অপহরণ-ইয়াবা-চাঁদাবাজি ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে উত্তপ্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্প

বাংলাদেশ

সায়ীদ আলমগীর, কক্সবাজার    
07 October, 2020, 08:30 pm
Last modified: 07 October, 2020, 08:37 pm
এক সপ্তায় ৮জন খুন। মঙ্গলবার মারা যাওয়া চারজনের একজন বাংলাদেশি। রোহিঙ্গা শিবিরের অভ্যন্তরে গড়ে উঠা দোকানপাট থেকে চাঁদা আদায়, মিয়ানমার থেকে আসা ইয়াবা ও নানা প্রকার মাদক ও অস্ত্র বানিজ্য, সংগঠন ভিত্তিক এলাকা দখল নিয়ে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করেই প্রতিনিয়ত চলছে সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনা। 

অপহরণ-ইয়াবা বিকিকিনি-চাঁদাবাজি ঘিরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গ্রুপিং বেড়েছে। ক্ষমতার আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বেড়েছে খুনাখুনি। শক্তিশালী প্রতিপক্ষের সঙ্গে সংঘর্ষে গত এক সপ্তাহে নারীসহ নিহত হয়েছেন ৮ জন। 

মঙ্গলবার (৬ অক্টোবর) সন্ধ্যার পর সংঘর্ষে- পিটিয়ে, জবাই ও গুলি করে চারজনকে হত্যা করা হয়েছে। এদের মাঝে তিনজন রোহিঙ্গা ও অপর একজন বাংলাদেশি নাগরিক। তিনি স্থানীয় অধিবাসী ও পরিবহন চালক। এনিয়ে চরম উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পরিবেশ। ফলে সাধারণ রোহিঙ্গা ও স্থানীয়দের মাঝে বেড়েছে বিস্ফোরক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ। 

সংঘর্ষ থামাতে আইনশৃংখলা বাহিনী কাজ করার পাশাপাশি উদ্ভূদ পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শনে আসেন পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি মো. আনোয়ার হোসেন।

ক্যাম্পের একাধিক সূত্র জানায়, রোহিঙ্গা শিবিরের অভ্যন্তরে গড়ে উঠা দোকানপাট থেকে চাঁদা আদায়, মিয়ানমার থেকে আসা ইয়াবা ও নানা প্রকার মাদক ও অস্ত্র বানিজ্য, সংগঠন ভিত্তিক এলাকা দখল নিয়ে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করেই প্রতিনিয়ত চলছে সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনা। 

উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি রোহিঙ্গা শিবিরের বেশিরভাগেই একাধিক সন্ত্রাসী গ্রুপ সক্রিয় হয়ে উঠেছে। গত সপ্তাহজুড়ে কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং ১নং ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বিবাদমান রোহিঙ্গা দুই গ্রুপের মাঝে সংঘর্ষ ও সংঘাত শুরু হয়েছে। 

দফায় দফায় চলা এই সংঘর্ষে এপর্যন্ত এক বাংলাদেশীসহ ৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। 

গত মঙ্গলবার রাতে এক সাথে ৪জনের মৃত্যুর ঘটনায় ক্যাম্পে উত্তেজনা তীব্র আকার ধারণ করেছে। আজ বুধবার (৭ অক্টোবর) সকাল থেকে সারাদিন দু'পক্ষের মাঝে প্রকাশ্যে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। 

এসময় নতুন করে উভয়পক্ষে শতাধিক রোহিঙ্গা আহত হন। সকাল ১০টার পর থেকেই কুতুপালং নিবন্ধিত রোহিঙ্গা শিবিরে উত্তেজনা বাড়তে থাকে। এঘটনায় ভয়ে রোহিঙ্গারা দলে দলে ক্যাম্প ইনচার্জের অফিসে আশ্রয় নেয়। 
এসময় সাধারণ রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করতেও দেখা যায়। মঙ্গলবার নিহতদের মৃতদেহ ময়না তদন্তের জন্য কক্সবাজার জেলা হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে।

রোহিঙ্গারা বলছেন, ক্যাম্পের অভ্যন্তরে ইয়াবা ব্যবসা, দোকান থেকে চাঁদাবাজি ও এলাকা ভিত্তিক আধিপত্য বিস্তার নিয়ে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী মুন্না ও আনাছ গ্রুপের মাঝে সংঘর্ষ চলে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। এরই জেরে খুনের ঘটনা বাড়ছে। 

গত এক সপ্তাহ ধরে ক্যাম্পজুড়ে আতংক বিরাজ করছে। ইয়াবার ভাগ-ভাটোয়ারা নিয়ে মুন্না ও আনাছ বাহিনীর সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলে আসছে। কিন্তু, গত ৪ অক্টোবর থেকে গোলাগুলিসহ সংঘর্ষ প্রকাশ্যে হলে সাধারণ রোহিঙ্গাদের মধ্যে ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।

হ্নীলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রাশেদ মো. আলী জানান, উখিয়ার কুতুপালং লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা শিবিরে মঙ্গলবার রাতে ভয়াবহ সংঘর্ষে  ৪ জন নিহতের মধ্যে একজন আমার এলাকার নোয়াহ মাইক্রোবাস চালক নুরুল হুদা বলে জেনেছি। তার সাথে থাকা অপর চালক আবুল বশরও নিহত হয়েছে বলে প্রথমে শুনলেও, কেউ কেউ বলছে এখনো আবুল বশর বেঁচে আছে। তাকে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা আটকে রেখেছে।

