আন্তর্জাতিক সমুদ্র পরিবহনে যুক্ত হচ্ছে দেশীয় পতাকাবাহী আরো দুটি ফিডার ভ্যাসেল

বাংলাদেশ

05 April, 2021, 10:20 am
Last modified: 05 April, 2021, 10:30 am
দেশীয় পতাকাবাহী জাহাজের বহরে দুটি জাহাজ যুক্ত হওয়া নিঃসন্দেহে দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। দেশের মেরিটাইম সেক্টর আরো সমৃদ্ধ হবে। বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে।
  • আজ শুরু হচ্ছে দুটি নতুন জাহাজের যাত্রা 
  • প্রথম দুটি জাহাজ যুক্ত হয় ২০২০ সালের জুনে
  • এইচ আর লাইনের বহরে এখন ৪টি কন্টেইনার জাহাজ
  • প্রথম ৮ মাসে জাহাজ দুটি পরিবহন করে ৬৬ হাজার ৩৯৬ টিইউস কনটেইনার। ভাড়া বাবদ ৮ মাসে প্রতিষ্ঠানটির আয় হয়েছে ১২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
  • আগে বিদেশী ফিডার ভ্যাসেলে ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর সিঙ্গাপুর, কলম্বো এবং পোর্ট কেলাং থেকে পণ্য লোডিং করতে সময় লাগতো ৩ দিন, কর্ণফুলীর জাহাজে এখন ২ দিনে পণ্য লোড করা সম্ভব হচ্ছে। সময় কমে এসেছে ১ দিন। এক সপ্তাহের মতো অপেক্ষা করা লাগতো শিডিউল পেতে, এখন সপ্তাহে  ৩ দিন পণ্য পরিবহন করছে বাংলাদেশী ফিডার ভ্যাসেল 
  • বাংলাদেশ পতাকাবাহী জাহাজ সংরক্ষণ আইন ২০১৯ এর কারণে বার্থিংয়ে অগ্রাধিকার পাচ্ছে কর্ণফুলীর জাহাজ।
  • নতুন দুটি জাহাজে ২২ করে ৪৪ জন নাবিক রয়েছে। তারা সবাই বাংলাদেশি   
  • ২২৫ কোটি টাকার বিনিয়োগ
  • আগামী জুলাইয়ের শেষ দিকে আরো দুটি জাহাজ যুক্ত করার পরিকল্পনা করছে প্রতিষ্ঠানটি।
  • সময় ও খরচ কমছে ব্যবসায়ীদের 

চট্টগ্রাম বন্দর থেকে কন্টেইনারবাহী পণ্য ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর হয়ে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছাতে ফিডার ভ্যাসেলের অপেক্ষায় থাকতে হতো ৭ থেকে ৮ দিন। গত বছরের জুন থেকে চালু হওয়া কর্ণফুলী গ্রুপের বাংলাদেশি পতাকাবাহী দুটি ফিডার ভ্যাসেল 'সাহারে' ও 'সারেরা' দীর্ঘ অপেক্ষা দূর করেছে। এখন ২ থেকে ৩ দিনের মধ্যে পণ্য জাহাজীকরণ শেষে ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করতে পারছে ফিডার ভ্যাসেলগুলো। এতে আন্তর্জাতিক সমুদ্র পথে পণ্য পরিবহনে সময় এবং অর্থ দুটোরই সাশ্রয় হয়েছে ।  

ব্যবসার সফলতায় কর্ণফুলী গ্রুপ আবারো নতুন বিনিয়োগ নিয়ে এসেছে। ২২৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে এই পথে আরো দুটি জাহাজ সংযুক্ত করতে যাচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে রপ্তানিপণ্যের কন্টেইনার নিয়ে আগামী ৫ এপ্রিল সিঙ্গাপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করবে এমভি এইচআর রিয়া। 

এরপর আগামী ৭ এপ্রিল এমভি  এইচআর হেরা চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্য নিয়ে কলম্বোর উদ্দেশ্যে যাত্রা করবে। সিঙ্গাপুর- কলম্বো, পোর্টকেলাং বন্দরে চলাচল শুরু করবে এসব জাহাজ। আন্তর্জাতিক সমুদ্র পথে নতুন এই দুটি ফিডার জাহাজ যুক্ত হওয়ায় এখন ট্রান্সশিপমেন্ট পোর্ট থেকে বাংলাদেশি পতাকাবাহী কন্টেইনার জাহাজের সংখ্যা  ৪টি।  

