‘ধীরে উষ্ণ হতে থাকা পাত্রে ব্যাঙের সেদ্ধ হয়ে মরার মতো’: তাপদাহ বাড়ছেই ভারতের

ফিচার

টিবিএস ডেস্ক  
23 May, 2022, 09:45 pm
Last modified: 23 May, 2022, 10:21 pm
বিজ্ঞানীরা ভারত ও পাকিস্তানের তাপপ্রবাহকে সরাসরি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রমাণ বলছেন। তাদের মতে, চলতি বছরের তাপদাহ নজিরবিহীন হলেও, এমন ঘটনা সামনে বার বার ঘটতেই থাকবে এবং পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধির সাথে সাথে দিনে দিনে জীবনধারণের জন্য অসহনীয় হয়ে উঠবে গ্রীষ্মকাল।  

ভারতজুড়ে তখন চলছিল রেকর্ড তাপপ্রবাহ। খরতাপে ঝলসে যাচ্ছে চারপাশ, এরমধ্যেই দিল্লি নগরীর উপকন্ঠের এক নির্মাণ প্রকল্পে কাজ করছিলেন শ্রমিক নরেশ আহিরওয়ার। ওই সময় টানা একমাসের বেশি সময় ধরে তাপদাহে পুড়েছে উত্তর ভারতের বিশাল অংশ; ৫৬ বছরের নরেশেরও মনে হচ্ছিল এই বুঝি জ্ঞান হারাবেন। তবু জীবিকার দায়ে আধ-নির্মিত ভবনে মাথায় ইট/সিমেন্টের বোঝা নিয়ে উঠছিলেন। বিকেল ঘনাতে দেওয়া হয় বিশ্রামের সুযোগ। কিন্তু, জিরোবার উপায় নেই-তাপমাত্রা তখনও ৪০ ডিগ্রী সেলসিয়াসের ওপরে।     

নরেশ বলেন, "আগে অনেক ভারি ভারি বোঝা বইতাম, কোনো সমস্যা ছিল না- এখন প্রতি কদম ফেলতেই কষ্ট হয়, যেন আমি এখনই মরে যাব। কিন্তু, আমাদের মতো মানুষের সম্বল দৈনিক মজুরি, কাজ বন্ধ রেখে বসে থাকার উপায় আমার নেই।"   

তবে যার সামান্য সুযোগ আছে, সে আর্থিক ক্ষতি  হলেও ঘর থেকে বেরোতে চাইছে না। গরমে এমনই আইঢাঁই অবস্থা সকলের। নরেশ যে নির্মাণ প্রকল্পে কাজ করছেন- তার ঠিক উল্টোদিকে রাস্তার অপর পাশে মাটির তৈজসপত্রের একটি দোকান আছে। বিকেলের আগেই দোকান বন্ধ করে তারপুলিনের নিচে আশ্রয় নেন বিক্রেতা। এতে আয় কমে গেলেও, দোকানি অসহনীয় অবস্থার কথাই বলেন।    

সুনিল কুমার বলেন, "আমার পণ্যগুলি গ্রীষ্মকালের জন্যই। এই মৌসুমের পুরো সময় ঘরে বেকার বসে থাকার উপায় নেই। কিন্তু, তাই বলে মাঝ দুপুরের দাবদাহ সহ্য করাও অসম্ভব হয়ে উঠেছে।"  

দিল্লিতে এমন দাবদাহ নতুন কিছু নয়, তবে আগে তাপমাত্রা শুধু গ্রীষ্মকালের সর্বোচ্চ সময়েই এত বেশি হতো। এখন আরও বেশি সময় ধরে প্রচণ্ড গরম থাকছে চারপাশ। ভারতে তাপমাত্রা রেকর্ড শুরুর পর সবচেয়ে খরতাপ ছিল গত এপ্রিলে। তবে মধ্য মার্চেই উত্তর ভারতের বিশাল অংশ জুড়ে তাপদাহ চলছে ঘোষণা দেওয়া দেয় আবহাওয়া বিভাগ। এরপর মে মাসের শুরুতে বৃষ্টির কারণে খরতাপের যন্ত্রণা কিছুটা কমলেও পরের সপ্তাহেই তাপমাত্রা ৪৫ ডিগ্রী সেলসিয়াসে পৌঁছানোর আভাস দিয়েছিলেন আবহাওয়াবিদেরা।    

৩৬ বছরের সুনীল কুমার চার সন্তানের জনক। মাটির হাড়িপাতিল বিক্রিই তার একমাত্র পেশা। গরমের কারণে জীবিকার কষ্ট নিয়ে তিনি বলেন, 'আগের মতো শুধু মে বা জুন মাসের কয়েক সপ্তাহের বিষয় হলে হয়তো বাড়িতেই থাকতাম। কিন্তু, মার্চ থেকে দাবদাহ শুরু হয়ে বছরের বেশিরভাগ সময় ধরে থাকলে- কী করব?' 

