নদীপথে যখন জীবনতরী এসে ভেড়ে...

ফিচার

টিবিএস ডেস্ক
16 June, 2022, 08:40 pm
Last modified: 16 June, 2022, 08:56 pm
দুই দশক ধরে পানিতে ভেসে ভেসে দেশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছে নৌকাটি। এ পর্যন্ত এই ভাসমান হাসপাতাল দেশের গ্রামাঞ্চলের সোয়া ৭ লাখ মানুষের চিকিৎসা করেছে।

দৌড়ানোর আকাঙ্ক্ষা মনে পুষে বড় হয়েছেন আল আমিন। কিন্তু এ বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ২৮ বয়সি এই যুবকের পক্ষে হাঁটাও অত্যন্ত দুরূহ কাজ ছিল। গত ফেব্রুয়ারিতে তার একটি ভাসমান হাসপাতালের ডাক্তাররা তার 'ক্লাবফুট' (পায়ের তালু ৯০ ডিগ্রী বেঁকে যাওয়া) ঠিক করে দেন। এই ভাসমান হাসপাতালটি না থাকলে বাংলাদেশের এক প্রত্যন্ত গ্রামে বসবাসকারী আল আমিন এই চিকিৎসা পেতে পারতেন না।

দুই দশক ধরে পানিতে ভেসে ভেসে দেশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছে নৌকাটি। এ পর্যন্ত এই ভাসমান হাসপাতাল দেশের গ্রামাঞ্চলের সোয়া ৭ লাখ মানুষের চিকিৎসা করেছে। স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া এই সোয়া ৭ লাখ মানুষের একজন আল আমিন।

ভাসমান এই হাসপাতালটির নাম জীবন তরী। নামটি নেওয়া হয়েছে নোবেল বিজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি কবিতা থেকে।

দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ঝালকাঠি জেলায় যখন জীবন তরী যায়, তখন আল আমিনের দুপায়ে অস্ত্রোপচার করা হয়। অস্ত্রোপচারটি করাতে তার খরচ হয় প্রায় ২২০ ডলার। আল আমিনের ধারণা, দেশের কোনো প্রাইভেট ক্লিনিকে অস্ত্রোপচারটি করাতে যে পরিমাণ অর্থ দিতে হতো, তার চেয়ে অন্তত পাঁচগুণ কম খরচ পড়েছে তার।

আল আমিন বলেন, 'জন্ম থেকেই আমার ক্লাবফুটের সমস্যা। এই শারীরিক সীমাবদ্ধতা নিয়েই আমি বড় হয়েছি। জীবন তরী হাসপাতালে না যাওয়া পর্যন্ত কোনো চিকিৎসাও পাইনি। এখন আমি দিন দিন সুস্থ হয়ে উঠছি। আশা করি আগামী কয়েক মাসের মধ্যে আমি সুস্থ মানুষের মতো দৌড়াতে পারব।'

১৯৯৯ সালে ইমপ্যাক্ট ফাউন্ডেশন বাংলাদেশে জীবন তরী চালু করে। এই আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থাটি প্রতিবন্ধী ও দরিদ্রদের সাহায্য করে।

যেসব এলাকায় চিকিৎসা সুবিধা অত্যন্ত অপ্রতুল এবং কেবল নদীপথে যাতায়াত করা যায়, সেখানে অস্ত্রোপচারের চিকিৎসা দেয় জীবন তরী।

ইমপ্যাক্ট ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ-এর প্রধান নির্বাহী ড. হাসিব মাহমুদ সৌদি আরবের সংবাদ সংস্থা আরব নিউজকে বলেন, 'দুর্ভাগ্যবশত এই মানুষগুলো আনুষ্ঠানিক স্বাস্থ্যসেবা সুবিধার আওতার বাইরে এবং দারিদ্র্যের কারণে তারা বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকে স্বাস্থ্যসেবা নিতে পারে না।'

হাসপাতালটি চালাতে মাসে ৩৬ হাজার ডলার খরচ হয়। এই অর্থের বেশিরভাগই আসে আন্তর্জাতিক অনুদান থেকে।

আগামী কয়েক বছরের মধ্যে অবসরে যাবে জীবন তরী। এরপর নতুন জাহাজ চালু করার প্রস্তুতি ইতিমধ্যেই শুরু করেছে ইমপ্যাক্ট ফাউন্ডেশন।

হাসিব মাহমুদ বলেন, 'বোট হাসপাতালের সেবা আমাদের আরও অনেক বছর চালিয়ে যেতে হবে এবং টিকিয়ে রাখতে হবে। কারণ এখনও এর চাহিদা রয়েছে।' 

তিনি জানান, আগামী ছয় থেকে আট বছরের মধ্যে বর্তমান হাসপাতালকে প্রতিস্থাপন করতে হবে। তাই নতুন বোট হাসপাতাল নির্মাণের জন্য ইমপ্যাক্ট ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের বিশাল তহবিলের প্রয়োজন হবে। নতুন বোট হাসপাতালটি আরও অন্তত ৩০ বছর চলবে।'

ফেব্রুয়ারিতে ঝালকাঠি জেলায় এই ভাসমান হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেওয়ার পর আরেকজন রোগীর জীবন আরও ভালো হয়ে ওঠে। সে সাত বছর বয়সি সুমাইয়া আক্তার। বছরের পর বছর ধরে টনসিলে ভুগছিল সুমাইয়া। ফলে খাওয়া-দাওয়া করতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল তার।

সুমাইয়ার বাবা সোহাগ খলিফা পেশায় ভ্যান চালক। সামান্য যে আয় হয়, তা দিয়ে মেয়ের টনসিল অপসারণের অস্ত্রোপচার করার খরচ হওয়া সম্ভব ছিল না। 

সোহাগ বলেন, 'চিকিৎসার খরচ অনেক বেশি থাকায় ভয়ে আমি এর আগে অন্য হাসপাতালে যেতে পারিনি। জীবন তরী হাসপাতালে আমার নামেমাত্র খরচ হয়েছে। এখন ও [সুমাইয়া] পুরোপুরি ঠিক আছে।'

জীবন তরী একটি এলাকায় অন্তত ১০ মাস থেকে স্বাস্থ্যসেবা দেয়; এরপর অন্য এলাকায় যায়। আধুনিক চিকিৎসা সুবিধা রয়েছে এতে। জীবন তরীর কর্মচারীসংখ্যা প্রায় তিন ডজন; তাদের মধ্যে ডাক্তারের সংখ্যা চার।

জীবন তরীর ডাক্তারদের একজন ড. মোবাশ্বের সজিব। তিনি বলেন, পরিবার থেকে দূরে থাকতে মাঝে মাঝে কষ্ট হয়। 

'কিন্তু এখানে যে ভালো কাজগুলো করছি, সেগুলোর কথা ভাবলেই সব কষ্ট ভুলে যাই,' বলেন তিনি। 'অন্যান্য বড় হাসপাতাল আমাকে এমন প্ল্যাটফর্ম দেবে না।'

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.