পাখিরা কেন গুরুত্বপূর্ণ?

ফিচার

জোনাথন ফ্রাঞ্জেন
05 June, 2022, 01:50 pm
Last modified: 05 June, 2022, 02:21 pm
পাখিদের লোম নেই এটা সত্য, কিন্তু এটা ছাড়া অনেক দিক দিয়েই তারা অধিকাংশ স্তন্যপায়ী প্রাণীদের চেয়ে মানুষের কাছের জীব। তারা দারুণ সব বাড়ি বানায় এবং পরিবার গঠন করে। শীতকালে তারা উষ্ণ স্থানে যায় লম্বা শীতের ছুটি কাটাতে। কাকাতুয়ারা এমন সব ধাঁধার সমাধান করে দেয় যা একটা শিম্পাঞ্জির জন্যও কঠিন। কাকেরা খেলতে পছন্দ করে। খুব বেশি ঝড়ো বাতাসের দিনে, যখন অধিকাংশ পাখিরই মাটিতে থাকতে পছন্দ করার কথা, তখন দেখছি কাকেরা পাহাড়ের কিনার থেকে ঝাঁপ দিয়ে নানা কসরতে মেতে থাকে।

জীবনের অধিকাংশ সময়ই আমি পাখিদের প্রতি কোনো মনোযোগ দিইনি। কেবলমাত্র বয়স ৪০ পেরোবার পর আমি সেই মানুষটিতে পরিণত হলাম যে একটা গ্রোসবিক (Grosebeak)-এর ডাক শুনে উদ্বেলিত হয়ে ওঠে বা আশেপাশে এলাকার একটা সোনাজিরিয়া দেখা গেছে জেনে সেটার সন্ধানে ছুটে যায়, কারণ এটি সোনালি রঙের এক অতি সুন্দর পাখি এবং যে কিনা উড়ে এসেছে সুদূর আলাস্কা থেকে। কেন যখন আমায় প্রশ্ন করে যে পাখিরা কেন আমার কাছে এতটাই গুরুত্বপূর্ণ, আমি কোনো উত্তর না দিয়ে স্রেফ কাঁধ ঝাঁকাই, কারণ আমাকে এই প্রশ্ন করা আর কেন আমি আমার ভাইদের ভালোবাসি সেই প্রশ্ন করা একই জিনিস, এর উত্তর হয় না। তবুও আমেরিকা মহাদেশের পরিযায়ী পাখির নিরাপদ চলাচলের চুক্তির শতবর্ষ পূর্তিতে এই প্রশ্নটি ঘুরে ফিরে আসতেই আছে যে 'পাখিরা কেন গুরুত্বপূর্ণ?'

আমার উত্তর হয়তো শুরু হবে পাখিদের বিশাল সাম্রাজ্যের দিকে মুগ্ধদৃষ্টি দিয়ে। কেউ যদি পৃথিবীর সব প্রজাতির পাখি দেখে ফেলে, সারা পৃথিবীই তার দেখা হয়ে যাবে। পালকাবৃত এই বন্ধুরা বিশ্বের প্রতিটি মহাসাগর ও ভূমির প্রতি কোণেই আছে, তারা এমন সব জায়গাতেও বসত গাড়ে যেখানে আর কোনও জীব টিকতেও পারবে না। মেটে-গাঙচিলেরা চিলির আতাকামা মরুভূমিতে ছানাদের বড় করে, যা কিনা বিশ্বের সবচেয়ে শুষ্ক এলাকা। সম্রাট-পেঙ্গুইনেরা বরফ মহাদেশ অ্যান্টার্কটিকার চরম শীতেও ডিমে তা দেয়, বার্লিনে মার্লিন দিয়েত্রিচের কবরে গোদাশিকরেরা বাসা করে, ম্যানহাটানের ট্রাফিক সিগন্যালের চড়ুইয়েরা, সমুদ্রগুহায় বাতাসিরা, হিমালায়ের পাথুরে চাতালে গৃধিনীরা, চেরনোবিলে চ্যাফিঞ্চেরা! পাখির চেয়ে একমাত্র বেশি এলাকা জুড়ে থাকে অতি ক্ষুদে অণুজীবেরা!

