্ধান্ত হিসেবে আমাদের সামনে এসেছে।

ড. দেবপ্রিয় উল্লেখ করেন, '২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী  ইশতেহারেও ব্যাংকিং খাতের সমস্যাগুলো নিয়ে পরোক্ষ স্বীকৃতি আছে। মন্দঋণ কমানোর ক্ষেত্রে উদ্যোগ নেওয়া, সুদের হারকে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা, সার্বিকভাবে ব্যাংকিং খাতের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির ব্যাপারে সুপারিশ আছে এবং প্রতিশ্রুতি আছে। সেক্ষেত্রে আমরা মনে করেছি এক্ষেত্রে নীতি প্রণেতাদের এক উপলব্ধির অগ্রগতি হয়েছে।'

তিনি জানান, সর্বশেষ বাজেটেও অর্থমন্ত্রী বলেছেন, একটি কমিশন গঠন করার সম্ভাব্যতা যাচাই করে দেখা হবে। 

ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আরও বলেন, 'আমাদের নির্বাহী পরিচালক বলেছেন, আমাদের ব্যাংকিং খাত সংস্কারের একটি ঐতিহ্য আছে, ইতিহাস আছে। ১৯৮৪ সালে যে মানি ব্যাংকিং ও ক্রেডিট কমিশনটি গঠিত হয়েছিল, তাতে আমাদের সিপিডির সভাপতি প্রফেসর রেহমান সোবহান সদস্য ছিলেন। ২০০২ সালে যে ব্যাংক সংস্কার কমিটিটি গঠিত হয়েছিল, আমি সেটার সদস্য ছিলাম। ফলে আমাদের সিপিডির পক্ষ থেকেও এই ব্যাপারে পর্যালোচনা ও সম্যক উপলব্ধি, জ্ঞান ও অংশগ্রহণের একটা ইতিহাস আছে। 

এভাবে ধারাবাহিকভাবে এক্ষেত্রে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা আমরা সঞ্চয় করেছি। তার ভিত্তিতেই আজকে আপনাদের কাছে একথা বলছি। 

প্রথমত, আমরা একটি ব্যাংকিং কমিশন কেন চেয়েছি? কেননা কমিশন ছাড়াও আরো সমধর্মী অন্যান্য উদ্যোগ থাকে। যেমন, থাকে টাস্ক ফোর্স, থাকে কমিটি, এই কমিটি, টাস্কফোর্স আর কমিশনের মধ্যে পার্থক্যটা পরিষ্কার হওয়া দরকার। 

টাস্কফোর্স গঠন হয় যখন আমাদের কোনো সুচিহ্নিত, সুনির্দিষ্ট সমস্যা থাকে। একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শুধু সেই সমস্যাটি সমাধান করার জন্য কতিপয় মানুষকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এটাই মূলত একটি টাস্কফোর্স। সুতরাং টাস্কফোর্সের ধারণাটা অনেক সীমিত। 

এর বাইরে আরেকটা আছে কমিটি। কমিটির সঙ্গে টাস্কফোর্সের তফাতটা হলো এই- একটি কমিটির পরিধির ব্যাপ্তি কিছুটা বেশি। কমিটি গঠন করার জন্য যে একটি সুচিহ্নিত সমস্যা থাকতেই হবে এমন কোনো কথা নেই। কিন্তু তার কার্যপ্রণালি আগের থেকে নির্ধারণ করা থাকে। অর্থাৎ কোন পদ্ধতিতে সে এই কাজটি করবে তা আগের থেকে নির্ধারিত থাকে। 

টাসফোর্স ও কমিটি উভয়ের ক্ষেত্রে সময় নির্দিষ্ট থাকে। 

কিন্তু কমিশনের ক্ষেত্রে এর ক্ষমতা অনেক বেশি থাকে। একটি কমিশন গঠন করা হয় তখনই, যখন দেখা যায় চলমান কাঠামোতে আমরা সমাধান খুঁজে পাচ্ছি না। কাঠামোগত সমস্যা যখন সামনে আসে, তখনই কমিশন করার কথা ওঠে।   

