‘বাবুর্চিখানা’য় পুরান ঢাকা গ্যালারি, সঙ্গে ৫৫ টাকার তেহারি
ফিচার
যতই ভাবি পুরান ঢাকায় আর খেতে যাব না, ততোই যেন এর ঐতিহ্য আর খাবারের স্বাদ আমাকে পিছু ডাকে। যেকারণে, প্রতিবারই ছুটে যাই পুরান ঢাকার অলিতেগলিতে। নতুন ঢাকার সুন্দর, সাজানো আর বিলাসবহুল রেস্টুরেন্টের কাছে পুরান ঢাকার এসব বিরিয়ানি, কাবাবের দোকান হয়তো খুব সাধারণ মানের। কিন্তু যারা ইতিহাস ভালোবাসে, তারা বারবারই ছুটে আসে এই স্মৃতিবিজড়িত পুরান ঢাকায়।
তাই সেদিন আবার পা বাড়ালাম পাটুয়াটুলির ৩৩ নাম্বার লেনের 'বাবুর্চিখানা'তে। শুধু খাবার জন্য কোথাও আমি সচরাচর যাই না। তাই খেতে হলে এমন জায়গায়ই খুঁজি। যেখানে পেটের ক্ষিদেও মিটবে, মনের তৃষ্ণাও মিটবে।
মাত্র ১২ বছর আগে এই রেস্তোরাঁর পত্তন
ইন্টারনেট ঘাঁটাঘাঁটি করে খুঁজে পেলাম 'বাবুর্চিখানা'র নাম। আগেই বলে রাখি, এই রেস্তোরাঁর সাথে তেমন কোনো ঐতিহ্য বা ইতিহাস মিশে নেই। মাত্র ১২ বছর আগে এই রেস্তোরাঁর পত্তন। খুব বিখ্যাত কেউ এখানে এখন পর্যন্ত পা রাখেনি। তবে, ঢাকাকে যারা ভালোবাসেন, তাদের জন্য এই 'বাবুর্চিখানা' যেন এক ছোট্ট জাদুঘর!
রেস্তোরাঁয় ঢুকেই দেখি সরু গলির মতো লম্বা করিডোর। দু'পাশে কেবিনের মতো ভাগ করে দেওয়া বসার জায়গা। দু পাশে দুটি করে মোট আটটি বসার জায়গা। প্রতি টেবিলে আট থেকে নয়জনের বসার ব্যবস্থা আছে।
ঢাকাপ্রেমীদের জন্য 'বাবুর্চিখানা' যেন এক ছোট্ট জাদুঘর
এত শত শত বিখ্যাত পুরোনো খাবারের দোকান থাকতেও, বাবুর্চিখানাতেই ছুটে আসার কারণ, এর অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জা। যেখানে সাধারণত খাবার হোটেলগুলোতে দেখা মেলে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন খাবারের আকর্ষণীয় ছবি সেখানে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এবং অনন্য 'বাবুর্চিখানা।'
বাবুর্চিখানার পুরো দেয়ালজুড়ে আছে ঐতিহাসিক ঘটনা আর স্থাপনার কয়েক শতাধিক ছবি। যে ছবিগুলো নিয়ে যাবে ঢাকার প্রাচীন সময়ে, ভাবিয়ে তুলবে প্রিয় ঢাকার দ্রুত বদলে যাওয়ার দৃশ্য।
প্রতিটি দেয়ালে ৩০টির বেশি ছবি মিলে প্রায় কয়েকশ ছবি রয়েছে হোটেলের দেয়ালজুড়ে। মুখরোচক আর জিভে জল আনা খাবারের ছবি না দিয়ে যে ঢাকার ঐতিহাসিক রূপ দেয়ালে দেয়ালে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, তা মালিকপক্ষের শিক্ষিত রুচিশীলতাকেই নির্দেশ করে।
হোটেলটি নতুন, কিন্তু ছবিগুলো বারবার নিয়ে যায় সেই ১৮-১৯ শতকে। ছবিগুলো যেন বারবার ডেকে চলেছে ঢাকার আঁতুড়কাল থেকে ঢাকার যৌবনকালের সেই সোনালি সময়ে। যে কারণে এসব ছবিতে ঢাকার ঐতিহ্যের ছাপ যেমন রয়েছে, তেমনি অবকাঠামোগত বিবর্তনের চিত্রও উঠে এসেছে।