সারা গ্রহ জুড়ে এই নানা পরিবেশে টিকে থাকার জন্য পাখিরা বিবর্তিত হয়ে ১০ হাজার প্রজাতির  উদ্ভব ঘটেছে, যাদের আকৃতি আফ্রিকার ৯ ফুট উচ্চতার উটপাখি থেকে শুরু করে কিউবার ২ ইঞ্চি লম্বা বী-হামিংবার্ড পর্যন্ত হয়। তাদের চঞ্চু গগণবেড়, টোকানদের মত বিশাল হওয়া থেকে শুরু করে Weebill-দের মত অতি ক্ষুদেও হতে পারে, আবার সোর্ডবিলড-হামিংবার্ডের মতো চঞ্চু তার দেহের সমানও হতে পারে। কিছু পাখি যেমন টেক্সাসের রঙিলা-চটক (Painted Bunting), দক্ষিণ এশিয়ায় গুল্ডের মৌটুসি, অস্ট্রেলিয়ার রঙধনু লরিকিট অধিকাংশ ফুলের চেয়ে বর্ণীল, আবার কিছু পাখি এক ধূসরের এতগুলো রঙে আসে যে তাদের জন্য পাখি ট্যাক্সোনোমির নানা শব্দই তৈরি করতে হয়েছে – রুফাস, ফাল্ভাস, ফেরুজিনাস, ফক্সি, ব্রান-কালার।

পরিবেশের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ শকুনেরা আজ মহাবিপন্ন। ছবিতে দেখা যাচ্ছে আফ্রিকার দক্ষিণের কেপ ভালচারদের।

আচরণের দিক দিয়েও পাখিরা সমান বৈচিত্রপূর্ণ। কেউ কেউ অতিমাত্রায় সামাজিক, অন্যরা পুরোই উল্টো। ফ্ল্যামিংগো বা আফ্রিকার কোয়েলিয়ারা এক ঝাঁকে লাখ লাখ উড়ে, নানা জাতের টিয়াতা তো টিয়ানগরই বানিয়ে ফেলে কাঠি দিয়ে। আবার ডিপারেরা (Dipper) একাকি ঘোরাফেরা করে, তাও পানির নিচেই বা পাহাড়ি ঝর্নায়। একটা ওয়ান্ডারিং অ্যালব্রাটস যখন তার ১০ ফুট ডানা মেলে, তার নিকটতম অ্যালব্রাটসটি হয়তো তখনও ৫০০ মাইল দূরে!

নিউজিল্যান্ডে-ছাতিঘুরানির মতো অতি বন্ধুবৎসল পাখি আমি দেখেছি, যা কিনা একটা ট্রেইলে আমাকেই অনুসরণ করেছিল, আবার চিলিতে একটা কারাকারা আমাকে আক্রমণ করে মাথায় আঘাতের চেষ্টা চালিয়েছিল, অপরাধ একটাই যে আমি তার দিকে বেশিক্ষণ এক নজরে তাকিয়েছিলাম।

রোডরানাররা র‍্যাটলস্নেকদের লাথি দিয়ে মেরে খায়, সেই সময়ে একটা রোডরানার সাপের সামনে থেকে তার নজর একদিকে রাখে, অন্যজন পিছন থেকে এসে সাপকে আক্রমণ করে। সুইচোরারা মৌমাছি খায়, Leaf-tosser-রা পাতা ছুড়ে, মোটাচঞ্চুর মুরেরা (thick-billed Murre) ৭০০ ফুট পানির নিচে যেয়ে মাছ শিকার করে, পেরেগ্রিন-শাহিন ৩৫০ কিলোমিটার বেগে ধাওয়া করে শিকার ধরে, Wren-এর মতো ক্ষুদে Rushbird ছোট এক ডোবার চারপাশেই সারা জীবন কাটিয়ে দেয়, সেখানে একটা সেরুলিয়ান-ফুটকি (Cerulean Warbler) আমেরিকার নিউজার্সি থেকে পরিযায়ণ করে পেরু যেয়ে আবার নিউজার্সির সেই গাছটিতেই ফিরে আসে, যেখানে সে আগের বছর বাসা বেঁধেছিল।

