‘এমন নয় যে বিশ্ব শীর্ষে পদচিহ্ন এঁকে দেবার জন্য আমি উদগ্রীব ছিলাম না’

ফিচার

29 May, 2022, 09:15 pm
Last modified: 29 May, 2022, 10:19 pm
আজ ২৯ মে এভারেস্ট দিবস। স্যার এডমুন্ড হিলারি ও তেনজিং নোরগের এভারেস্ট জয়ের ৬৯ বছর পূর্তি। মানবজাতির অসামান্য এ অর্জন নিয়ে হিলারির স্মৃতিচারণ টিবিএসের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো

১৯৫৩ সালের ২৯ মে'র সেই সকাল থেকেই- যখন তেনজিং নোরগে এবং আমি প্রথমবারের মত পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ আরোহণে সক্ষম হলাম, আমাকে এক মহান অভিযাত্রী হিসেবে বর্ণনা করা হতে লাগলো। কিন্তু আমি আসলে স্রেফ এক পোড় খাওয়া কিউয়ী, যে জীবনের বহু প্রতিকূলতাকে উপভোগ করেছে মনেপ্রাণে।

সত্য বলতে, আজ ৫০ বছর পরে সেই দিনের দিকে ফিরে তাকালে জীবনের অনেক পদক্ষেপের চেয়ে এভারেস্ট শীর্ষে আরোহণকে কম গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়, বিশেষ করে আমার শেরপা বন্ধুদের জীবনযাত্রার মানের উন্নতির জন্য এবং হিমালয়ের সংস্কৃতি ও সৌন্দর্য রক্ষার জন্য যে কাজগুলো আমার জীবনে করতে সক্ষম হয়েছিলাম।

এমন নয় যে, বিশ্ব শীর্ষে পদচিহ্ন এঁকে দেবার জন্য আমি উদগ্রীব ছিলাম না। স্পষ্ট মনে পড়ে তেনজিং এবং আমি বরফের মুখোমুখি হয়ে চূড়ার কাছের সেই সরু ঢালের সামনে। আমাদের দলের অনেকেই বলেছিল, এই ঢাল অতিক্রম করা সম্ভব না- যদিও আমাদের কাছে তা ততটা বিপদজনক মনে হয়নি। মুখোশে অক্সিজেনের নতুন বোতল এঁটে আমাদের যাত্রা শুরু হয়। বরফকুঠার দিয়ে নতুন পথের ধাপ প্রস্তত করতে করতে আমিই পথনির্দেশ করছিলাম।

এভারেস্ট চূড়ায় ওঠার পথে তেনজিং ও হিলারি। ছবি: পিএ

প্রায় এক ঘণ্টা পরে ২৯,০০০ ফুট উচ্চতায় এক বিশাল বাধা সেই ৪০ ফুট লম্বা পাথুরে দেয়াল আমাদের পথরোধ করে দাঁড়ালো। অতিকায় দেয়ালের ডান দিকে ফাটলসমৃদ্ধ এক বরফের চাঙ পড়েছিল, এর পরেই পর্বত যেন শূন্য পরিণত হয়ে ঝাড়া ১০,০০০ ফুট নিচে নেমে খ্যাংসুং হিমবাহে পরিণত হয়েছে। বরফের এই পিণ্ড কি আমার ওজন সয়ে টিকে থাকতে পারবে? উত্তর জানার একটিই উপায় ছিল!

বরফে ক্রাম্পন ঠেঁসে ধরে কোনমতে প্রতিটি ফাঁকফোঁকর ব্যবহার করে সেই ফাটলের চূড়ার দিকে যাত্রা অব্যাহত থাকল। প্রথমবারের মত মনে হল, আমরা সফল হতেও পারি। ডান দিকে এক তুষার গম্বুজের মত দেখা গেল যার উপর দিয়ে আমাদের পথ কেটে অগ্রসর হওয়া চলতেই থাকে। এক ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে সেই রিজের চূড়ায় পৌঁছানোর পর চারিদিকে কেবল শূন্যতাই দৃষ্টিগোচর হয়। তেনজিং আমার সাথী হয় এবং ব্যাপক আনন্দে আপ্লুত হয়ে ও স্বস্তির সাথে আমরা এভারেস্ট শীর্ষে নিজেদের আবিস্কার করি। 

ছবি: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক

সেই বছরের পরে আরও বহু বার এভারেস্ট অঞ্চল ভ্রমণের মাধ্যমে আমার সেই পর্বতারোহী বন্ধুদের সাথে একটা দৃঢ় সম্পর্ক গড়ে ওঠে। শেরপাদের সাহস এবং শক্তি আমাকে অভিভূত করলেও তাদের বাড়িতে পরিবারের একজন হিসেবেই অনেকদিন অতিক্রম করার ফলে মনে হতে থাকে, তাদের সমাজ ব্যবস্থায় সুচিকিৎসা এবং বিদ্যালয়ের মত জিনিসের অভাব রয়ে গেছে।