পুরনো চিড়িয়াখানা, পুরনো রেল স্টেশন, হারিয়ে যাওয়া এমন অনেক স্থাপনার ছবি স্থান পেয়েছে এখানে। ঢাকা গেট, লালবাগ কেল্লা, আহসান মঞ্জিল, রূপলাল হাউস, ১৮ শতকের নিউমার্কেট, গুলিস্তান সিনেমা হল, বাংলা একাডেমি, পিলখানা, তৎকালীন সদরঘাট, বাদামতলী ঘাট, লোহারপুল, ধোলাইখাল, মিডফোর্ড, পুরান ঢাকার মহল্লার দৃশ্য, লালকুঠি, ১৮ শতকের ঢাকার রাস্তা, বায়তুল মোকাররম মসজিদের পূর্বের অবস্থা, বর্ধমান হাউসের প্রাথমিক অবস্থা, বাহাদুর শাহ পার্কসহ ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাগুলোর অসংখ্য পুরনো চিত্র রয়েছে। এসব ছবির সঙ্গে বর্তমান ঢাকার ব্যবধান অনেক। আর তা-ই হয়তো ঢাকার বর্তমান রূপ দেখে যারা ক্লান্ত আর বিরক্ত, তাদের কাছে ঢাকার সেই হারিয়ে যাওয়া জৌলুস তুলে ধরতেই ছবিগুলো টাঙ্গানো হয়েছে।
বাইরে থেকে দেখলে হয়তো আর দশটা বিরিয়ানির হোটেল বলেই মনে হবে বাবুর্চিখানাকে। তাছাড়া, এই হোটেলটি নিয়ে ইন্টারনেটে তেমন লেখালেখিও হয়নি। কেন হয়নি জানিনা। তবে হোটেলে পা রাখার পর থেকে পানমশলা মুখে দিয়ে বেরিয়ে আসার আগ পর্যন্ত পুরোটা সময় শুধু এটাই মনে হয়েছে, কেন এই হোটেল মানুষের অজানাতে রয়ে গেছে?
অবশ্য পুরান ঢাকার শতবর্ষী, অর্ধশতবর্ষী সব হোটেলের মাঝে 'বাবুর্চিখানা' একেবারেই শিশু। খুব বেশিদিন তো হয়নি জন্ম। তাই হয়তো এখনো এর খোঁজ জানেনা অনেকেই।
খাবো? নাকি ছবিগুলো দেখতে দেখতে আগের ঢাকায় হারিয়ে যাবো?
খেতে এসে যেন এই বিভ্রান্তিতেই পড়ে গেলাম। একদিকে রাখা মুরগির তেহারি, মুরগির কোর্মা পোলাওয়ের গন্ধ নাকে আসছে; অপরদিকে চোখ পড়ে আছে দেয়ালে ঝোলানো সেসব শতবর্ষী আগের ছবিতে। তাই ওয়েটারকে অর্ডার দিয়েই পুরো হোটেলের প্রতিটি দেয়াল ঘুরে ঘুরে দেখলাম। আমাকে দেখে ম্যানেজার এগিয়ে এলেন। জানালেন, মালিক ঢাকাকে খুব ভালোবাসেন। আর তাই ঢাকার ইতিহাসকে তুলে ধরতেই এই আয়োজন। ছবিগুলো দেখতে দেখতে ভাবছিলাম কত শত ছবি তার সংগ্রহে!
হোটেলে ভিড় নেই, এমনকি এখানকার সার্ভিসও ভালো। ছোট্ট ১৩ বছরের একটি ছেলে আর একজন ওয়েটার মিলে আমাদের টেবিলটি পরিস্কার করে সাজিয়ে দিলেন। আমরা অর্ডার করেছিলাম খাসির লেগ রোস্ট, মুরগির তেহারি, মুরগির কোরমা-পোলাও। মুরগি আর খাসি গরম করে আনতে আনতে পোলাওয়ের ঘ্রাণ আর সইতে পারছিলাম না। না পেরে খালি পোলাওই মুখে পুরে দিলাম। মনে হলো, একদম মাখনের মতো মোলায়েম হয়ে চালগুলো গলে গেল মুখের ভেতর! মাংস আসতে আসতে তিন চার লোকমা খেয়ে ফেললাম আরও। শুধু পোলাওয়ের স্বাদই এত অপূর্ব, যদি মাংস বা ঝোল না-ও থাকতো, তাও বোধহয় পুরোটা গাপুস গুপুস করে খেয়ে ফেলা যেত!
