অনুমতি মিললেও দেশে টিকা উৎপাদনে ৫ মাস লেগে যাবে 

বাংলাদেশ

19 May, 2021, 09:25 am
Last modified: 19 May, 2021, 09:34 am
সাধারণ একটি ওষুধের উৎপাদনেও কয়েক মাস লেগে যায়। টিকা বানানো ওষুধের চেয়ে কঠিন। ফলে অন্তত ৪-৫ মাস সময়ের আগে তা সম্ভব নয়।

টিকা ক্রয়ের চেষ্টার পাশাপাশি চীন ও রাশিয়ার টিকা দেশে উৎপাদনের প্রক্রিয়া চালাচ্ছে সরকার। তবে দেশীয় কোন কোম্পানিকে টিকা উৎপাদনের অনুমতি দিলেও আগামী ৪-৫ মাসের আগে তা মানুষ পাবে না।  

দেশে টিকা উৎপাদনে সক্ষম প্রতিষ্ঠান এবং টিকা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনুমোদনের পর মূল প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দেশীয় প্রতিষ্ঠানের চুক্তি, প্রযুক্তি হস্তান্তর, মাস্টার সিড বা বাল্ক ফিল ফিনিশ আমদানি, উৎপাদন প্রক্রিয়া, ভ্যালিডেশন, স্টেরেলিটি, টেস্টিং রিএজেন্ট আমদানিসহ বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেষ করে তা বাজারজাত করতে অন্তত ৪-৫ মাস লাগবে। 

আন্তর্জাতিক উদারাময় গবেষণা কেন্দ্র আইসিডিডিআরবির ইমেরিটাস বিজ্ঞানী ড. ফেরদৌস কাদরী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'সক্ষমতা রয়েছে এমন কোনো কোম্পানিকে অনুমোদন দিলেও জনশক্তি এবং মেশিনারি ছাড়া সবই আমদানি করতে হবে। সাধারণ একটি ওষুধের উৎপাদনেও কয়েক মাস লেগে যায়। টিকা বানানো ওষুধের চেয়ে কঠিন। ফলে ৪-৫ মাস সময়ের আগে তা সম্ভব নয়'।

"অনুমোদন এবং চুক্তির পরও এখন পর্যন্ত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) প্রিকোয়ালিফিকেশন ন্যাশনাল রেগুলেটরি অথরিটি (এনআরএ) না পাওয়াটা আমাদের জন্য একটি সমস্যা। প্রিকোয়ালিফাইড টিকা না বানালে ইউনিসেফ সেই টিকা কিনবেনা, দেশের বাইরে সেই টিকা রপ্তানি করা যাবে না," যোগ করেন ড. ফেরদৌস কাদরী। 

দেশে টিকা উৎপাদনের প্লান্ট রয়েছে এমন তিনটি কোম্পানি ইনসেপ্টা, পপুলার ফার্মা ও হেলথকেয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের সক্ষমতা যাচাই করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে এগিয়ে থাকা ইনসেপ্টা চীনের সিনোফার্মের কোভিড-১৯ টিকা মাস্টার সিড ও ফিল ফিনিশ থেকে উৎপাদন করতে পারবে। বাল্ক থেকে ফিল ফিনিশ করতে পারবে বাকী দুটি কোম্পানিও।    

তবে যে প্রক্রিয়ায় যাক না কেন সবগুলোই সময়সাপেক্ষ বলে জানিয়েছেন ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের চেয়ারম্যান আব্দুল মুক্তাদির।

তিনি বলেন, যে প্রতিষ্ঠানের টিকা উৎপাদনের অনুমতি দেয়া হবে তাদের সঙ্গে দেশীয় কোম্পানির চুক্তি হতে হবে। তারা কোন পর্যায় থেকে উৎপাদনের অনুমতি দেবে, প্রযুক্তি হস্তান্তর কতদিনের মধ্যে করতে পারবে, আমদানির প্রক্রিয়া শেষ করতে কত দিন লাগবে তার ওপর নির্ভর করবে সময়সীমা। তবে পুরো বিষয়টি বেশ সময়সাপেক্ষ।

অনুমোদন এবং চুক্তি প্রক্রিয়া শেষে ফিল ফিনিশ হিসাবে টিকা নিয়ে আসলেও আমদানি ও তা উৎপাদনে বেশ সময় প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন দেশের ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিগুলোর কর্মকর্তারাও।  

সক্ষমতা রয়েছে এমন একটি কোম্পানির উর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলছেন, 'যেকোনো টিকা উৎপাদনের জন্য একটি নির্দিষ্ট উৎপাদন শ্রেণি (ক্রাইটেরিয়া) রয়েছে। অনেক পরীক্ষা করতে হয়। পরীক্ষার একটি স্ট্যান্ডার্ড প্রক্রিয়া রয়েছে। যেখান থেকে জিনিসটা পেতে যাচ্ছি তাদের প্রযুক্তি লাগবে। ওই প্রযুক্তির ব্যবহার আমাদের এখানে নিজেদের বুঝে নিতে হবে। প্রযুক্তির ভ্যালিডেশনও করতে হবে'। 

ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, 'একটা পণ্য একবার বানানোর পর পরেরবার আবার একই ভাবে বানানোকে বলে ভ্যালিডেশন। ভ্যালিডেশন করার জন্য একই পণ্য কয়েকবার বানাতে হয়, স্ট্যান্ডার্ড গাইডলাইন অনুসারে সেটিই নিয়ম'।  