কমিশনের জন্য কর্মপরিধি নির্দিষ্ট থাকে, কার্যপ্রণালি নির্দিষ্ট থাকে না। কমিশনের সদস্যরা নিজেরাই নিজেদের কার্যপ্রণালি নির্দিষ্ট করেন। লক্ষ্য নির্দিষ্ট, কার্য নির্দিষ্ট, সময়বদ্ধ কাজের কথা বলা হয়েছে।

দুই রকমের কমিশন হতে পারে। স্থায়ী কমিশনও হয়, যেমন- দুর্নীতি দমন কমিশন, নির্বাচন কমিশন, তথ্য অধিকার কমিশন, মানবাধিকার কমিশন ইত্যাদি।

আমরা যে কমিশনের কথা বলছি তা অস্থায়ী অন্তর্বর্তীকালীন কমিশন। অর্থাৎ একটি সুনির্দিষ্ট সময়ের ভেতরে, সুচিহ্নিত সমস্যার সমাধানকল্পে সদস্যরা স্বাধীনভাবে একটি কর্মপ্রণালি নির্ধারণ করবেন এবং একটি সুপারিশমালা গঠন  করবেন।  

এভাবেই মূলত একটি কমিশন কাজ করে। এটা নিয়ে অনেক বিভ্রান্তি আছে। অনেকে বলেছেন, অনেক ত কমিশন আছে, কমিশন থাকলেই কি সমধান হয় নাকি। আবার অনেকে বলেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক যদি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে, তাহলে স্বাধীন কমিশন কেন লাগবে?

বাংলাদেশ ব্যাংক তো কার্যত স্বাধীনভাবে কাজ করছে না, এটাই তো সমস্যা। 

তাহলে আগামী দিনে আমরা কোন বিষয়গুলো দেখব? প্রথম যে বড় বিষয়টা দেখা দরকার- আসলেই এই পরিস্থিতিটার মাত্রাটা কি? এটা নিয়ে বড় ধরণের বিভ্রান্তি এখন বিরাজ করছে। যেসমস্ত তথ্য-উপাত্ত আছে, আমাদের কাছে যে উপাত্তগুলো আসে এবং যেগুলো আসে না- সবকিছু মিলে যে বাস্তব অবয়ব নির্মাণ করবো আমরা, সেটা সম্ভব হচ্ছে না। আইএমএফ তো ইতোমধ্যে বলেই বসেছে যে, মন্দঋণের পরিমাণ ২ গুণ। আমি জানি না সরকার বা বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে এর প্রতিবাদ করা হয়েছিল কি না। 

তাই স্বচ্ছ, সম্যক, তথ্যনির্ভর এবং পূর্ণভাবে একটি মাপকাঠি নির্মাণ করা দরকার যে, বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত এখন কি পরিস্থিতিতে আছে। এটা হলো প্রথম কাজ।     

দ্বিতীয় কাজ হলো, প্রকাশিত এবং উদ্ঘাটিত পরিস্থিতি জাতীয় অর্থনীতির উপরে কি ধরণের অভিঘাত রাখছে, বিভিন্ন খাতে কি ধরণের সমস্যা বা সুযোগ সৃষ্টি করছে, সেটার তাৎপর্যটা কি- সেটা বিশ্লেষণ করে এই কমিশনকে বলতে হবে। 

তৃতীয়ত, এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য সরকার থেকে ইতোমধ্যে যেসমস্ত পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, সেগুলোর কার্যকারিতা সম্পর্কে কমিশনের সদস্যদের মতামত দিতে হবে।  কারণ নতুন কোন পদ্ধতি যদি তারা সুপারিশ করতে চান, তার আগে চলমান পদ্ধতিগুলো সম্পর্কে মূল্যায়ন দিতে হবে। 

চলমান পদ্ধতি নিয়ে মূল্যায়ন না করে নতুন পদ্ধতি সুপারিশ করা তাদের জন্য কঠিন হবে। 

এই খাতকে এই পরিস্থতি থেকে পুনরুদ্ধার করার জন্য স্বল্প ও মধ্যমেয়াদে ফলপ্রসূ, বাস্তবোচিত ও টেকসই সুপারিশ দিতে হবে।  