পাখিদের লোম নেই এটা সত্য, কিন্তু এটা ছাড়া অনেক দিক দিয়েই তারা অধিকাংশ স্তন্যপায়ী প্রাণীদের চেয়ে মানুষের কাছের জীব। তারা দারুণ সব বাড়ি

বানায় এবং পরিবার গঠন করে। শীতকালে তারা উষ্ণ স্থানে যায় লম্বা শীতের ছুটি কাটাতে। কাকাতুয়ারা এমন সব ধাঁধার সমাধান করে দেয় যা একটা শিম্পাঞ্জির জন্যও কঠিন। কাকেরা খেলতে পছন্দ করে। খুব বেশি ঝড়ো বাতাসের দিনে, যখন অধিকাংশ পাখিরই মাটিতে থাকতে পছন্দ করার কথা, তখন দেখছি কাকেরা পাহাড়ের কিনার থেকে ঝাঁপ দিয়ে নানা কসরতে মেতে থাকে। ইউটিউবে কাকের একটি ভিডিও আবার বিশেষ প্রিয়, যেখানে দেখা যায় রাশিয়ায় বরফ ঢাকা এক ঢালু ছাদে কাকটি একটি প্লাস্টিকের ঢাকনিতে বসে আরামে নিচে নেমে আসে এবং আবার সেটি মুখে নিয়ে উপরে উড়ে যেয়ে ফের সেটায় নামতে থাকে আমোদিত ভঙ্গিতে।

এবং পাখিদের মাঝে আছে গায়কেরা, যারা মানুষের মতোই, পৃথিবীকে ভরিয়ে রাখে। নাইটিংগেলের সুর ইউরোপের অলিগলি মাতিয়ে রাখে, কুয়েটোতে গায়ক দামারা, চেংডুতে Hwameis-রা। চিকাডিদের (Chickadee) আছে যোগাযোগের জন্য বেশ জটিল এক ভাষা, যা শুধু তাদের স্বজাতির জন্য নয় বরং এলাকার প্রতিবেশি সকল পাখির সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে জানান দেয় শিকারি প্রাণীর আগমন ও আসন্ন বিপদ নিয়ে। পূর্ব-অস্ট্রেলিয়ার কিছু লায়ার-বার্ড এমন এক সুর গায় যা তার আদিপুরুষেরা শিখেছিল শত বছর আগে কোনো মানুষের বাঁশি বাজানো থেকে। লায়ারবার্ডের ছবি বেশি বেশি তুললে সে অবিকল আপনার ক্যামেরার শাটারের শব্দও নকল করে শোনাবে।

