ইতিহাস সাক্ষী, গমের সংকটে রুটির জন্য বারেবারে রাস্তায় নেমেছে মানুষ

ফিচার

টিবিএস রিপোর্ট
14 May, 2022, 04:20 pm
Last modified: 14 May, 2022, 04:47 pm
ইউক্রেনে আক্রমণ চালিয়ে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন মোটামুটি একপ্রকার বাটারফ্লাই ইফেক্টের সূচনা করে দিয়েছেন, যার জেরে খাদ্য নিরাপত্তার অভাবে বিশ্বের অনেক দেশেই বিক্ষোভ, দাঙ্গার মতো ঘটনা ঘটতে পারে।

গম, ময়দা ইত্যাদি থেকে তৈরি খাবার বিশ্বের অনেক অঞ্চলের মানুষের প্রধান আহার্য। এ দুই ফসলের সংকট ঘটলে পৃথিবীর অনেকগুলো দেশের মানুষকে অভুক্ত থাকতে হবে। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায় গম, ময়দা, রুটি ইত্যাদির জন্য মানুষ অনেকবার দাঙ্গা-হাঙ্গামা, বিক্ষোভ ইত্যাদিতে লিপ্ত হয়েছে।

সম্প্রতি দেশের বাজারে গমের দাম কমাতে এ শস্যটি রপ্তানি নিষিদ্ধ করেছে ভারত। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম গম উৎপাদনকারী দেশ ভারত। দ্য টাইমস অভ ইন্ডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, ভারত বছরে গড়ে ১০৭.৫৯ মিলিয়ন মেট্রিক টন গম উৎপাদন করে।

অন্যদিকে ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে রয়টার্স-এর প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ বছর ভারতের গমের মোট উৎপাদন ১১১.৩২ মিলিয়ন মেট্রিক টন হবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। এ নিয়ে টানা ছয় বছর ধরে উদ্বৃত্ত পরিমাণে গম উৎপাদন করছে দেশটি। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বৈশ্বিক খাদ্য সংকটের প্রভাব ভারতের উপরেও পড়েছে। সেজন্য আপাতত গম রপ্তানি না করার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে দেশটি।

ইউরোপের রুটির ঝুড়ি বলা হয় ইউক্রেনকে। সেই দেশে আক্রমণ চালিয়ে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন মোটামুটি একপ্রকার বাটারফ্লাই ইফেক্টের সূচনা করে দিয়েছেন, যার জেরে খাদ্য নিরাপত্তার অভাবে বিশ্বের অনেক দেশেই বিক্ষোভ, দাঙ্গার মতো ঘটনা ঘটতে পারে।

চলুন জেনে নেওয়া যাক ময়দার জন্য বিশ্বে ঘটে যাওয়া কয়েকটি দাঙ্গার কথা।

ফরাসি বিপ্লব

১৮ শতকে ফরাসি বিপ্লবের পেছনে রুটির সংকটও একটি বড় ভূমিকা রেখেছিল। ১৭০০ সালের পর থেকে ফ্রান্সে ধীরে ধীরে বিক্ষোভ পুঞ্জীভূত হতে থাকে। সম্রাটের আদেশে তখন ব্যবসায়ীরা চাইলেই নিজেদের মতো করে খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়িয়ে দিতে পারত।

১৭৭৫ সালের এপ্রিল থেকে মে মাসে তিন সপ্তাহের ব্যবধানে ফ্রান্সে ময়দার জন্য কমপক্ষে ৩০০টি দাঙ্গা-হামলার ঘটনা ঘটে। এটি ইতিহাসে 'ফ্লাওয়ার ওয়ার' বা ময়দার যুদ্ধ নামে পরিচিত।

বোস্টন

১৭১৩ সালে বোস্টনে রুটির দাম বেড়ে যাওয়ায় প্রায় ২০০ জন মানুষ বিক্ষোভ শুরু করেন। এর আগের চার বছর মিলিয়ে এটি ছিল রুটি নিয়ে বোস্টনে তৃতীয় দাঙ্গার ঘটনা।

গমের যোগান কমে যাওয়ায় এবং ব্যবসায়ীরা গম মজুত করে রাখায় এটির দাম আকাশচুম্বী হয়৷ ওই দাঙ্গার পর বোস্টনে খাবার সংকট কমাতে আইন পাশ করা হয়।

নিউইয়র্ক সিটি

১৮৩৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে ময়দার দাম বৃদ্ধি পাওয়ার জেরে একটি সহিংস দাঙ্গা শুরু হয়। দুই বছর টানা ফসলের কম উৎপাদন এবং বিদেশি বিনিয়োগের অভাবের কারণে মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যায় দেশটিতে। তখন আটার দাম প্রতি ব্যারেল পাঁচ থেকে সাত ডলারের পরিবর্তে ১২ থেকে ২০ ডলার পর্যন্ত হয়ে যায়।