ভারতের একটি জনপ্রিয় ফুড চেইনের মাঠপর্যায়ের ডেলিভারি এজেন্ট বরুন জানান, দিনের প্রচণ্ড গরমের সময়টায় গাড়ি চালিয়ে খাবার সরবরাহের সময় তিনি ঠান্ডা পানিতে ভেজানো এক টুকরো কাপড় মাথায় পাগড়ির মতো করে জড়িয়ে নেন। 

'তাতে কিছুটা স্বস্তি পাই। কিন্তু ভেজা কাপড়ও কয়েক মিনিটে শুকিয়ে যায়। এদিকে বাড়িতে অর্থকষ্ট। সে কারণেই এ চাকরিটা নিয়েছি। তাই চাইলেও ছাড়তে পারব না। এই মৌসুমে আমার মতো অনেক ডেলিভারি কর্মী অসুস্থ হয়ে পড়েছে।" 

দিল্লি রাস্তায় প্রখর রোদ থেকে বাঁচতে ব্যাগ দিয়ে মাথা ঢেকে পথ চলছেন এক নারী। ছবি: রয়টার্স

তাপপ্রবাহে ভারতের দরিদ্ররাই সবচেয়ে কষ্টে আছে, তবে সমাজের কোনো অংশই এর প্রভাবমুক্ত নয়। দিল্লির উপকণ্ঠের হাইরাইজ ভবনময় জনসংখ্যা ঘনত্ব বেশি থাকা স্যাটেলাইট শহর- নইদার বাসিন্দারাও ভুগছে। চলতি বছর এখানকার সম্পন্ন বাসিন্দাদের শীত শেষ হতে না হতেই চালু করতে হয়েছে বাড়ির এয়ারকন্ডিশনার। শিশুরা শারীরিকভাবে দুর্বল বোধ করায় এখানকার অনেক অভিভাবক স্কুল বন্ধ রাখা বা ক্লাসের সময়সূচি বদলের দাবি করছেন।  

বৃহত্তর নইদার এক বাসিন্দা বিবেক অরোরা বলেন, 'কয়েক বছর ধরেই অসহ্য হয়ে উঠছে গ্রীষ্মকাল। আমাদের বিদ্যুৎবিল আকাশ ছুঁয়েছে। দিনের বেশিরভাগ সময় বাড়িকে বাসযোগ্যই মনে হয় না। এনিয়ে কেউ অভিযোগ করেনি। সবাই ভেবেছে অভ্যাস হয়ে যাবে। আমাদের অবস্থা আগেও ছিল- হাঁড়িতে থাকা জ্যান্ত ড ব্যাঙের মতো, যাদের ধীরে ধীরে সিদ্ধ করা হচ্ছে। এ বছর মনে হচ্ছে চুলা থেকে জ্বলন্ত উনুনে পড়েছি আমরা।' 

ভারত ও পাকিস্তানে এ বছর কোটি কোটি মানুষ নজিরবিহীন তাপদাহের শিকার হয়েছেন। পাকিস্তানের কোথাও কোথাও তাপমাত্রা ৫২ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মতো উচ্চ মাত্রায় রেকর্ড হয়েছে। বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে বলছেন, এমন গরম শুধু মানব স্বাস্থ্যের জন্য নয় বরং প্রাকৃতিক বাস্তুসংস্থান, কৃষি, পানি সরবরাহ ও বিদ্যুৎ সরবরাহ-সহ অর্থনীতির প্রধান প্রধান খাতে ধারাবাহিক ক্ষতি সৃষ্টি করে চলেছে।  

এরমধ্যেই বিদ্যুৎ চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় প্রচণ্ড জ্বালানি সংকটে পড়েছে ভারত। খরতাপে আগুন লেগে যাচ্ছে ময়লা ফেলার ভাগাড়ে, নষ্ট হয়েছে বিপুল জমির গম ফসল; যে কারণে চলতি মৌসুমের প্রত্যাশিত উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না। গরম থেকে শরীর ঠান্ডা রাখতে চাহিদা রয়েছে লেবুর শরবতের। লেবুর দাম এখন চাহিদার ঠেলায় যেন মহাকাশের সীমানা ছুঁতে চলেছে।  

