ভারতের পাঠ্যপুস্তকে ইসলামী নয়, বরং বড় সাম্রাজ্যের ইতিহাসকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে 

ফিচার

ড. কৃষ্ণকলি হাজরা, দ্য প্রিন্ট 
12 June, 2022, 10:15 pm
Last modified: 12 June, 2022, 10:19 pm
সম্প্রতি এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন বিতর্কিত ‘সম্রাট পৃথ্বীরাজ’ সিনেমায় অভিনয় করা বলিউড স্টার অক্ষয় কুমার। তার কথানুসারে সত্যিই কি পাঠ্যপুস্তকে মুসলিম শাসনের সোনালী অধ্যায় তুলে ধরার প্রতি বেশি মনোযোগ রয়েছে? নাকি ঔপনিবেশিক শাসকেরা যেভাবে ইতিহাস রচনার ধারা সূচনা করেন- এটি তারই ফসল? নির্দিষ্টভাবে মুসলমান শাসনকে গুরুত্ব দেওয়া, নাকি ইতিহাসকে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখানোর চেষ্টা- কোন লক্ষ্যটি এক্ষেত্রে বেশি কাজ করেছে—বর্তমান বাস্তবতায় সে উত্তর সন্ধান খুবই জরুরি।  

ভারতে দক্ষিণপন্থী রাজনীতিকদের অনেকে সম্প্রতি অভিযোগ তুলছেন যে, দেশটির স্কুল সিলেবাসে মধ্যযুগের ইসলামী সাম্রাজ্যগুলোর অর্জনকে অতিরঞ্জন করা হয়েছে। তাদের মতে, দিল্লি সালতানাত আর মোগল সাম্রাজ্যের ক্ষেত্রে এই বাড়াবাড়ি হয়েছে বেশি। সে তুলনায়- অমুসলিম সাম্রাজ্যগুলো (বিশেষত যারা আকারে ছোট) পাঠ্যবইয়ের ইতিহাসের পাতায় তেমন গুরুত্বই পায়নি। তাদের আরও অভিযোগ, ভারত স্বাধীনতা লাভের পর বেশিরভাগ সময় যেসব দলের সরকার ক্ষমতায় ছিল (বিশেষত অভিযোগের তীর কংগ্রেসের দিকে) তারা এটি সংশোধন করেনি। বরং একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের (মুসলমান) অর্জনকেই তারা প্রাধান্য দিয়ে দেখিয়েছে। 

সম্প্রতি এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন বিতর্কিত 'সম্রাট পৃথ্বীরাজ' সিনেমায় অভিনয় করা বলিউড স্টার অক্ষয় কুমার। তার কথানুসারে সত্যিই কি পাঠ্যপুস্তকে মুসলিম শাসনের সোনালী অধ্যায় তুলে ধরার প্রতি বেশি মনোযোগ রয়েছে? নাকি ঔপনিবেশিক শাসকেরা যেভাবে ইতিহাস রচনার ধারা সূচনা করেন- এটি তারই ফসল? নির্দিষ্টভাবে মুসলমান শাসনকে গুরুত্ব দেওয়া, নাকি ইতিহাসকে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখানোর চেষ্টা- কোন লক্ষ্যটি এক্ষেত্রে বেশি কাজ করেছে—বর্তমান বাস্তবতায় সে উত্তর সন্ধান খুবই জরুরি।  

পাঠ্যপুস্তকে বড় সাম্রাজ্যগুলি কেন গুরুত্ব পেয়েছে?

অতি-সাম্প্রতিক সময়ের আগেও ভারতীয় সিলেবাসে বড় সীমানা নিয়ে গড়ে ওঠা সাম্রাজ্যের বর্ণনায় বিপুল প্রাধান্য ছিল। এসব সাম্রাজ্যের শাসন ব্যবস্থা ছিল কেন্দ্রীয়। অর্থাৎ রাজ্য পরিচালনা ও রাজনীতি দুটি দিকই কেন্দ্র থেকে নিয়ন্ত্রিত হতো। ইতিহাসের বইগুলো দেখলে চোখে পড়বে, এর ধারাবাহিকতায় রয়েছে মৌর্য, গুপ্ত সাম্রাজ্য থেকে শুরু করে দিল্লি সালতানাত ও মোগল সাম্রাজ্য পর্যন্ত। অর্থাৎ, বৌদ্ধ, হিন্দু, ইসলামি সব সংস্কৃতি ও ধর্মের বড় সাম্রাজ্যগুলোর উল্লেখ রয়েছে। 

এভাবে সিলেবাস প্রণয়ন ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসকেরা। তারা যেভাবে ইতিহাস রচনা করেছেন- সেভাবেই আজকে শিশুরা পড়ছে। আনুষ্ঠানিক ইতিহাসের উৎপত্তিও হয়েছে সেই ভিত্তির ওপর। একারণেই ভারত স্বাধীনতা লাভ করলেও- স্বাধীন দেশের সরকার ইউরোপের এসব রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণে গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিল। আর তাতে পরিবর্তন আনার চেষ্টা খুব একটা করেনি। 

আসলে ১৫ শতকে ইউরোপে আদর্শ জাতি রাষ্ট্রের ধারণার উৎপত্তি। এই রাষ্ট্রের সংজ্ঞা এমন যেখানে একটি কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্থ থাকবে বিপুল অঞ্চল; সীমানা সুরক্ষা বা বিস্তারে থাকবে সুবৃহৎ সেনাবাহিনী। খুব শিগগির এই সংজ্ঞাই ইউরোপের সফল সাম্রাজ্য বিচারের আদর্শ সংজ্ঞা হয়ে ওঠে।  