অস্ট্রেলিয়ার এক ধরনের কাকাতুয়া

আবার সেই সাথে পাখিরা সেই কাজগুলোও অনায়াসে করে যা মানুষেরা করতে চায় কিন্তু পারে না, হয়তো একমাত্র স্বপ্নেই আমরা পাখিদের ছুঁতে পারি। যেমন পাখিরা উড়তে পারে। ঈগলেরা অনায়াসে উষ্ণ-বায়ূপ্রবাহে, হামিংবার্ডরা শূন্যেই থেমে পিছ ফিরতে পারে, বটেরারা কামানের গোলার মতো সোজা বসা থেকে উড়তে পারে। যদি আমরা সামগ্রিকভাবে হিসাব করি তাহলে দেখবে পাখিদের ওড়ার পথ, গাছ থেকে গাছে, মহাদেশ থেকে মহাদেশে অন্তত ১০০ বিলিয়ন ভাবে ছড়িয়ে আছে! পাখিদের কাছে কোনো সময়েই এই গ্রহ খুব বিশাল কিছু ছিল না। প্রজননের পর একটি ইউরোপীয়-বাতাসি প্রায় এক বছর টানা উড়তেই থাকে, এর মাঝে সে ইউরোপ থেকে সাব-সাহারা আফ্রিকায় যেয়ে আবার ফিরেও আসে, খাওয়া-ঘুম সবই চলতে থাকে, একটিবারের জন্যও ভূমি স্পর্শ না করেই। তরুণ অ্যালব্রাটসেরা  প্রথমবারের মতো ভূমিতে প্রজননের তাগিদে ফেরার আগে প্রায় ১০ বছর মহাসাগরের ভ্রমণে করেই চলে। একটা দাগিলেজ-জৌরালি একটানা মাত্র ৯ দিনে ৭,২৬৪ মাইল পেরিয়ে আলাস্কা থেকে নিউজিল্যান্ডে  পৌঁছানোর রেকর্ড আছে। অন্যদিক পুঁচকে চুনিকন্ঠি-হামিংবার্ড শুধু মেক্সিকান উপসাগর পেরোতেই নিজ দেহের ওজনের এক-তৃতীয়াংশ ক্ষয় করে ফেলে। বি-৯৫ নামের ট্যাগ পরানো একটি লাল-নট যে ফি-বছর পরিযায়নকালে দক্ষিণের তিয়েরা দেল ফুয়েগো থেকে উত্তরের কানাডার আর্কটিক তুন্দ্রা অবধি যত বার যাতায়াত করেছে, তা ৫ লক্ষ কিলোমিটারের মতো, অর্থাৎ পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্বের চেয়েও বেশি।

তবে মানুষের একটি সক্ষমতা আছে, যা কোনো পাখির নেই, তা হচ্ছে পরিবেশের ওপরে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা। কোনো পাখিই জলাভূমি সংরক্ষণ করতে পারে না, মাছের আবাস নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, বাড়িতে শীতাতপের ব্যবস্থা করতে পারে না। তাদের সেই অনুভূতি এবং দৈহিক বৈশিষ্ট্যগুলো আছে যে বিবর্তনের লম্বা পথ ধরে তাদের মধ্যে প্রোথিত হয়ে গেছে। প্রায় ১৫ কোটি বছর ধরে মানুষের উদ্ভবের বহু আগে থেকেই পাখিরা ভালোই টিকে ছিল পৃথিবীতে সেই সব বৈশিষ্ট্য নিয়ে। কিন্তু এখন মানুষেরা পৃথিবীকে পরিবর্তন করে ফেলছে। এর ভূমি, এর সাগর, এর জলবায়ু- যা পাখির বিবর্তনের মাধ্যমে খাপ খাওয়ানোর জন্য অতি দ্রুত। আমাদের আবর্জনা ফেলার  জায়গায় হয়তো কাক আর গাঙচিলদের সংখ্যা বাড়ছে, নগরের উদ্যানে রবিন আর বুলবুলেরা বেড়েই চলেছে, কিন্তু অধিকাংশ পাখি প্রজাতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে তাদের রক্ষার জন্য মানুষের নেওয়া পদক্ষেপের ওপরেই। এখন প্রশ্ন হচ্ছে তারা কি মানুষের সেই প্রচেষ্টা নেবার মতো মূল্যবান বা গুরুত্বপূর্ণ?

পত্রিকার প্রচ্ছদে সেক্রেটারি বার্ডের ছবি

মূল্য, আজকের মানুষের পৃথিবীতে সম্পূর্ণভাবে অর্থনৈতিক দিক থেকেই মাপা হয় এবং যা যা মানুষের সরাসরি কাজে আসে তা দিয়েই। অনেক বুনো পাখিই মানুষ খেতে পারে। পাখিদের অনেকেই ক্ষতিকর পোকা ও ইঁদুর খেয়ে থাকে। অনেক পাখি ফুলের পরাগায়ন, গাছের বীজের বিস্তার, শিকারি প্রাণীর খাদ্য ইত্যাদি হিসেবে ইকো-সিস্টেমে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। আপনার হয়তো এটাও শুনে থাকবেন যে পাখির উপস্থিতি পরিবেশের সুস্থতা নিরূপণ করে থাকে। কিন্তু আসলেই কি একটি পাখিশুন্য জগতের ভয়াবহতা বোঝাতে আমাদের জলাভূমি দূষিত করে, বন কেটে ধ্বংস করে, মাছের বিচরণ ক্ষেত্র নষ্ট করে তবেই বুঝতে হবে? দুঃখজনক সত্যটি হচ্ছে মানুষের অর্থনীতিতে আপাত দৃষ্টিতে বুনোপাখির ভূমিকা কেউই বুঝতে পারবে না। সাধারণ মানুষ জানবে এই পাখির ঝাঁকেরা আমাদের ব্লুবেরি খেয়ে শেষ করে দিচ্ছে।

