আমজনতার উদাসীনতায় কক্সবাজারে ক্রমে বাড়ছে করোনা 'পজিটিভ'; বাড়ছে উদ্বেগ
বিশ্ব মহামারি করোনার প্রাদুর্ভাব কক্সবাজারে ক্রমে বাড়ছে। শহর ছাড়িয়ে গ্রামেও ছড়িয়ে পড়ছে করোনার তীব্রতা। ছড়াচ্ছে জেলার আশপাশের উপজেলাতেও।
সরকারের তরফ থেকে সচেতনতা বাড়াতে নানা উদ্যোগ নেয়ার পরও জনগণের উদাসীনতায় প্রতিদিনই করোনা 'পজিটিভ' রোগীর সন্ধান মিলছে বলে অভিমত সচেতন মহলের। ফলে বাড়ছে উদ্বিগ্নতা।
রোগী বাড়ার পাশাপাশি করোনার উপসর্গ নিয়ে ধীরে ধীরে মৃতের সংখ্যাও বাড়ছে। বৃহস্পতিবার রাত ১০টা পর্যন্ত করোনার উপসর্গ নিয়ে কক্সবাজারে নারীসহ তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। পাশাপাশি যথাযথ চিকিৎসায় ইতিমধ্যে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৫৮জন করোনা রোগী।
কক্সবাজার মেডিকেল কলেজে পিসিআর ল্যাব স্থাপনের অর্ধশত দিন পর্যন্ত নমুনা পরীক্ষার আওতায় এসেছেন ৪ হাজার ৫৯৩ সন্দেহজনক রোগী। পরীক্ষা হওয়াদের মাঝে করোনা পজিটিভ এসেছে ৩০৯ জনের।
এদের মাঝে কক্সবাজার জেলার ২৭৪ জন আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন। তাদের মাঝে রয়েছে ১৩ রোহিঙ্গাও। কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. অনুপম বড়ুয়া এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
তার মতে, কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের ল্যাবে বৃহস্পতিবার (২১ মে) ১৬২ জনের নমুনা পরীক্ষার রিপোর্টে নতুন ১৭ জনের করোনা 'পজিটিভ' এসেছে। পাশাপাশি রামু ডেডিকেটেড করোনা হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়া ৮ জন এবং চকরিয়া ডেডিকেটেড করোনা হাসপাতালের একজন পুরাতন করোনা রোগীর ফলোআপ রিপোর্ট আবারো 'পজেটিভ' পাওয়া যায়।
বাকি ১৩৬ জনের 'নেগেটিভ' রিপোর্ট এসেছে। বৃহস্পতিবার 'পজেটিভ' আসা ১৭ রোগীর ১৬ জন কক্সবাজার জেলার বাসিন্দা। বাকি একজনের বাড়ি চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড উপজেলায়।
আর বুধবার নতুন শনাক্ত হন ২৯ জন। ১৫৪ জনের নমুনা পরীক্ষায় ৩৩ জন পজেটিভ আসাদের মাঝে ৪ জন ফলোআপ রোগী। যারা চিকিৎসা নেয়ার পর আবারো পজেটিভ রিপোর্ট এসেছে। আর নতুন শনাক্তের মাঝে কক্সবাজার জেলার ২৩ জন এবং বাকি ৬জন প্রতিবেশী উপজেলা লোহাগাড়া-সাতকানিয়া ও বান্দরবানের রোগী।
এর আগেরদিন (মঙ্গলবার) পজিটিভ মিলেছিল ৪২ জন রোগী। এদিন ১৭৮ নমুনা পরীক্ষায় পজিটিভ আসাদের মাঝে ৪ রোহিঙ্গা ও এলিট ফোর্স র্যাবের এক সদস্যসহ ৩৩ জন কক্সবাজারের। ৮ জনের ফলোআপ রিপোর্ট এবং বাকিজন বান্দরবানের।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, রোগীর পরিসংখ্যান বাড়ার সঙ্গে করোনার উপসর্গ নিয়ে ধীরে ধীরে মৃতের সংখ্যাও দীর্ঘ হচ্ছে। করোনার উপসর্গ নিয়ে কক্সবাজারে তৃতীয় মৃত্যুর শিকার হয়েছেন কক্সবাজার শহরের বড় বাজার জামে মসজিদ রোড এলাকার প্রতিষ্টিত ব্যবসায়ী 'ডিস্ট্রিবিউটর এসোসিয়েশন অব কক্সবাজার'র সহ-সভাপতি, 'মেসার্স হাজী কাসেম এন্ড সন্স'র স্বত্বাধিকারী হাজী নুরুল আবছার।
বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালের আইসোলেশন থেকে চট্টগ্রাম রেফার করা হলে এ্যাম্বুলেন্সে তোলার সময় তিনি মৃত্যু বরণ করেন বলে জানিয়েছেন 'সাতকানিয়া-লোহাগাড়া সমিতি'র সহ-সভাপতি ব্যবসায়ী আবদুর রহমান। মৃত নুরুল আবছার করোনায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন ছিলেন।