১৯৬০ সালের এক অভিযানে এভারেস্টের কাছেই হিমবাহের উপর ক্যাম্প স্থাপনের পর- ঘনীভূত ঠাণ্ডাকে দূর করার জন্য ক্ষুরধার বাতাসকে অগ্রাহ্য করে, এক ধোঁয়াময় আগুনকে ঘিরে সবাই উষ্ণতার সন্ধানরত থাকা অবস্থায় ভাঙ্গা ভাঙ্গা নেপালি এবং ইংরেজিতে শেরপাদের জীবনযাত্রা নিয়ে আলাপচারিতা চলছিল। উরকিয়েন নামের একজন শেরপা নিভে আসা আগুনে এক মুঠো জ্বালানি ছিটিয়ে নিভু নিভু আগুনকে উস্কে দিয়ে হিমকে ক্ষণিকের জন্য ঠেকিয়ে রাখল। তাকে উদ্দেশ্য করেই প্রশ্ন করলাম- তোমার গ্রামের জন্য যদি আমরা কিছু একটা করতে পারি, সেটা কি হবে উরকিয়েন?

তার উত্তর ছিল- আমাদের বাচ্চাদের বিদ্যালয়ে পাঠাতে চাই সাহেব। তোমার যত জিনিস আছে, তার মধ্যে অধ্যয়নই আমাদের বাচ্চাদের জন্য সবচেয়ে কাঙ্খিত। 

এভারেস্ট জয় শেষে বেজক্যাম্পে ফেরার পর তেনজিং ও হিলারি। ছবি: রয়টার্স

তারই কথাই ঠিক থাকল। পরের বছর কলকাতার এক কোম্পানিকে একটি অ্যালুমিনিয়ামের ক্ষুদে ভবন দান করানোর ব্যাপারে রাজি করাতে সক্ষম হলাম। সুইস রেড ক্রস ভবনটি কয়েকবারে কাঠমান্ডু থেকে ১৫,৫০০ ফিট উচ্চতায় মিংবো উপত্যকায় উড়িয়ে নিয়ে যায়। এরপর একদিনের হাঁটা দূরত্বে শেরপারা সেই নির্মাণ সামগ্রী বহন করে খুমজুং-এ নিয়ে আসে, আমাদের স্কুলটি মাথা তুলে দাঁড়ায় হিমালয়ের কোলে।

১৯৬১ সালের জুনে থিয়্যাং বোচে মনেস্ট্রির প্রধান লামাকে স্কুলে উদ্বোধনের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। তার সাথে জনাকয়েক বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ট্রাম্পেট, ঢোল এবং অন্যান্য বাদ্যযন্ত্র নিয়ে আবির্ভূত হয়ে নানাবিধ বাজনার সাথে সাথে প্রার্থনার পর স্কুল ভবনটিকে প্রদিক্ষণ করে মুঠো মুঠো চাল চতুর্দিকে নিক্ষেপ করে খুমজুংয়ের বিদ্যালয়টির শুভযাত্রা শুরু করে।

মাউন্ট এভারেস্ট। সংগৃহীত ছবি

বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমি ও আমার স্ত্রী জুন, সারা বিশ্ব ঘুরে হিমালয়ের অধিবাসীদের জন্য নিত্যনতুন পরিকল্পনা এবং তা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাড়ের চেষ্টা করতে থাকি। শেরপা বন্ধুদের অনুরোধক্রমে, ২৭টি বিদ্যালয়, ২টি হাসপাতাল এবং ১২টি মেডিক্যাল ক্লিনিক স্থাপনে আমরা সক্ষম হই এবং সেই সাথে হিমালয়ের কিছু বুনো ক্রুদ্ধ নদীর উপরে সেতু নির্মাণও সম্ভবপর হয়।

কয়েকটি রানওয়ে নির্মাণের সাথে সাথে বুদ্ধমন্দির পুনঃনির্মাণেও হাত দিই সবাই এবং সাগরমাতা ন্যাশনাল পার্কে এক লাখের উপরে বীজবপন করা হয়; যেন জ্বালানি কাঠ সংগ্রহের এবং হোটেল নির্মাণের উদ্দেশ্য ধ্বংসপ্রাপ্ত বন কিছুটা হলেও আগের সবুজ অবস্থানে ফিরে যেতে পারে। 

অনেক অনেক বছর ধরেই পৃথিবীর নানা দুর্গম প্রান্তরে ছোট-বড় নানা অভিযান এবং পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ভিতর দিয়ে আমাকে যেতে হয়েছে। বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গের সাথে সাথে উত্তর মেরু এবং দক্ষিণ মেরুতেও পা রেখেছি- তার অংশ হিসেবেই।

আজ যখন আমার সারা জীবনের স্মৃতিচারণ করি, দৃঢ় কণ্ঠে বলতে পারি সেই সুউচ্চ পর্বতারোহণ কিংবা বন্ধুর ভূখণ্ড পাড়ি দেওয়া নয়; জীবনের সেরা অর্জন ছিল, আমার হিমালয়ের বন্ধুদের জন্য সেই বিদ্যালয় এবং মেডিক্যাল ক্লিনিকগুলো স্থাপন এবং পরিচালনা করা। 


[স্যার এডমুন্ড হিলারির স্মৃতিচারণমূলক লেখাটি এভারেস্ট জয়ের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ২০০৩ সালের মে মাসে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকে প্রকাশিত হয়]

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.