পাখির সংখ্যা অন্তত একটা জিনিস খুব সরাসরি বলতে পারে, তা হচ্ছে মানুষের নৈতিকতার পরিমাপ। বুনোপাখিরা আমাদের সেই প্রাকৃতিক জগতের সাথে শেষ মেলবন্ধন, যে জগত দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীতে মানুষ আসার আগে তারাই সবচেয়ে বেশি এলাকাজুড়ে বিস্তৃত ছিল। তারা পৃথিবীতে আজ অবধি হাঁটা সর্ববৃহৎ প্রাণীটিরই বংশধর- আপনার জানালা দিয়ে দেখে ক্ষুদে চড়ুইটি  একটি অতি সুন্দর, ছোট্ট, পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ানো ডাইনোসরই। বাড়ির কাছে ডোবায় বুনোহাঁসটি যেভাবে ডাকে, দুই কোটি বছর আগেও  মাইওসিন যুগে হাঁসেরা প্রায় এইভাবেই ডাকত।  এখনকার এই ভয়াবহ কৃত্রিমতার জগতে যেখানে বাতাসে উড়ে যাচ্ছে ড্রোনেরা আর আমাদের মোবাইল স্ক্রিন ভরে থাকে অ্যাংরি বার্ড গেমে,  সেখানে আমরা ভাবতেই পারি যে আদি আকাশের প্রভুদের অস্তিত্ব নিয়ে আমাদের এত চিন্তা না করলেও চলবে। কিন্তু টাকা দিয়েই কি জগতের সর্বোচ্চ  জিনিসগুলোর পরিমাপ করা যায়? পাখিদের অস্বীকার করার অর্থ হচ্ছে আমরা যে নিসর্গেরই সন্তান, সেই কথা অস্বীকার করা।

নানা প্রজাতির পাখির চঞ্চুর আকার হয় নানা রকম যা সম্পূর্ণভাবেই মূলত নির্ভর করে তাদের খাবার সংগ্রহের প্রক্রিয়ার ওপর

যে মানুষেরা মনে করে 'পাখিদের জন্য সত্যিই এটা খারাপ হচ্ছে, কিন্তু মানুষের গুরুত্ব বেশি' তারা হয়তো দুইটা অর্থ বুঝেছে, একটা হতে পারে যে মানুষ অন্য যে কোনো প্রাণীর চেয়ে উন্নততর নয়, সেলফিশ জিনের দ্বারা চালিত ও প্রভাবিত হয়ে আমরা সেটাই করব যা আমাদের ভোগের জন্য দরকার, মানুষের বাহিরে যে জগত আছে তাদের ক্ষতিসাধন করে হলেও। তারা মনে করে প্রাণীপ্রেম একটা বিরক্তিকর ধরনের অনুভূতি, তাদের ভুল প্রমাণ করা সম্ভব নয়,  কিন্তু এটা তাদেরই চিন্তা যারা চূড়ান্ত ধরনের স্বার্থপর মনের মানুষ।

