লন্ডনের ভুলে যাওয়া ভারতীয় আয়ারা

ফিচার

টিবিএস ডেস্ক
17 June, 2022, 07:15 pm
Last modified: 17 June, 2022, 07:18 pm
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে ইংরেজ পরিবারগুলোর শিশুদের দেখাশোনা করতেন ভারতীয় নারীরা। তাদের ডাকা হতো আয়া নামে। এই আয়াদের স্মৃতি রক্ষার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে দূর লন্ডনে। এই একই সম্মান এর আগে পেয়েছেন মহাত্মা গান্ধী, জওহরলালা নেহরু, বিআর আম্বেদকার, নূর ইনায়াত খানের মতো ব্যক্তিত্বরা।

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগে ভারত ও এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চল থেকে হাজার হাজার নারীকে আয়া হিসেবে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল লন্ডন, শিশুদের দেখাশোনা করার জন্য। কিন্তু এই নারীদের অনেককেই পরে কাজ থেকে বিদায় করে দেওয়া হয়। এখন লন্ডনের একটি ভবনে—যেখানে আয়ারা থাকতেন—তাদের স্মৃতি রক্ষার্থে নীল ফলক (ব্লু প্লাক) বসানো হচ্ছে।

যুক্তরাজ্যের দাতব্য সংস্থা ইংলিশ হেরিটেজ নীল ফলক স্কিমের আওতায় লন্ডনজুড়ে বিভিন্ন ঐতিহাসিক ভবনকে সম্মান জানায়। বিখ্যাত ব্যক্তিদের বাড়ির বাইরে ইংলিশ হেরিটেজ এই বিশেষ প্রতীক বসায়। প্রতীকের সাহায্যে সাধারণ মানুষকে বোঝানো হয়, ওই বাড়িতে কোনো বিশেষ ব্যক্তি থাকতেন।

মহাত্মা গান্ধী, জওহরলালা নেহরু, বিআর আম্বেদকারসহ বেশ কয়েকজন ভারতীয়কে নীল ফলক দিয়ে সম্মান জানানো হয়েছে। ২০২০ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গুপ্তচর নূর ইনায়াত খান প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত নারী হিসেবে নীল ফলক পান।

আয়াদের সম্মানে যে বাড়িতে নীল ফলক বসানো হচ্ছে, সেটি পূর্ব লন্ডনে অবস্থিত। ওই বাড়িতে নীল ফলক বসানোর জন্য প্রচারণা চালিয়েছিলেন ৩০ বছর বয়সি ভারতীয় বংশোদ্ভূত নারী ফারহানা মামুজি।

ওই ভবনে আশ্রয় পেয়েছিলেন কয়েকশো নিঃস্ব, পরিত্যক্ত আয়া ও আমাহ (চীনা আয়াদের এই নামে ডাকা হতো)।

সন্তানদের দেখাশোনার জন্য ব্রিটিশ পরিবারগুলো ভারত থেকে ফেরার সময় প্রায়ই আয়াদেরও নিয়ে আসত। ছবি: গেটি ইমেজেস

ফারহানা ও ইতিহাসবিদদের আশা, নীল ফলক বসানোর ফলে এই বিস্মৃত নারীরা আবার স্পটলাইটে আসবেন।

কারা ছিল আয়া?

এই নারীদের বেশিরভাগই লন্ডনে গিয়েছিলেন ভারত, চীন, হংকং, ব্রিটিশ সিলন (বর্তমান শ্রীলঙ্কা), বার্মা (মিয়ানমার), মালয়েশিয়া ও জাভা (ইন্দোনেশিয়ার অংশ) থেকে।

ইতিহাসবিদ ও এশিয়ানস ইন ব্রিটেন বইয়ের লেখক রোজিনা বিসরাম বলেন, 'আয়া ও আমাহরা ছিল মূলত গৃহকর্মী এবং ঔপনিবেশিক ভারতের ব্রিটিশ পরিবারগুলোর মেরুদণ্ড। তারা বাচ্চাদের দেখাশোনা করত, তাদের আনন্দের ব্যবস্থা করত। বাচ্চাদের গল্প শোনাত, ঘুম পাড়াত।'

এই পরিবারগুলো ভারত ব্রিটেনে ফিরে যাওয়ার সময় প্রায়ই তাদের আয়াদের সঙ্গে নিয়ে ফিরত। কাউকে কাউকে স্রেফ দীর্ঘ, বন্ধুর সমুদ্রযাত্রায় সঙ্গ দেওয়ার জন্য পরিবারগুলোর সঙ্গে নেওয়া হতো বলে জানান রোজিনা। আর বাকিদের কয়েক বছরের জন্য চাকরিতে রাখা হতো।