স্থানীয় সূত্র জানায়, যাত্রীবেশে একদল রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী রঙ্গিখালী এলাকা থেকে নুরুল হুদার নোয়াহ মাইক্রোবাস ভাড়া করে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সংঘর্ষে যোগ দিতে যায়। ক্যাম্পে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিপক্ষ সন্ত্রাসীরা গাড়িতে থাকাদের অতর্কিত হামলা করে। রোহিঙ্গা ভেবে স্থানীয় নুরুল হুদাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এসময় আবুল বশরকে নির্দয় ভাবে মারপিট করার পর আটকে রাখা হয়। 

উখিয়া থানার ওসি (তদন্ত) গাজী সালাহউদ্দিনের দেয়া তথ্যমতে, ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দু'গ্রুপের মাঝে উত্তেজনা চলছে। তবে আইনশৃংখলা বাহিনী সজাগ থাকায় ক্যাম্পের পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। গত এক সপ্তাহ ধরে চলে আসা ঘটনার জেরে কক্সবাজার র‌্যাব-১৫ টেকনাফের চাকমারকুল এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৯জন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীকে আগ্নেয়াস্ত্রসহ আটক করেছে।

এদিকে, বুধবার সকাল থেকে লম্বাশিয়া ক্যাম্পে উত্তেজনা বাড়ার খবরে দায়িত্বরত এপিবিএন সদস্য, পুলিশ, আনসার ও সেনাবাহিনী টহল জোরদার করে। এসময় ঘটনাস্থল থেকে ৪জন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীকে আটক করে পুলিশ। 

বিকালে ঘটনাস্থলে আসেন পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি মো. আনোয়ার হোসেন। তিনি ক্যাম্পের পরিস্থিতি নিয়ে আইনশৃংখলা বাহিনীর সাথে বৈঠক করেন। পরে ডিআইজ সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেন।

ডিআইজি মো. আনোয়ার হোসেন জানান, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মঙ্গলবার দু'পক্ষের সংঘর্ষে ৪জন নিহত হওয়ার ঘটনায় কিছুটা উত্তেজনা বাড়লেও এখন পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে। ক্যাম্পের ভিতরে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর টহল বৃদ্ধি করা হয়েছে। এছাড়া, ঘটনাস্থলে যৌথ অভিযান চলছে। আইনশৃংখলা পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক। পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে পরবর্তীতে আরো পদক্ষেপ নেয়া হবে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক রোহিঙ্গা জানান, উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে আনাস ও মাস্টার মুন্না গ্রুপের মধ্যে বিরোধ চলে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। এরই জেরে কুতুপালং ২ ওয়েষ্ট ডি-ব্লকে ৪ অক্টোবর রাতে মুন্না গ্রুপের ৪-৫ শত রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী দা-লাঠিসোটা নিয়ে ক্যাম্পের শতাধিক ঝুপড়ী ঘর ও ৫০ টি দোকান ভাংচুর করেছে। 

এঘটনায় আনাস গ্রুপ আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং মুন্না গ্রুপের উপর চড়াও হয়। এভাবে গত সপ্তাহজুড়ে বিক্ষিপ্তভাবে সংঘর্ষ চলে আসছে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে চলছে দু'গ্রুপের মাঝে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া, গোলাগুলির ঘটনা। একারণে প্রাণ বাঁচাতে কয়েক'শ সাধারণ রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশু কুতুপালং ক্যাম্প ছেড়ে অন্য ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে। বর্তমানে ক্যাম্পের অভ্যন্তরে দোকানপাট বন্ধ আছে।

গত ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর থেকে মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের পাহাড়ি জমিতে ৩৪টি ক্যাম্পে আশ্রয় নেয় ১১ লাখেরও বেশী রোহিঙ্গা। আশ্রয় নেয়ার পর এক বছর নীরবে রোহিঙ্গারা সময় অতিবাহিত করলেও যত দিন যাচ্ছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে অপরাধ বাড়ছে। স্থানীয় মাদক ও ইয়াবা কারবারি এবং চোরাচালানিদের সঙ্গেও তাদের অবাধ যাতায়াত। আর ক্যাম্পগুলোকে মাদক, ইয়াবা, অস্ত্রের মজুদ বানিয়ে ফেলেছে। অপরাধের মাত্রা বেড়ে এখন রোহিঙ্গাদের মধ্যেই রাত হলেই সংঘর্ষ চলে। 

কক্সবাজার জেলা পুলিশের দেয়া তথ্য মতে, গত ২০১৭ সালে নানা অপরাধে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা ছিল ৭৬টি আর আসামি হয় ১৫৯ জন। ২০১৮ সালে ২০৮ মামলায় আসামি হয়েছে ৪১৪ জন। ২০১৯ সালে মামলার সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ২৬৩টি আর আসামি হয় ৬৪৯ জন। চলতি বছরের ২৫ আগস্ট পর্যন্ত রোহিঙ্গা অপরাধীদের বিরুদ্ধে হওয়া ১৮৪ মামলায় আসামি হয় ৪৪৯ জন।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে চলমান উত্তেজনা, সংঘর্ষের কথা উল্লেখ করে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী ত্রাণ প্রত্যাবাসন কার্যালয়ের অতিরিক্ত কমিশনার সামশুদ্দোহা নয়ন বলেন, রোহিঙ্গা শিবিরের চলমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতি নিয়ে কাজ করছে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী। ঘটনাস্থলে আছেন সেনাবাহিনী, র‌্যাব, পুলিশ ও এপিবিএন সদস্যরা । ক্যাম্পের পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.