তাই ব্রিটিশ ভারতের ঔপনিবেশিক সরকার এ আতসকাঁচে ভারতের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করা শুরু করে। তাদের চোখে, সুবৃহৎ অঞ্চলজুড়ে গড়ে ওঠা সাম্রাজ্যগুলো সবচেয়ে উন্নত হিসেবে পরিগণিত হয়। ছোট রাজ্যগুলি একারণে বেশি আলোচিত হয়নি। এবং যে সময় ভারতে একজন সম্রাটের পরিবর্তে বহু শাসকের আধিপত্য ও পারস্পরিক কলহ ছিল—সে সময়কালগুলিকে অরাজক হিসেবে দেখানো হয়েছে। সাধারণত একটি বড় সাম্রাজ্যের সূর্যাস্তের সময় থেকে নতুন সাম্রাজ্যের উদয়ের মাঝখানের সময়টায় এমন বহু শাসকের আবির্ভাব ঘটেছে। বিভিন্ন অঞ্চলের এতজন শাসকের শাসনের ইতিহাস নথিবদ্ধ করা বা অনুসন্ধান করাও সহজ ছিল না। আর হয়তো একারণেই বিপুল সেনাশক্তির অধিকারী বড় সাম্রাজ্যগুলির ব্যাপারে লিখতেই বেশি আগ্রহী ছিলেন ব্রিটিশ ঐতিহাসিকেরা। এভাবেই তারা ইতিহাসের নাটকীয় অধ্যায়ের দৃশ্যকল্প রচনা করেন।  

বড় সাম্রাজ্যগুলি উত্তর ভারতে বেশি ছিল কেন? 

ভারতের ইতিহাসের বৃহৎ সব সাম্রাজ্যের মাঝে একটি প্রধান যোগসূত্র হলো- এরা প্রায় সকলেই গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চলে গড়ে ওঠে। এই সমভূমি দিল্লি/ আগ্রা ও প্রাচীন পাটালিপুত্রেরও অন্তর্গত। এ অঞ্চলকে কেন্দ্রে রেখেই বিভিন্ন শক্তিশালী রাজ-পরিবার বিশাল সাম্রাজ্য বিস্তার করতে থাকে। এরমধ্যে কিছু সাম্রাজ্য পুরো ভারতবর্ষজুড়ে বিস্তৃত ছিল- যেমন মোগলরা বা তাদের আগে মৌর্য শাসকেরা। 

ইন্দো-সমভূমি নামেও পরিচিত গাঙ্গেয় সমভূমি ছিল পলি দ্বারা গঠিত সমতল এলাকা। এর নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে প্রতিযোগী রাজপরিবারগুলি যুদ্ধে লিপ্ত হতো। অনেক সময় একটি যুদ্ধে জিতেই সুবিশাল এলাকার কর্তৃত্ব আসতো তাদের। অনেক সময় একাধিক যুদ্ধও হতো নিয়ন্ত্রণ ঘিরে। গুপ্ত ও দিল্লি সালতানাতের যুগে এ ভূমির দখল নিয়ে বহু লড়াইয়ের কথাও জানা যায়।  

গাঙ্গেয় সমভূমির বেশিরভাগ বাসিন্দা ছিল সাধারণ কৃষক। তাদের থেকে উচ্চ হারে রাজস্ব আদায় করা যেত। সমতল হওয়ায় রাজ্যের এক অঞ্চল থেকে অন্যত্রে যাতায়াত করা যেত সহজেই। সামরিক দিক থেকেও ছিল সুবিধা। মূল ঘাঁটি থেকে রাজ্যের দূরতম সীমান্তে এর ফলে সেনা মোতায়েনও সহজে করা সম্ভব ছিল। এসব সহায়ক উপাদান উত্তর ভারতের গাঙ্গেয় সমতলে সুবিশাল সাম্রাজ্যগুলির উদয়ের পেছনে অবদান রেখেছে। 

তাছাড়া কোন কোন রাজ্য বা রাজবংশের ইতিহাস লেখা হবে সেটি নির্বাচনের নেপথ্যে অবদান রেখেছে ভাষাও। যেমন ১৮৩৫ সাল পর্যন্ত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সরকারের রাজভাষা ছিল ফার্সি। আর দিল্লি সালতানাত ও মোগল রাজবংশ সম্পর্কে ফার্সি ভাষায় রচিত সূত্রের প্রাচুর্যও ছিল। সে তুলনায় আসামের বুরানজিস রাজবংশ বা তাদের গঠিত অহম সাম্রাজ্য সম্পর্কে ফার্সি ভাষায় লিখিত সূত্রের ঘাটতি ছিল। অন্যান্য ভাষার এসব সূত্রকে অনুবাদেও খুব একটা আগ্রহ দেখাননি কোম্পানি সরকারের বেতনভুক ঐতিহাসিকরা। কেবলমাত্র ২০ শতকে এসে অন্য ভাষায় রচিত ইতিহাসগুলো অনূদিত হতে শুরু করে। আর একারণেই ভারতের আরেক গুরুত্বপূর্ণ চোলা সাম্রাজ্য সম্পর্কেও ব্রিটিশ ঐতিহাসিকদের লেখনী খুবই বিরল। 


  • লেখক: ড. কৃষ্ণকলি হাজরা কলকাতার লোরেটো কলেছে ইতিহাসের শিক্ষক। 
  • সূত্র: দ্য প্রিন্ট 

 
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.