আবার 'মানুষের গুরুত্ব বেশি' এই কথার অন্য অর্থ হতে পারে যে আমরা অন্য প্রাণীদের চেয়ে আলাদা বলেই প্রকৃতির ওপর এই একচ্ছত্র আধিপত্য ফলাতে পেরেছি, আমাদের সচেতনতা ও বুদ্ধিমত্তার ফলে আমরা অতীত মনে রেখে ভবিষ্যৎ চিন্তা করেই সামনের দিকে এগোতে পারি। এ ধরনের চিন্তা ধার্মিক ও সেক্যুলার  দুই ধরনের চিন্তার মানুষদের মাঝেই পাওয়া যায়, এটি হয়তো সত্যিও না, আবার মিথ্যাও না। কিন্তু এখানে আমাদের সামনে প্রশ্ন এসে দাঁড়ায় যে-  আমরা যদি অন্য প্রাণীদের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ই তাহলে সেটা কি আমাদের দায়িত্ব নয় যে এক বৃহত্তর স্বার্থে, সবার জন্য বাসযোগ্য নিসর্গের জন্য আমাদের ভোগবিলাসের কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমরা ছাড় দিব? এক অনন্য ক্ষমতা কি এক অনন্য দায়িত্ববোধেরও জন্ম দেয় না?

অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমে পাওয়া যায় এই রঙিন রোসেলাদের।

কয়েক বছর আগেই উত্তর-পশ্চিম ভারতের বনে এক জগত কাঁপানো শব্দ শুনি আমি,যা আমার হৃদয়ে অনুভব করতে পারছিলাম এতই জোরালো সেই আওয়াজ। প্রায় ঝড়ের মতো আওয়াজের উৎস আসলে ছিল এক জোড়া রাজধনেশের ডানা ঝাপটানো, যারা কাছের ফলজ গাছে উড়ে এসে বসেছিল খাদ্যের অন্বেষণে। তাদের বিশাল হলুদ চঞ্চু আর সাদা পালকে আবৃত মাংসল উরু দেখে টুকান পাখি আর চীনের পাণ্ডার মধ্যবর্তী এক ক্রস হওয়া প্রাণী বলে ভ্রম হচ্ছিল।  সেই বিশাল পাখিদুটো যখন নীরবে ফল খাওয়া শুরু করল, আমি খেয়াল করলাম বিরলতম এক অনুভূতির কারণে আমার চোখ দিয়ে জল নামছে, সেই অনুভূতির নাম – শুদ্ধতম সুখ।  এটার সাথে আমার ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়া-অর্জনের বিন্দুমাত্র সম্পর্ক ছিল না। এই সুখের উৎস ছিল সেই রাজধনেশের তার পরিবেশে আমার উপস্থিতি মেনে নিয়ে শান্ত ভাবে খাদ্য খোঁজার দৃশ্য।
     
পাখিরা সবসময় মানুষের সাথেই থাকে, কিন্তু মানুষের কেউ হয় না। তারা বিবর্তনের ফলে উদ্ভূত এক বিশ্বচারী প্রকৃতিজয়ী প্রাণী যারা কেবল আমাদের চেয়ে আলাদা। এবং পাখি ও মানুষের এই পার্থক্য আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে মানুষ সবকিছুর বিচারক হতে পারে না। আমরা যে অতীত মেনে ভবিষ্যতের চিন্তা করি, পাখিরা সেটা ছাড়াই অনায়াসে টিকে থাকে, কারণ পাখিরা বাস করে বর্তমানে।  এবং বর্তমানে, আমাদের পোষা বেড়াল, আমাদের কাঁচের জানালা, আমাদের কীটনাশক প্রতিবছর কয়েকশ কোটি পাখি হত্যা করে, অনেক দ্বীপ দেশের পাখি আমাদের কারণে বিলুপ্তই হয়ে গেছে, তবুও জগত এখনও অনেক জীবন্ত। এই গ্রহের প্রত্যেক স্থানে নানা ধরনের পাখির বাসায়, যার আয়তন বাদামের খোসা থেকে শুরু করে খড়ের স্তুপের মত বিশাল, পাখির ছানারা ডিমের খোলা ভেঙ্গে আলোকময় জগতে প্রবেশ করছেই।


(২০১৮-র জানুয়ারিতে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক পত্রিকায় প্রকাশিত, আন্তর্জাতিক পাখিবর্ষ উদযাপনের  অংশ হিসেবে)

ভাষান্তর: তারেক অণু

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.