রোজিনা জানান, 'এই আয়াদের বাড়ি ফেরার টিকিটের খরচ সাধারণত ব্রিটিশ পরিবারগুলোই দিত।'

কিন্তু সবার ভাগ্য সুপ্রসন্ন হতো না। অনেককেই নিয়োগকর্তারা বেতন বা বাড়ি ফেরার কোনো ব্যবস্থা না করেই বিদায় করে দেয়। ফিরতি যাত্রায় সঙ্গে যাওয়ার জন্য কোনো পরিবার খুঁজে না পাওয়ায় অনেক আয়াই ব্রিটেনে থেকে যেতে বাধ্য হন।

এ বিষয়ে রোজিনার সঙ্গে কাজ করেছেন ব্রিস্টল ইউনিভার্সিটির সাহিত্য ও অভিবাসনের লেকচারার ফ্লোরিয়ান স্ট্যাডলার। তিনি বলেন, 'এর ফলে নিজের দায়িত্ব নিজেকেই নিতে হয় এই আয়দের।'

আয়াস' হোম, এখানে আশ্রয় পেতেন পরিত্যক্ত হাজারো আয়া। ছবি: ব্রিটিশ লাইব্রেরি

স্ট্যাডলার জানান, এই নারীরা প্রায়ই বাড়িতে ফিরে যাওয়ার জন্য সাহায্য চেয়ে স্থানীয় সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিতেন। আবার চড়া ভাড়ার জন্য বসবাসের অযোগ্য জায়গায় থাকতেও বাধ্য হতেন।

'আর টাকা ফুরিয়ে যাওয়ার পর এই মহিলাদের এসব জায়গা বাসস্থান থেকেও বের করে দেওয়া হতো। ভারতে ফিরে যাওয়ার জন্য অনেককে ভিক্ষাও করতে হয়েছিল,' বলেন স্ট্যাডলার।

আয়াস' হোম

ওপেন ইউনিভার্সিটির মেকিং ব্রিটেন গবেষণা প্রকল্পের তথ্য বলছে, ১৮২৫ সালে অল্ডগেটে এলিজাবেথ রজার্স নামে এক নারী আয়াস' হোম প্রতিষ্ঠা করেন। তার মৃত্যুর পর (তিনি কবে মারা গেছেন, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি) বাড়িটির দখল চলে যায় এক দম্পতির কাছে। জায়গাটিকে তারা ভ্রমণরত আয়াদের জন্য লজিং হাউস হিসেবে ব্যবহার করতেন।

ওই দম্পতি বাড়িটিকে মোটামুটি কর্মসংস্থান বিনিময়কেন্দ্র হিসেবে চালাত। ব্রিটিশ পরিবারগুলো এখানে আয়া খুঁজতে আসত।

১৯ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য শক্তিশালী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইংল্যান্ড ও ভারতের মধ্যে সফর আরও নিয়মিত হয়ে ওঠে। এ সময় ব্রিটেনে যাওয়া আয়াদের সংখ্যাও বেড়ে যায়।

রোজিনা জানান, 'প্রতি বছর আয়াস' হোমে ২০০ জন আয়া থাকতেন। কেউ অল্প কয়েকদিন থাকতেন, আবার কেউ কেউ কয়েক মাসও থাকতেন।'

আয়াস' হোমে থাকার জন্য টাকা দিতে হতো না। আশ্রয়কেন্দ্রটি স্থানীয় গির্জা থেকে অনুদান পেত। এমন আয়াও ছিলেন যাদের রিটার্ন টিকিট ছিল, কিন্তু অর্থ বা সঙ্গীর অভাবে বাড়ি ফিরতে পারেনি। এসব ক্ষেত্রে হোমের তত্ত্বাবধায়িকা সেই টিকিটটি ভারত যেতে ইচ্ছুক অন্য পরিবারের কাছে বিক্রি করে দিত। এখান থেকেও কিছু অর্থের সংস্থান হতো।

কিন্তু আয়াস' হোম স্রেফ একটা হোস্টেল বা আশ্রয়কেন্দ্র ছিল না।

স্ট্যাডলার জানান, হোমের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল আয়াদের খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা করা।

দুটি শিশুর সঙ্গে একজন আয়া, সার্কায়, ১৮৫০ সালে। ছবি: গেটি ইমেজেস

তিনি আরও বলেন, 'কিন্তু এই আয়াদের মধ্যে কতজন আসলে খ্রিষ্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন, তা আমরা জানতে পারিনি। কারণ এর কোনো রেকর্ড নেই। কিংবা ইংল্যান্ডে এই আয়াদের সত্যিই খ্রিষ্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য করা হয়েছিল, তা নিশ্চিত হওয়ার জন্যও কোনো রেকর্ড নেই।'