দাঙ্গার সময় ক্ষুধার্ত শ্রমিকরা ময়দার গুদামে হামলা চালান। তাদেরকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য আধাসামরিক সপ্তম রেজিমেন্টকে ডেকে পাঠানো হয়। যখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলো, ততক্ষণে ৫০০ থেকে ৬০০ ব্যারেল ময়দা ও ১০০০ ব্যাগ গম নষ্ট করে ফেলেছেন দাঙ্গাকারীরা। এ ঘটনায় ৪০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

রিচমন্ড ব্রেড রায়ট। ছবি: দ্য মিউজিয়াম অভ দ্য কনফেডারেসি ভায়া এনসাইক্লোপিডিয়া ভার্জিনিয়া

ভার্জিনিয়া

১৮৬৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ার রিচমন্ডে প্রায় ৫,০০০ মানুষকে রুটির অভাবে রাস্তায় নেমে আসতে দেখা যায়। এ সময় তারা 'রুটি অথবা রক্ত' স্লোগান দিতে শুরু করেন। পরবর্তীসময়ে তারা বিভিন্ন দোকান ভেঙে খাবার, কাপড়, জুতা, গয়না ইত্যাদি লুঠ করেন। তাদেরকে সামলানোর জন্য সেনাবাহিনী ডাকে স্থানীয় প্রশাসন।

জর্জিয়া

১৮৬৪ সালে জর্জিয়ার সাভানাকেও রুটি নিয়ে দাঙ্গার সাক্ষী হতে দেখা যায়। প্রায় ৫০ থেকে ১০০ নারী রাস্তায় নেমে মুদির দোকানে ভাঙচুর চালিয়ে লুটতরাজ শুরু করেন।

মিলান

১৮৯৮ সালের মে মাসের ৬ থেকে ১০ তারিখে ইতালির মিলানে রুটির সংকটে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। দাঙ্গাকারীরা রাস্তায় চেইন বিছিয়ে দেন যাতে অশ্বারোহী বাহিনী তাদের ওপর হামলা চালাতে না পারে।

এ দাঙ্গায় কমপক্ষে ৮০ জন বিক্ষোভকারী ও দুইজন সৈন্য নিহত হন। ঘটনাটি ইভেন্টস অভ মে নামেও পরিচিত।

১৯১৭ সালে এনওয়াইসি'র সিটি হল-এ রুটির দাবিতে বিক্ষোভ করছেন নারীরা। ছবি: লাইব্রেরি অভ কংগ্রেস ভায়া জেএসটিওআর ডেইলি।

ব্রুকলিন

প্রধান নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের ব্রুকলিনে ১৯১৭ সালে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পণ্যের দাম ৫০ শতাংশ বেশি বেড়ে গিয়েছিল। নারীদের লাইন ধরে খাবার সংগ্রহ করতে হতো। এরকম এক লাইনে একজন নারী খাবার কেনার পর দেখলেন তার কাছে দাম দেওয়ার মতো কোনো অর্থ নেই।

তখন তিনি হতাশ হয়ে একটি খাবারের গাড়িকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেন। এ ঘটনার পরই দাঙ্গা শুরু হয় এবং তা শহরের চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ৫০০০ লোক একসাথে মিছিল করতে করতে স্লোগান দিতে থাকেন, 'আমাদের রুটি দে'।

১৯৭৭ সালে মিশরের রাস্তায় দাঙ্গা। ছবি: সিবিএস নিউজ

মিশর

১৯৭৭ সালে মিশরের সরকার রুটিসহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ওপর ভর্তুকি বন্ধ করে দিলে দাঙ্গা শুরু হয়। দু'দিন ধরে চলা এ দাঙ্গায় প্রায় শ'খানেক মানুষ মারা যান এবং আহত হন আরও অনেকে। এরপর সরকার পুনরায় গমের ওপর ভর্তুকি বরাদ্দ দেয়।

২০০৮ সালে বিশ্বব্যাপী খাদ্যশস্যের দাম বেড়ে যায়। মিশরের মুদ্রাস্ফীতিও বাড়তে থাকে। এ দুয়ের ফলে দেশটিতে আবারও ফুড-রায়ট শুরু হয়। সেবার আন্দোলনেও অনেক মানুষ মারা যান।


তথ্যসূত্র: বিজনেস ইনসাইডার, দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস, বিবলিও এমপোরিয়াম, ম্যাস মোমেন্টস

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.