চট্টগ্রাম বন্দর বছরে প্রায় ৩ মিলিয়ন টিইউস কন্টেইনার হ্যান্ডেলিং করে। যার সবগুলোই ট্রান্সশিপমেন্ট পোর্ট থেকে বিদেশী জাহাজ পরিচালনা করত।  

চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কা ও চীনের বন্দরগুলোতে বিদেশী ২২ টি ফিডার অপারেটর ৮৪টি কন্টেইনার জাহাজের মাধ্যমে ট্রানজিট রুটে পণ্য পরিবহন করে। এসব জাহাজ বর্তমানে কলম্বো, সিঙ্গাপুর এবং পোর্ট কেলাং এ ৯০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের আমদানি রপ্তানি পণ্য পরিবহন করে। ছিল না বাংলাদেশি কোন ফিডার ভ্যাসেল। 

দীর্ঘ ১০ বছর পর গত আট মাস আগে প্রথম ২ টি ফিডার ভ্যাসেল এই পথে নিয়ে আসে কর্ণফুলী গ্রুপ।

দুটি জাহাজ গত ৮ মাসে ৬৬ হাজার ৩৯৬ টিইউস কনটেইনার পরিবহন করে। ভাড়া বাবদ ৮ মাসে প্রতিষ্ঠানটির আয় হয়েছে ১২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। যা পরিবহন হওয়া কন্টেইনারের মাত্র চার ভাগ। এই ভাড়া আগে পেত বিদেশী জাহাজ যা এখন পেল বাংলাদেশ। আর আজ থেকে ৮৪টি ফিডার ভ্যাসেলের সাথে আরো নতুন ২টি যুক্ত হয়ে বাংলাদেশী ফিডার ভ্যাসেল হবে ৪টি। 

চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিতে বিদেশী জাহাজগুলোর পণ্য লোডিং আনলোডিংয়ে সময় লাগতো ৩ দিন। দেশীয় জাহাজের অগ্রাধিকার বার্থিং পাওয়ায় কর্ণফুলী গ্রুপের জাহাজ দুটিতে সময় লেগেছে ২ দিন করে, জানিয়েছেন কর্ণফুলী গ্রুপের কর্মকর্তারা। 

আমদানি ও রপ্তানিকারকরা বলছেন, আন্তর্জাতিক সমুদ্র পরিবহনে বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজগুলো নির্দিষ্ট সময়ে আমদানি রপ্তানি পণ্য গন্তব্যে পৌঁছে দিতে ভূমিকা রাখছে। বন্দরে কন্টেইনার জটের কারণে নির্দিষ্ট সময়ে পণ্য পৌছানোর অনিশ্চয়তা দূর হওয়ার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সমুদ্র পরিবহন ব্যবসায় বাংলদেশের ভাবমূর্তি উজ্বল হবে। 

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'দেশীয় পতাকাবাহী জাহাজের বহরে দুটি জাহাজ যুক্ত হওয়া নিঃসন্দেহে দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। দেশের মেরিটাইম সেক্টর আরো সমৃদ্ধ হবে। বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে'।   

এইচ আর লাইনের নির্বাহী পরিচালক আনিস উদ দৌলা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'চিটাগং কলম্বো এক্সপ্রেস সার্ভিসের আওতায় নতুন দুটি জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সিঙ্গাপুর-কলম্বো-পোর্টকেলাং বন্দরে পণ্য পরিবহন করবে। আমাদের আগের দুটি জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সিঙ্গাপুর বন্দর ও মালয়েশিয়ার কেলাং বন্দরে আমদানি-রপ্তানি পণ্যবাহী কনটেইনার আনা-নেওয়া করে। ওই দুটি জাহাজ ইতোমধ্যে রপ্তানিকারক এবং আমদানিকারকদের মাঝে নির্দিষ্ট সময়ে পণ্য পরিবহনে আস্থা সৃষ্টি করতে পেরেছে। চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য লোডিং আনলোডিংয়ে বিদেশী কোম্পানীর জাহাজগুলোর তুলনায় ১ দিন সময় কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে'। 

তিনি আরো বলেন, 'রপ্তানি পণ্য লোডিংয়ের জন্য গত শনিবার (৩ এপ্রিল) বন্দরের এনসিটি (নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল) ইয়ার্ডে বার্থিং করা করা হয়েছে। পণ্য বোঝাই শেষে ৫ এপ্রিল (সোমবার) সিঙ্গাপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করবে'।

চট্টগ্রাম বন্দর সূত্র জানায়, ২০১৮ সালে চট্টগ্রাম বন্দর কনটেইনার হ্যান্ডেলিং করেছিল ২৯ লাখ ৩ হাজার টিইইউ। ২০১৯ সালে তা  বেড়ে দাঁড়ায় ৩০ লাখ ৮৮ হাজারে। ২০২০ সালে কন্টেইনার হ্যান্ডেল করে ২৮ লাখ ৩৯ হাজার ৯৭৭ টি।    