বাবুর্চিখানার বিশেষ আকর্ষণ ৫৫ টাকার মুরগির তেহারি
স্বাদ এবং মানে কোনো কৃপণতা রাখেননি বাবুর্চিখানার বাবুর্চিরা। যেমন নাম, তেমনি এর খাবারের ব্যবস্থা। এখানকার খাবারের মধ্যে রয়েছে মুরগির রোস্ট-পোলাও, মুরগির কোর্মা-পোলাও, টার্কি মুরগির তেহারি, মুরগির তেহারি স্পেশাল, বোরহানি এবং শাহী জর্দা।
তবে, বাবুর্চিখানার বিশেষ আকর্ষণ ৫৫ টাকার মুরগির তেহারি। আগে নাকি ৪৫ টাকাতেই পাওয়া যেত। এখন দশ টাকা বেড়েছে দাম। বারোটার মধ্যে দোকান খুলে যায় পুরোপুরি। সারাদিন একই খাওয়াই চলে। রূপচাঁদা মাছ ফ্রাই একপিস ২৫০টাকা। ইলিশ মাছ ফ্রাই একপিস ১৮০ টাকা, সাথে পোলাও নিলে আরও এক ৫০ টাকা। জর্দা ৬০-১২০ টাকা প্যাকেট, এখানে বসে খেলে ৩০ টাকা। বোরহানি প্রতি গ্লাস ৩৫ টাকা, লিটার ১৪০ টাকা। খাসির লেগ রোস্ট ২৬০ টাকা, মুরগির রোস্ট পোলাও, এক পিস ডিম আর রোস্ট একত্রে ১৪০ টাকা।
ম্যানেজার বলেন, "আমাদের চাল আর মশলায় একটু ভিন্নতা আছে। কী ভিন্নতা সেটা বলতে পারবো না, তবে অন্যদের চেয়ে আমাদের রান্না আলাদা। এই স্বাদ অন্য কোথাও পাবেন না।"
ঢাকার বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রতিদিনই ভোজনরসিকরা আসেন বাবুর্চিখানার তেহারির স্বাদ নিতে। তবে হোটেল ম্যানেজার জানান, এখানে মুরগির তেহারিটাই বেশি চলে। দাম কম বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই আসেন বেশি। এখানে কোনো নাস্তা আইটেম নেই।
যদিও হোটেল কর্তৃপক্ষের দাবি তারা খাবারে তেল কম দেয়, তবে খেতে গিয়ে তেমনটা মনে হয়নি। অবশ্য খাবারের মশলা, নূন, ঝাল তেল কোনোটাই কাস্টমারকে অস্বস্তিতে ফেলবে না। প্রতিটি উপাদানের যথাযথ সংমিশ্রণে যে খাবারগুলো রান্না করা হয়, তা স্বাদেই স্পষ্ট।
প্রতিদিন প্রায় ৪০-৫০ কেজি পোলাও আর ৩০-৩৫ কেজি মাংস রান্না হয় তাদের এখানে। প্রতিটি আইটেমই স্বাদের কথা চিন্তা করলে সমান চলে। তবে তেহারির দামটা কম হওয়ায়, এর চাহিদা একটু বেশি।
দাম কম বলেই যে এর সুনাম- তা কিন্তু মোটেই না। স্বাদেও অসাধারণ। মুরগির তেহারি, মুরগির কোর্মা পোলাও, খাসির লেগ রোস্ট, বোরহানি কোনোটাই কম যায়না স্বাদে। আইটেমের মধ্যে কাবাব, তান্দুরি চিকেন, রূপচাঁদা, ইলিশ মাছ ফ্রাই থাকলেও, আপাতত এই আইটেমগুলো পাওয়া যাচ্ছে না।
নীলক্ষেতে তাদের আরেকটি শাখা আছে। পরিকল্পনা আছে, তিনশো ফিটেও একটি শাখা খোলার। তবে হোটেলের সাজসজ্জায় যে স্বকীয়তা তা শুধু পাটুয়াটুলির এই হোটেলেই রয়েছে।
একসঙ্গে অল্টারনেটিভ হেভি মেটাল মিউজিক করতেন দুই বন্ধু
হোটেলের মালিক রেজাউল হোসেন এবং ম্যানেজার মাহবুব হোসেন (ছদ্মনাম) দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ক্লাস নাইন টেনে পড়ার সময় থেকেই দুজন একসঙ্গে অল্টারনেটিভ হেভি মেটাল মিউজিক করতেন। পাঁচজন নিয়ে তাদের ব্যান্ডের নামটি ছিল নাইটমেয়ার্স।
তবে হোটেলের ম্যানেজার মাহবুব হাসান (ছদ্মনাম) জানান, আগে এই হোটেলের এখানে সিডি ক্যাসেটের দোকান ছিল। তখন নাকি খুব চলতো এই দোকান। জেমস, হাসান, আইয়ুব বাচ্চুর মতো মিডিয়ার লোকদের আনাগোনা ছিল এই দোকানে। গান রেকর্ডিংও করা হতো এখানে। প্রায় তিন দশক জুড়ে জমজমাট ছিল এই দোকান। কিন্তু এরপর ক্যাসেট আর সিডির ব্যবসা পড়ে গেলে, মালিক খাবারের দোকান দেন।
খুব জমজমাট ব্যবসা না হলেও সন্তোষজনক পর্যায়েই চলছে ব্যবসা, এমনটাই দাবি হোটেল কর্তৃপক্ষের।
Comments
While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.