'টিকা উৎপাদনের আগে সমস্ত ডাটা ওষুধ প্রশাসনের কাছে জমা দিতে হবে। তারা সব বিশ্লেষণ করে দেখবে। এরপর প্রক্রিয়া ঠিক আছে বলে জানালে সবশেষ প্রয়োজন অনুসরণ করে উপকরণ কিনে আনতে হবে। ভায়াল থেকে শুরু করে সবকিছু কিনে আনতে হবে। এসব কেনারও একটি প্রক্রিয়া রয়েছে', যোগ করেন তিনি।

ফিল ফিনিশ থেকে উৎপাদনও সময়সাপেক্ষ বলে জানিয়ে তিনি বলেন, 'সব প্রক্রিয়া শেষ করে পণ্যটা আনতে হবে। কেনার জন্য রিকুইজেশন পাঠানো হবে, এক দেশ থেকে আরেক দেশে পণ্য আসবে। একটি টিকা বানিয়ে ১৪ দিন রেখে দিতে হয়। তারপর স্টেরেলিটি চেক করতে হয়। এ থেকে শর্টকাটের কোন উপায় নেই। এতে কমপক্ষে আরো ১৪ দিন লাগবে। সব মিলিয়ে ৪-৫ মাস সময় লাগবে'। 

"একটা জিনিস নিয়ে এসে বোতলে ভরে দেয়া হলো বিষয়টা এমন নয়, এটি তো ওষুধ। তাই সময় লাগবে। বোতলে ভরতে গেলেও অনেক প্রক্রিয়া লাগবে।"

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যাচাই করা তিন কোম্পানির বাইরে রেনেটা এবং ওরিয়ন ফার্মাসিউটিক্যালস টিকা উৎপাদনের অনুমতি চেয়ে ঔষধ প্রশাসনের কাছে আবেদন করেছে।

তবে তাদের পক্ষেও ৬-৭ মাসের আগে টিকা উৎপাদন সম্ভব নয় জানিয়েছে কোম্পানিগুলো।

রাশিয়ার ভ্যাকসিন উৎপাদনের জন্য ওষুধ প্রশাসনে আবেদন করেছে এমন আরেকটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী দ্য বিজনেস স্টান্ডার্ডকে বলেন, অনুমোদন দেয়ার পরও অন্তত ছয় মাস লাগবে তা বাজারজাত করতে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, 'অনুমোদন দেয়ার পর চুক্তি করে কাঁচামাল সংগ্রহ করে তা দেশে এনে উৎপাদন করতে হবে। এলসির (ঋণপত্র)  মাধ্যমে আবেদন করে কাঁচামাল আনা, বন্দরে খালাস করা, ফ্যাক্টরিতে নেয়া ও প্রক্রিয়াজাত করার কাজটি বেশ সময় সাপেক্ষ। এরপর তা টেস্টিংয়ের পর সবশেষে বাজারে আনতে ৬-৭ মাস সময় লেগে যেতে পারে'। 

তবে আমাদের মেশিনারিজ ও জনশক্তির সংকট না থাকায় এবং করোনার টিকার প্রক্রিয়াটি দ্রুত অনুমোদন হবে এমন প্রত্যাশা করে আরেকটু কম সময়ে তা পাওয়ার আশা করছেন কেউ কেউ। 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান টিবিএসকে বলেন, বাংলাদেশে টিকা উৎপাদনের আগে হয়তো ফিল ফিনিশ করা হবে। সেজন্যও টিকার ভায়ালও আমদানি করতে হবে। ৩০ দিনে যে টিকা উৎপাদন করা হয় তা তিনদিন লাগে পূরণ করতে। তাই এটা খুব একটা সময়সাপেক্ষ না। বিদেশে এটা রোবট দিয়ে করা হলেও আমাদের এখানে অটোমেশনের মাধ্যমে ফিল ফিনিশ করা হবে'। 

এদিকে গত সোমবার স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সাংবাদিকদের বলেন, 'টিকা ক্রয়ের পাশাপাশি দেশেই টিকা উৎপাদন করতে কাজ করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে আগ্রহী প্রতিষ্ঠানগুলিকে কেন্দ্রীয় ঔষধ প্রশাসন কর্তৃক অনুমোদন নিতে হবে। কেন্দ্রীয় ঔষধ প্রশাসন সব ধরণের উৎপাদন ক্ষমতা যাচাই-বাছাই করে কিছু নাম সুপারিশ করলে তখন সেগুলো থেকে নির্দিষ্ট করে উপযুক্ত কোন এক বা একাধিক কোম্পানীকে উৎপাদন ক্ষমতা দেয়া যেতে পারে। এ ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কোন কোম্পানীকে অনুমোদন দেয়া হয়নি। সক্ষমতা থাকলেও দেশে টিকা তৈরিতে চার থেকে পাঁচ মাস সময় লাগবে'।

টিকা সংকটের কারণে এরইমধ্যে দেশের বিভিন্ন টিকা কেন্দ্রে সেকেন্ড ডোজের টিকা দেয়া বন্ধ হয়ে গেছে। অবশিষ্ট যা টিকা আছে তা দিয়ে আর ৬ দিন ভ্যাকসিন কার্যক্রম চালানো যাবে। কবে নাগাদ আরো টিকা আসবে এবং কার্যক্রম পুরোদমে চালানো যাবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে।  

রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এ এস এম আলমগীর বলেন, 'এত সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত টিকাদান কার্যক্রম টিকা সংকটের কারণে হঠাৎ থেমে যাচ্ছে এটাতে আমাদেরও খারাপ লাগছে। আমরা বিভিন্ন দেশের সাথে ব্যক্তিগতভাবে কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক উপায়ে যোগাযোগ করছি টিকা পেতে। আশা করা যাচ্ছে শিগগিরই টিকা পাওয়া যাবে'।  
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.