কর্ণফুলী গ্রুপ সূত্র জানায়, বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পরিবহন হওয়া কন্টেইনারের মাত্র ৪ ভাগ পরিবহন হয় দেশীয় জাহাজ দিয়ে। আগামী ২ থেকে ৩ বছরের মধ্যে এই হার ২০ থেকে ৩০ ভাগে উন্নীত করার লক্ষমাত্রা নিয়ে কাজ করছে কর্ণফুলী গ্রুপ।

কর্ণফুলী গ্রুপ সূত্র আরো জানায়, আগামী আগষ্টে আসছে আরো দুটি নতুন জাহাজ। এই ৪ জাহাজে ২২৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। আগের বিনিয়োগসহ এই খাতে গ্রুপটির মোট বিনিয়োগ দাঁড়াবে ৩৩৫ কোটি টাকা।

এমভি এইচআর হেরা জাহাজটির কন্টেইনার ধারণ ক্ষমতা ১৪৫৪ টিইউস। ১৮২.৮৩ মিটার লম্বা এবং ২৮ মিটার চওড়া জাহাজটির ড্রাফট ৬.৪ মিটার।  

এমভি এইচআর রিয়া জাহাজটির কন্টেইনার ধারণ ক্ষমতা ১৪৫৪ টিইউস। ১৮২.৮৩ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ২৮ মিটার প্রস্থের জাহাজটির ড্রাফট ৫.৩ মিটার।  জাহাজ দুটিতে ২২ করে ৪৪ জন নাবিক নিয়োজিত রয়েছে। এদের সবাই বাংলাদেশি। 

চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাষ্ট্রির সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, 'দেশে যেভাবে শিল্পের বিকাশ ঘটছে আন্তর্জাতিক সমুদ্র পথেও বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব বাড়াতে হবে। এই খাতে কর্ণফুলী গ্রুপের মতো আরো নতুন বিনিয়োগকারীকে এগিয়ে আসতে হবে। তাহলে বিশ্ববাণিজ্যে বাংলাদেশের সুনাম আরো বৃদ্ধি পাবে'।  

উল্লেখ্য, বাংলাদেশে গভীর সমুদ্র বন্দর না থাকায় চট্টগ্রাম সমদ্র বন্দরে বড় কন্টেইনারবাহী জাহাজ ভিড়তে পারে না। ফলে আন্তর্জাতিক রুটে কন্টেইনারবাহী পণ্য পরিবহনের জন্য ছোট জাহাজের উপর নির্ভর করতে হয়। এসব জাহাজে করে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে কন্টেইনারবাহী পণ্য নিয়ে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, চীনসহ বিভিন্ন দেশের বন্দরে ট্রানজিট সুবিধা নিয়ে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছানো হয়। এসব জাহাজকে ফিডার ভ্যাসেল হিসেবে অভিহিত করা হয়। 

তৈরী পোষাক শিল্পসহ অন্যান্য রপ্তানি পণ্য শুরুতে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ফিডার ভ্যাসেলে করে সিঙ্গাপুর মালয়েশিয়া বন্দরে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর ট্রানজিট হয়ে ওই কন্টেইনারগুলো বড় জাহাজে করে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌছায়। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে অনেক সময় ফিডার জাহাজের শিডিউল পরবর্তীতে ট্রানজিট পেতেও সমস্যার সম্মুখীন হতে হতো। বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ চালু হওয়ায় এখন সেই চিন্তা দূর হয়েছে বলে জানিয়েছেন রপ্তানির সাথে সংশ্লিষ্টরা।   

বিজিএমইএ'র সহ সভাপতি এ এম চৌধুরী সেলিম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'কর্ণফুলী গ্রুপের আগের দুটি জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দর থেকে নির্দিষ্ট সময়ে পণ্য জাহাজীকরণ এবং গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ায় আমাদের পণ্য রপ্তানিতে সময় কম লাগছে। আগের থেকে ২-৩ দিন করে কম লাগছে'। 

বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ সংরক্ষণ আইন ২০১৯ অনুযায়ী চট্টগ্রাম বন্দরে বার্থিং পেতে অগ্রাধিকার পাবে এইচআর লাইনস লি:। দেশীয় জাহাজে ৫০ শতাংশ পণ্য পরিবহনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ফলে জেটিতে জাহাজ ভিড়ানোর জন্যও অপেক্ষা করতে হবে না।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.