গরমে ক্লান্ত রিক্সাচালকেরা জিরিয়ে নিচ্ছে। ছবি: পিএ

দাবহাহে অসুস্থতা ও প্রাণহানি রোধে সকলকে অন্তত দুপুর বেলা ঘরে থাকার পরামর্শ দিচ্ছে সরকার। তবে কেন্দ্রীয় সরকারের পদক্ষেপ অনেকটাই দায়সারা গোছের। সম্প্রতি উচ্চ পর্যায়ের এক বৈঠকে রাজ্যগুলিকে তাপপ্রবাহ মোকাবিলায় নিজস্ব কর্মপরিকল্পনা নিতে বলে তারই ইঙ্গিত দেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।   

বিজ্ঞানীরা বলছেন, ভারত ও পাকিস্তানের তাপপ্রবাহ চরম জলবায়ু ঘটনাবলীর চিহ্ন। একে তারা সরাসরি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রমাণ বলছেন। তাদের মতে, চলতি বছরের তাপদাহ নজিরবিহীন হলেও, এমন ঘটনা সামনে বার বার ঘটতেই থাকবে এবং পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধির সাথে সাথে দিনে দিনে জীবনধারণের জন্য অসহ্য হয়ে উঠবে গ্রীষ্মকাল।  

লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজের এক গবেষণায় দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে চলতি বছরের মতো চরম তাপপ্রবাহের সম্ভাবনা অনেকগুণে বেড়েছে।  

এব্যাপারে কলেজটির গ্রান্থাম ইনস্টিটিউটের গবেষণা সহকারী ড. মারিয়াম জাকারিয়াহ বলেন, 'মানব কর্মকাণ্ডের জেরে পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ার আগে, চলতি বছর ভারতে যেমন তাপদাহ হয়েছে তা ৫০ বছরে মাত্র একবার হতেই দেখা যেত। অথচ এখন তা সাধারণ ঘটনা হয়ে উঠছে। এখন প্রতি চার বছরে এমন চরম তাপমাত্রা দেখা দেওয়ার শঙ্কা করা হচ্ছে। বৈশ্বিক নিঃসরণকে সার্বিকভাবে থামানো না গেলে এটি আরও ঘন ঘন দেখা দিবে।" 

ভারত মহাসাগরের ক্রান্তীয় এলাকায় উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে আসছে বছরগুলোয় আরও ঘন ঘন ও দীর্ঘমেয়াদী তাপপ্রবাহ ঘটার আভাস দেওয়া হচ্ছে, যাতে সরাসরি প্রভাবিত হবে ভারতীয় উপমহাদেশ। এতে এল-নিনোর মতো চরম আবহাওয়া অল্প সময়ের মধ্যে বার বার দেখা দেবে। এমন সতর্কবাণী দিয়েছে দিল্লি-ভিত্তিক সংস্থা ক্লাইমেট ট্রেন্ডস।    

ভারতের শুস্ক মরু অঞ্চলই নয়, তাপদাহের থাবা এরমধ্যেই বরফাচ্ছাদিত হিমালয় অঞ্চলেও হানা দিয়েছে। প্রচণ্ড তাপে আগুন লাগছে বনে। উত্তরাখণ্ড প্রদেশে সম্প্রতি এমন দাবানলের কথা জানা গেছে।  

আপাতত দাবদাহের কবল থেকে মুক্ত দক্ষিণ ভারত। তবে ২১ শতকের শেষ নাগাদ সেখানেও খরতাপের উপদ্রুপ শুরু হবে বলে জানিয়েছে ক্লাইমেট ট্রেন্ডস।  

কার্বন নিঃসরণ কমানোর মতো জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমনের উদ্যোগ নেওয়ার পাশাপাশি সহনশীলতা কৌশল তৈরিকে অত্যন্ত জরুরি বলে উল্লেখ করেছেন বিজ্ঞানীরা। তাদের মতে, এতে করে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির শিকার কোটি কোটি মানুষের যন্ত্রণা কমানো যাবে। তবে সরকারগুলি এখনও সতর্ক না হলে, শুধুমাত্র এক ধরনের পদক্ষেপ নিয়ে কোনো লাভ তো হবেই না- বরং তা দীর্ঘমেয়াদে আরও বিপদ ডেকে আনবে।  


  • সূত্র: দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট ডটইউকে 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.