এখন প্রশ্ন হলো, এই কমিশন কি শুধু ব্যাংকিং খাতের বিষয়গুলোই দেখবে? নাকি ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও দেখবে? এখন ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তো ব্যাংকিং খাতের চেয়েও খারাপ অবস্থার ভেতরে আছে। এখন তাহলে এই খাতের সমাধান কি ব্যাংকিং কমিশনে হবে, না কি অর্থনৈতিক কমিশনে হবে- এই প্রশ্নটি থেকে যায়।

এরপর যে বিষয়টি জরুরি, এই কমিশন কি শুধু ব্যাংকিং খাতই দেখবেন না কি ব্যাংকিং খাতের সঙ্গে অন্য যে বিষয়গুলো জড়িত, ব্যাংকিং খাত দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে, সেগুলোকেও দেখবেন? যেমন- পুঁজিবাজার। এখানে ব্যাংকিং খাতের বড় ধরনের ভূমিকা রয়েছে, অর্থায়নের বড় ধরণের প্রবাহ রয়েছে। অর্থাৎ পুঁজিবাজারের সঙ্গে ব্যাংকিং খাতের বড় ধরণের সম্পর্ক রয়েছে। কমিশন কি পুঁজিবাজারের বিষয়গুলো দেখবেন?    

ওনারা কি শুধু সরকারি ব্যাংক দেখবেন, নাকি ব্যক্তিখাতের ব্যাংকও দেখবেন? ওনারা কি বিদেশি ব্যাংকও দেখবেন? অনেক রকমের ব্যাংকই তো আছে- বিশেষায়িত ব্যাংক, ব্যক্তি ব্যাংক, সরকারি ব্যাংক, বেসরকারি ব্যাংক ইত্যাদি। সবগুলোই কি কমিশন দেখবেন? 

আমরা আশা করবো ব্যাংক ধরে ধরে বিস্তারিতভাবে মন্দঋণের পরিমাণ, পুঁজির ঘাটতি, অবলোপন এবং সঞ্চিতির ঘাটতি ইত্যাদি বিষয়গুলো বিবেচনার মধ্যে আনবেন। 

এখন প্রশ্ন হলো, শুধুই কি ৫০ টির অধিক ব্যাংকগুলোর পর্যালোচনা করবেন তারা? না কি ওনারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকাটাও দেখবেন? আইনীভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পূর্ণ ক্ষমতায় থাকার পরেও কেন তারা পূর্ণ ক্ষমতার প্রয়োগ করে না, এটা কি কমিশন দেখবেন?

এবার দুর্নীতি দমন কমিশনে যেসমস্ত ব্যাংকের মামলা চলে গেছে, ওনারা কি সেগুলোকেও বিবেচনার ভেতরে আনবেন? 

আরেকটা ব্যাপার বোঝা দরকার, এবার সরকারের সঞ্চয়পত্রের বিক্রির হার কম, বিদেশি সাহায্য ব্যবহারের পরিমাণও কম অথচ সরকার ব্যাপকভাবে ব্যাংকগুলোর কাছ ঋণ নিচ্ছে,সেটার  ব্যাপারে কি হবে?

আমাদের দেশে ফিসকাল ট্রান্সপারেন্সি অ্যাক্ট আছে। আর্থিক স্বচ্ছতার এই আইন অনুযায়ী, জনগণের টাকা ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রতি তিন মাস পরপর সংসদে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির প্রতিবেদন দেওয়ার কথা অর্থমন্ত্রীর। কিন্তু সেটা মানা হয় না, আগের অর্থমন্ত্রীও পরিষ্কারভাবে মানেননি, বর্তমানেও এখনও মানা হচ্ছে না।   

এবং সবশেষে আমার প্রশ্ন পরিধি নিয়ে। ব্যাংকের টাকা নিয়ে যারা বিদেশে পাচার করেছে তাদের ব্যাপারে এই কমিশন কোনো পদক্ষেপ নেবেন কি না। কেন এভাবে ব্যাংকের টাকা বিদেশে যায়, কিভাবে যায় সেটার ব্যাপারে ওনারা কিছু বলবেন কি না।

আর এই কমিশনকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ, ক্ষমতা, পরিবেশ দিতে হবে। তথ্য-উপাত্তের সর্বোচ্চ ব্যবহার যেন হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। স্বার্থসংশ্লিষ্ট অংশীজনের সুচিন্তিত মতামতকে গ্রহণ করার সুযোগ রাখতে হবে।   

 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.