১৯০০ সালে আয়াস' হোম খ্রিষ্ঠান গোষ্ঠী লন্ডন সিটি মিশনের দখলে চলে যায়। তারা লজিং হাউসটি প্রথমে হ্যাকনির ২৬ কিং এডওয়ার্ডস রোডে এবং তারপর ১৯২১ সালে ৪ কিং এডওয়ার্ডস রোডে স্থানান্তরিত করে।

নীল ফলকের পথে যাত্রা

বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি নাগাদ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পতনের সঙ্গে সঙ্গে আয়া ও আমাহদের প্রয়োজনীয়তা কমে যায়। তখন ৪ কিং এডওয়ার্ডস রোডের ভবনটিকে ব্যক্তিগত বাসভবনে রূপান্তরিত করা হয়।

ফারহানা আয়াস' হোম সম্পর্কে প্রথম জানতে পারেন ২০১৮ সালে, 'আ প্যাসেজ টু ব্রিটেন' নামে বিবিসির একটি ডকুমেন্টারি দেখার সময়। ওই ডকুমেন্টারিতে হ্যাকনির এই লজিং হাউসটির কথা বলা হয় সংক্ষেপে। ফারহানাও ওই এলাকায়ই থাকতেন।

এরপরই ফারহানা আয়াস' হোম দেখতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি বলেন, 'পূর্ব লন্ডনে বসবাসকারী দক্ষিণ এশীয় নারী হিসেবে আমি আয়া এবং তাদের অব্যক্ত গল্পগুলোর সঙ্গে যোগসূত্র অনুভব করি।'

তখনই ফারহানা অনুভব করেন যে, এই বাড়িটির বিষয়ে তাকে কিছু করতে হবে।

তাই তিনি আয়াস' হোম প্রজেক্ট হাতে নেন। এ প্রকল্পের আওতায় আয়াদের ইতিহাস নথিভুক্ত করা হয়। আয়াস' হোমে নীল ফলক বসানোর জন্যও আবেদন করেন ফারহানা।

২০২০ সালে তিনি হ্যাকনি মিউজিয়ামে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সময় আয়াদের ভূমিকা জানার জন্য একটি ইভেন্টের আয়োজন করেন। তার উৎসাহে অনুপ্রাণিত হয়ে জাদুঘরের কর্মীরাও বিষয়টি নিয়ে গবেষণা শুরু করেন।

মিউজিয়ামের ব্যবস্থাপক নীতি আচার্য বলেন, তিনি ১৮৭৮ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত যুক্তরাজ্যে আসা এবং যুক্তরাজ্য ছেড়ে যাওয়া যাত্রীদের তালিকা, আদমশুমারি নিবন্ধন এবং বিভিন্ন উৎস দেখে যারা আয়া'স হোমে ছিলেন, তাদের চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছেন। 

কিন্তু আয়াদের সম্পর্কে খুব কম তথ্য থাকায় কাজটি ভীষণ চ্যালেঞ্জিং ছিল।

২৬ কিং এডওয়ার্ডস রোডের ভবন। ছবি: বিবিসি

নীতি আচার্য জানান, যেসব পরিবারের আয়া ও আমাহ ছিল, কেবল ওসব পরিবারের নথিই পাওয়া গেছে। আয়াদের ব্যাপারে আলাদা কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। এছাড়া যেসব আয়া খ্রিষ্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়ে যেতেন, সিংহভাগ সময় তাদের শুধু খ্রিষ্টান নামটাই পাওয়া গেছে। আসল নাম আর জানা যায়নি। আবার অনেকে যেসব পরিবারে চাকরি করতেন, ওইসব পরিবারের নামেই আয়াদের নামের রেকর্ড পাওয়া গেছে। যেমন, বার্ড পরিবারের আয়ার নাম লেখা হয়েছে 'আয়া বার্ড'। ফলে এই আয়াদের প্রকৃত পরিচয় একপ্রকার হারিয়েই গেছে।

ফারহানা ও সংশ্লিষ্ট অন্যদের আশা, নীল ফলক এই বিস্মৃত নারীদের আলোতে নিয়ে আসতে সাহায্য করবে। 

ফারহানা বলেন, 'এই নারীরা সত্যিই এই সম্মানের যোগ্য।'


  • সূত্র: বিবিসি

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.