এর আগে বুধবার ভোরে নিজ বাড়িতে করোনার উপসর্গ নিয়ে দ্বিতীয় মৃত্যুর শিকার হন শহরের তারাবনিয়ারছরার বাসিন্দা খোরশেদ আলম। তিনি টেকনাফের হ্নীলার নয়াবাজার এলাকার মৃত হাজী আলী মিয়া দফাদারের ছেলে ও তারাবনিয়ার ছরার স্থায়ী বাসিন্দা। ১৭ মে তার করোনার স্যাম্পল নেয়া হয় এবং ২০ মে মৃত্যুর পর রিপোর্ট আসে তিনি করোনা পজিটিভ ছিলেন।
কক্সবাজারে করোনার উপসর্গ নিয়ে সর্ব প্রথম মৃত্যুবরণ করেন রামু উপজেলার কাউয়ারখোপ ইউনিয়নের পূর্ব কাউয়ারখোপ গ্রামের মো. আবদুল্লাহর স্ত্রী ছেনু আরা বেগম। গত ৩০ এপ্রিল রাতে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে আইসোলেশন ইউনিটে ভর্তির ৬ ঘন্টার মাথায় তিনি মারা যান। পরে রিপোর্টে তার করোনা পজিটিভ এসেছিল।
এভাবে দিন দিন করোনা পজিটিভ রোগী বাড়ায় সচেতন মহল আতংকিত উল্লেখ করে কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স ও সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী খোকা বলেন, করোনা যেহেতু ছোঁয়াচে ভাইরাসজনিত রোগ সেহেতু শুরু থেকেই এ বিষয়ে সরকার ও প্রশাসন নানা সচেতনতা মূলক কার্যক্রম চালিয়েছে। প্রশাসনের সঙ্গে সচেতনতা চালিয়েছে বিভিন্ন সংস্থা ও সামাজিক এবং রাজনৈতিক সংগঠনও।
কিন্তু সবকিছুকেই উদাসীনভাবে নিয়েছে আমজনতা। ফলে এখন এর কুফল দৃশ্যমান হচ্ছে। লকডাউনকে তাচ্ছিল্য করায় প্রতিদিন বাড়ছে করোনা পজিটিভ রোগী। ধীরে ধীরে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও।
কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের করোনা পরীক্ষার ল্যাবের রিপোর্ট মতে, কক্সবাজারের ৮টি উপজেলা, ৩৪টি রোহিঙ্গা ক্যাম্প, বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা এবং চট্টগ্রামের লোহাগাড়া-সাতকানিয়া থেকে সন্দেহভাজন রোগীর করোনা নমুনা সংগ্রহ করা হয় প্রতিদিন।
এ ল্যাবে গত ৫০ দিনে পরীক্ষার আওতায় আসা ৪ হাজার ৫৯৩ সন্দেহজনক রোগীর মাঝে করোনা পজিটিভ এসেছে ৩০৯ জনের। এদের মাঝে কক্সবাজার জেলার ২৭৪ জন আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন।
তাদের মাঝে চকরিয়া উপজেলায় ৮৫ জন, কক্সবাজার সদর উপজেলায় ৮৫ জন, পেকুয়া উপজেলায় ২৭ জন, মহেশখালী উপজেলায় ১৩ জন, উখিয়া উপজেলায় ৩৩ জন, টেকনাফ উপজেলায় ৯জন, রামু উপজেলায় ৫জন, কুতুবদিয়া উপজেলায় ২ জন এবং রোহিঙ্গা শরনার্থী ১৩জন।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, "বিশ্বময় করোনার ধকল দেখে শুরুতেই পর্যটন নগরী কক্সবাজার তথা এর জনগণকে রক্ষায় লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছিল। অসচেতন জনতা চোর-পুলিশ খেললেও কঠোরতার কারণে দীর্ঘ দু'মাস কক্সবাজারে করোনার প্রাদুর্ভাব কমই ছিল। করোনামুক্ত ছিল রোহিঙ্গা ক্যাম্পও।
কিন্তু সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীদের কথা চিন্তা করে সম্প্রতি লকডাউন সীমিত ঘোষণার পর অবিবেচকভাবে ঘুরে বেড়ানোর চেষ্টা চালিয়েছে সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীরা। ফলে, কক্সবাজারেও এখন করোনার 'পজিটিভ' সংখ্যা বাড়ছে। এরপরও যথাযথ চিকিৎসা প্রয়োগ হওয়ায় মৃত্যুর হার কমই রয়েছে। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন অর্ধশত রোগীও। আমরা এখনো বলছি, সচেতনতা ছাড়া করোনার প্রাদূর্ভাব কমানো অসম্ভব। নিজ নিজ অবস্থান থেকে আমরা সচেতন হলে করোনার গতি ধরে রাখা সম্ভব।"